ধনকুবেরদের সম্পত্তি বাড়ল এক বছরে ৫০০ শতাংশ

নোট বাতিলের দু’বছর পার হয়ে গেল৷ বিজেপি সরকারের পক্ষ থেকে তার উদযাপনে ধুমধাম দূরের কথা, কোনও ছোটখাটো অনুষ্ঠানও হল না৷ তিলকে তাল করে প্রচার করতে বিজেপি নেতাদের জুড়ি নেই৷ সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়েই তো সরকার সর্বত্র ধুমধামের নির্দেশ দিয়েছিল৷ তা হলে নোট বাতিলের দু’বছর পূর্তিতে শুধুমাত্র অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি একটি ছোট বিবৃতি দিয়ে দায় সারলেন কেন?

তিনি বলেছেন, ‘ডিজিটাল কার্ডে লেনদেনের প্রসার তাঁদের সরকারেরই সাফল্য৷’ ২০১৬–র ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নিজে দূরদর্শনে নোট বাতিল ঘোষণা করেছিলেন৷ সেই প্রধানমন্ত্রীর এখন কোনও বিবৃতি নেই, সাফল্যের কোনও সগর্ব ঘোষণাও নেই– এটা ভাবা যায়!

নোট বাতিল ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন, এর দ্বারা দেশ থেকে কালো টাকা সম্পূর্ণ রূপে নির্মূল করা সম্ভব হবে৷ যদিও দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ যখন দিনের পর দিন ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে নতুন নোট পাচ্ছিলেন না এবং তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন তখন কয়েক দিন অন্তর অন্তরই প্রধানমন্ত্রী নোট বাতিলের নতুন নতুন উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করছিলেন৷ যেমন, জাল নোট দূর হবে, দুর্নীতি দূর হবে, সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা যাবে৷ লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যখন শতাধিক মানুষের মৃত্যু হল এবং মানুষ ক্রমাগত অধৈর্য হতে থাকল তখন প্রধানমন্ত্রী আবার বললেন, এই শেষবার লাইনে দাঁড়ানোর কষ্ট করুন৷ ৬০ বছর ধরে মানুষ চিনির জন্য লাইন দিয়েছে, চালের জন্য লাইন দিয়েছে, খাবারের জন্য লাইন দিয়েছে৷ এবারে ব্যাংক বা এটিএমের সামনের লাইন হল ভারত থেকে সমস্ত রকম লাইন শেষ করার লক্ষ্যে শেষবারের লাইন৷

আজ দু’বছর বাদে দেশে কারও বুঝতে বাকি নেই, প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষকে ধোঁকা দিয়েছিলেন, ভুল বুঝিয়েছিলেন, মিথ্যে কতগুলো আশার বাণী শুনিয়েছিলেন৷ অর্থনীতিতে কালো টাকার রমরমা যেমন ছিল তেমনই আছে৷ নতুন নোট বাজারে আসতে না আসতেই জাল হতে শুরু করেছে এবং নিয়মিতই তা ধরা পড়ছে৷ দুর্নীতির গায়ে নরেন্দ্র মোদির সরকার স্পর্শও করেনি শুধু নয়, তা আজ আকাশ ছুঁয়েছে৷ সীমান্তে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ এখন নিত্য দিনের ঘটনা৷ মাঝখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগে ঠেলে দিয়েছে৷ পরবর্তী কয়েক মাসে কার্যত তছনছ হয়ে গেছে দেশের ছোট ব্যবসায়ীদের বড় অংশের কারবার৷ নগদের অভাবে কাঁচামাল পেতে হিমশিম খেতে হয়েছে তাঁদের৷ সমস্যায় পড়তে হয়েছে কর্মীদের বেতন মেটাতে৷ ফল হিসাবে ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে অসংখ্য ছোট সংস্থার, এখনও ধুঁকছে বহু সংস্থা৷ পরিণামে কাজ হারিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ৷ ভারতীয় অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পক্ষেত্র দু’বছর বাদেও নোট বাতিলের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি৷ এ সবই প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন৷ তাই জনগণের সামনে নোট বাতিলের কথা এমনকী তুলতেও আর সাহস হয়নি৷

