ধর্মীয় সংগঠনগুলিকে ভোট প্রচারে নামাচ্ছে বিজেপি ভুলুণ্ঠিত নেতাজি রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন

আর এস এস–এর ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলি আগামী নির্বাচনে খোলাখুলি বিজেপির জন্য ভোটের প্রচারে নামতে চলেছে৷ সম্প্রতি সঙেঘর সমন্বয় বৈঠকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, হিন্দুত্ববাদের প্রয়োজনে কেন বিজেপিকে ক্ষমতায় রাখা দরকার তা প্রচার করতে হবে৷ সঙেঘর পক্ষ থেকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির যে হাওয়া ছিল তা এবারে নেই৷ ঝুলিতে প্রচারের আর কোনও সম্বল না থাকায় ইতিমধ্যেই রামমন্দির নিয়ে ভোটের প্রচারে নেমে পড়েছে তারা৷ আর এস এস–বিজেপির মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি যে এই কৌশল অবলম্বন করবে সেটা সকলেরই জানা৷ কিন্তু এই সাম্প্রদায়িক শক্তি এখন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ এ দেশের নবজাগরণ তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের বড় মানুষদের ছবি হাতে প্রচার শুরু করেছে৷ বড় মানুষদের সম্পর্কে এ দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আবেগ রয়েছে তাকে তারা কাজে লাগাতে চাইছে৷ সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে রথযাত্রার কর্মসূচিতে নেতাজি–রবীন্দ্রনাথের্ সুসজ্জিত ছবি তারা ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছিল৷ নরেন্দ্র মোদি আন্দামানে গিয়েও নেতাজির নাম করে বক্তব্য রেখেছেন৷ অথচ নেতাজি, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নবজাগরণের এই মহান সন্তানেরা সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিভাজনের প্রবল বিরোধী ছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘…মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সেইটেকেই সহজ প্রতীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি৷ যে দেশে ধর্মই সেই বুদ্ধিকে পীড়িত করে, রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধি কি সে দেশকে বাঁচাতে পারে?’’ রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগতভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়েও হিন্দুত্ববাদের প্রবল বিরোধী ছিলেন৷ তিনি বলেছেন, ‘‘ভারতবর্ষের কেবল হিন্দু চিত্তকে স্বীকার করলে চলবে না৷ ভারতবর্ষের সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতির বিকাশ ঘটেছে হিন্দু মুসলমানের সংমিশ্রণে বিচিত্র সৃষ্টি হিসাবে৷’’ আর বিজেপি–আর এস এস রবীন্দ্রনাথের ছবিতে মালা দিয়ে রথযাত্রা করছে, ভোটে জেতার লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করতে৷ এটা কি দেশের মানুষ মানতে পারে?

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সারা জীবন সেকুলার চিন্তা নিয়ে চলেছেন৷ হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েই বিজেপি–আরএসএস মানুষকে মাতাতে চায়৷ এই চাওয়া কখনও নেতাজির চাওয়া হতে পারে না৷ নেতাজি বলেছেন– ‘‘হিন্দুরা ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ বলিয়া ‘হিন্দুরাজের’ ধ্বনি শোনা যায়৷ এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা৷ …হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ পৃথক– ইহার চেয়ে মিথ্যা বাক্য আর কিছু হইতে পারে না…৷’’ তিনি বলেছেন – ‘‘ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে রাজনীতি হইতে বাদ দেওয়া উচিত৷ ধর্ম ব্যক্তিবিশেষের বিষয় হওয়া উচিত৷ ব্যক্তি হিসাবে মানুষ যে ধর্ম পছন্দ করে তাহা অনুসরণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা তার থাকিবে৷ কিন্তু ধর্মীয় কিংবা অতীন্দ্রীয় বিষয়ের দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত নয়৷ ইহা পরিচালিত হওয়া উচিত শুধু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক বিচারবুদ্ধির দ্বারা’’ (ক্রসরোডস)৷ আরও বলেছেন– ‘‘সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষায় পাঠিয়েছে৷ ত্রিশূল আর গেরুয়া বসন দেখলে হিন্দু মাত্রই শির নত করে৷ ধর্মের সুযোগ নিয়ে, ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে৷ …এই বিশ্বাসঘাতকদের আপনারা রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিন, তাদের কথা কেউ শুনবেন না …৷’’

সেই নেতাজির ছবি দেখিয়ে সেই ত্রিশূলধারীদের নামিয়েই জনগণকে বোকা বানিয়ে ভোটে জিততে চায় বিজেপি৷ এই চালাকির রাজনীতি, নেতাজির এই অসম্মান দেশের মানুষ মেনে নেবে কি?

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ২৫ সংখ্যা)