কয়েক মাস আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তাদের রিপোর্টে জানিয়ে দিয়েছে, বাতিল হওয়া নোটের ৯৯.৩ শতাংশই ব্যাঙ্কগুলিতে ফিরে এসেছে৷ সরকার বলেছিল, বাতিল হওয়া নোটের তিন লক্ষ কোটি টাকা ফিরবে না, যা আসলে কালো টাকা– নোট বাতিলের ফলে সেটাই হবে সরকারের লাভ৷ বাস্তবে ফেরেনি মাত্র ১০,৭২০ কোটি টাকা৷ আর নোট বাতিলের কারণে নোট ছাপতে সরকারের খরচ হয়েছে ১২,৮৭৭ কোটি টাকা৷ অর্থাৎ কালো টাকা যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই আছে৷ তা হলে সরকার কি জানত না, কালো টাকার কারবারি, বড় বড় শিল্পপতি, পুঁজিপতি, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক দলের নেতা, তারা কেউ কালো টাকা বাড়িতে নগদে জমিয়ে রাখে না? জমি–বাড়ির ব্যবসায় খাটায়, সম্পত্তি, সোনা কিনে রাখে, শেয়ার বাজারে খাটায়, ভুঁইফোড় আর্থিক সংস্থায় বিনিয়োগ করে? বিরাট একটা অংশ ব্যাংক কিংবা হাওয়ালার মাধ্যমে বিদেশে পাচার করে দেয়? তখনই সংবাদে প্রকাশ পেয়েছিল, নোট বাতিলের ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রীর বত্তৃণতা শেষ হওয়ার আগেই পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা হাওয়ালায় বুকিং হয়ে গেছে৷ সেদিন মধ্যরাত পর্যন্ত সোনার দোকানগুলিতে ভিড় করে এরা সোনা কিনছে৷ এমনকী আগের দিনের তারিখে বিল কেটেও সোনা বিক্রি করা হয়েছে৷ দেশ জুড়ে সেদিন কয়েক ঘন্টায় হাজার হাজার কোটি টাকার সোনার গহনা বিক্রি হয়েছে৷ এ সব কোনও কিছুই বিজেপি নেতাদের অজানা নয়৷ বুঝতে অসুবিধা হয় কি, নোট বাতিলের উদ্দেশ্য কালো টাকা উদ্ধার ছিল না?

এই নেতা–মন্ত্রীরা ভালো করে জানেন, কালো টাকা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মনে প্রবল ক্ষোভ রয়েছে৷ মানুষ তাদের চারপাশে এমন অসংখ্য কালো টাকার কারবারি এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের দেখে, যারা তাদের মতো সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম না করেও অনায়াসে ভোগবিলাসের জীবন যাপন করে৷ এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েই প্রধানমন্ত্রী নোট বাতিলের উদ্দেশ্য হিসাবে কালো টাকা উদ্ধার এবং দুর্নীতি দূর করার গল্প শুনিয়ে তাদের বোকা বানাতে চেয়েছিলেন৷ সাময়িক ভাবে হলেও কিছু মানুষ প্রধানমন্ত্রীর গল্পে বিশ্বাস করেছিলেন এবং এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিলেন৷

সেদিন এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) প্রথম থেকেই সরকারের নোট বাতিলের ঘোষণার তীব্র বিরোধিতা করে একে জনগণের সাথে এক বিরাট প্রতারণা বলে ঘোষণা করেছিল৷ যখন কোনও দল প্রকাশ্যে এই প্রতারণার বিরোধিতা করতে পারেনি তখন এস ইউ সি আই (সি) তার বক্তব্য লিফলেট আকারে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়ানো মানুষের মধ্যে বিলি করেছে৷ মিছিল করেছে, পথসভা করে এর প্রতারণার নানা দিকগুলি তুলে ধরেছে৷ ১৪ নভেম্বর এস ইউ সি আই (সি)–ই প্রথম রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ সংগঠিত করেছে, এই ধাপ্পাবাজির স্বরূপ জনসাধারণের সামনে তুলে ধরেছে৷ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরদিন ৯ নভেম্বর দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি এবং তার সেবকরাই কালো টাকার জন্ম দেয় এবং তারাই এর সুবিধাভোগী শ্রেণি৷ সরকার যেহেতু তাদেরই গোলামি করে, তাই তাদের বিরুদ্ধে কখনও কোনও পদক্ষেপ গ্রহণের প্রশ্নই ওঠে না৷’’ তাতে বলা হয়েছে, এই মূল দোষীদের না ধরে, না শাস্তি দিয়ে, বে–নামে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত কালো টাকার পাহাড় উদ্ধার না করে, রাতারাতি নোট বাতিলের এই সিদ্ধান্ত আসলে সস্তা চমক দিয়ে জনসাধারণকে বোকা বানানো ছাড়া কিছু নয়৷ এর দ্বারা জনগণের একটা বড় অংশকে যেমন বিভ্রান্ত করা যাবে তেমনি সরকারের শয়তানিকে আড়াল করে নির্বাচনী ফায়দা ওঠানোর রাস্তা পরিষ্কার করে, খেটে খাওয়া মানুষকে আরও দুর্দশার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হবে৷ দলের এই বক্তব্য আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে৷

গত দু’বছরের অভিজ্ঞতায় বিজেপি নেতাদের এই প্রতারণা মানুষের কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট৷ এ–ও স্পষ্ট যে, সরকারের উদ্দেশ্য কালো টাকা নির্মূল করা বা দুর্নীতি দূর করা ছিল না৷ উদ্দেশ্য ছিল, কালো টাকার মালিকদের টাকা সাদা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা৷ দেশের পুঁজিপতিরা বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়ে তা শোধ না করায় ব্যাঙ্কগুলিতে পুঁজির যে মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছিল, জনগণকে তাদের জমানো ন্যূনতম অর্থও ব্যাঙ্কে জমা করতে বাধ্য করে সেই সংকট কাটানো৷ বাজার সংকটে জর্জরিত দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবসায় মুনাফা করার ব্যবস্থা করে দিতে জনগণকে ক্যাশলেস বিনিময় পদ্ধতিতে ঢুকতে বাধ্য করা৷ অর্থমন্ত্রীর বিবৃতিতে সে উদ্দেশ্যই স্পষ্ট হয়েছে৷ বিল গেটসের মাইক্রোসফট কোম্পানি কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপের প্রযুক্তি বেচে৷ আম্বানিদের রিলায়েন্স জিও, টাটাদের ডোকোমো, মিত্তালদের এয়ারটেল, ব্রিটেনের ভোডাফোন বা নানা ব্রডব্যান্ড কোম্পানিতে খাটছে দেশি বিদেশি পঁুজির বিপুল বিনিয়োগ৷ এরা ফোনের সাথে করে ইন্টারনেটের ব্যবসা৷

এছাড়া নানা ধরনের সরকারি বেসরকারি ব্যাঙ্ক, বেশ কিছু বেসরকারি ফিনান্স কোম্পানি এই সুযোগে তাদের ব্যবসাবৃদ্ধি করছে৷ ডেবিট–ক্রেডিট কার্ড, পেটিএম, মোবি–কুইক ইত্যাদি মোবাইল ওয়ালেট, ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং এই রকম কোম্পানিগুলোর মাধ্যমেই চলে৷ প্রতিটি লেনদেনে এদের ঘরে টাকা জমা পড়ে, যা আসে সাধারণ মানুষের ঘাড় ভেঙেই৷ এই সব দেশি–বিদেশি পুঁজিপতির দল তাই নরেন্দ্র মোদির নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে দু–হাত তুলে সমর্থন করেছিল৷ অনেকেরই মনে আছে পেটিএমের বিজ্ঞাপনে নজিরবিহীন ভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখ দেখা গিয়েছিল৷ উল্লেখ্য, পেটিএমের মালিক বিজয়শেখর শর্মা ভারতের সবচেয়ে কম বয়সি বিলিওনেয়ার, যিনি মোদির অত্যন্ত প্রিয়পাত্র৷ মোদি রাজত্বে শুধু মাত্র এক বছরে মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি বেড়েছে ৬৭ শতাংশ, আজিম প্রেমজির ৫০০ শতাংশ৷ এমনই হারে বেড়েছে অন্য পুঁজিপতিদেরও সম্পত্তি৷ এই পুঁজিপতির দলই ২০১৪ সালে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মোদির হয়ে প্রচারে নেমেছিল৷ ক্ষমতায় গিয়ে মোদি এবং বিজেপি নেতারা জনগণের ঘাড় ভেঙে সেই ঋণের বহু গুণ পুষিয়ে দিয়েছে৷ নোট বাতিল ছিল সেই পুষিয়ে দেওয়ারই অন্যতম কার্যক্রম!

(৭১ বর্ষ ১৪ সংখ্যা ১৬ – ২২ নভেম্বর, ২০১৮)