দেশবন্ধুর মতো মহৎ চরিত্র চাই

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ নামটি শুনলেই অন্তরের অন্তস্তল থেকে এক গভীর শ্রদ্ধা উঠে আসে৷ তাঁর হৃদয়ের গভীরতার টানে আকৃষ্ট হয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু৷ মেনে নিয়েছিলেন তাঁকে নেতা হিসেবে৷ তাঁর মৃত্যুর পর মান্দালয় জেলে বসে দেশবন্ধুর জীবনচরিত লেখক শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে নেতাজি লিখেছিলেন, ‘…যাহাদিগকে আমরা সাধারণত ঘৃণায় ঠেলিয়া ফেলি, তিনি তাহাদিগকে বুকে টানিয়া লইতেন৷…যাহারা তাঁহার পাণ্ডিত্যের নিকট মাথা নত করেন নাই, অসাধারণ বাগ্মিতায় বশীভূত হন নাই, বিক্রমের নিকট পরাজয় স্বীকার করেন নাই, অলৌকিক ত্যাগে মুগ্ধ হন নাই, তাহারা পর্যন্ত এই বিশাল হৃদয়ের দ্বারা আকৃষ্ট হইয়াছিলেন৷ …’

মাতৃভূমির মুক্তির জন্য তিনি নিজেকে নিঃস্ব করে দান করেছিলেন৷ নিজের বসতবাডি পর্যন্ত নিজের জন্য না রেখে তিনি জাতির উদ্দেশে দান করে যান৷ নিজের জন্য কোনও কিছু না রেখে তিনি যে সবকিছু দান করে নিঃস্ব হয়েছিলেন, সেই জন্য সে যুগে চারিদিকে শুধু একটাই কথা ধ্বনিত হত– চিত্তরঞ্জন সব দান করেছেন৷ একটি ঘটনা উল্লেখ করি৷

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের দুই পণ্ডিত তারাপ্রসন্ন কাব্যতীর্থ এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন৷ কাব্যতীর্থ মশায় বললেন, দেশবন্ধু যথাসর্বস্ব দান করে ফেলেছেন, ওর পুঁথিগুলো পেলে সাহিত্য পরিষদের বড় উপকার হয়৷ হরপ্রসাদবাবু বললেন, তা বুঝলাম কিন্তু ভদ্রলোক হাজার হাজার টাকা খরচ করে এসব বই সংগ্রহ করেছেন৷ তার বড় শখের এই পুঁথি৷ মানুষ সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারেন কিন্তু শখের জিনিস কি কেউ ত্যাগ করতে পারেন? কাব্যতীর্থ মশায় তবুও বললেন, একবার তার কাছে গিয়ে চেষ্টা করে দেখা যাক না৷ কাব্যতীর্থ মশায়ের সাথে একমত না হয়েও শাস্ত্রী মশায় এবং তিনি চিত্তরঞ্জনের বাড়ি গেলেন৷ চিত্তরঞ্জন কী একটা কাজ করছিলেন৷ তখন ওরা বললেন, সাহিত্য পরিষদ থেকে এসেছি আমরা৷ একটু হাসলেন চিত্তরঞ্জন৷ বললেন, কিন্তু সাহিত্য পরিষদের কাজে লাগে এমন কিছুই তো আর দান করার মতো আমার অবশিষ্ট নেই৷ শাস্ত্রী মশায় তখন একটু দ্বিধা করে বললেন, আপনার ওই বইগুলো যদি পরিষদকে দান করেন তবে পরিষদের বড উপকার হয়৷ খুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে উঠলেন চিত্তরঞ্জন৷ বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ– আপনি ঠিক কথাই তো মনে করিয়ে দিয়েছেন, সেগুলো তো আছেই৷ এই বলে চিত্তরঞ্জন বইয়ের আলমারিগুলোর সব চাবি পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশায়ের হাতে তুলে দিলেন এবং বললেন, যা যা দরকার সব নিয়ে যান৷

সত্যি নিজেকে উজাড করে দিয়েছিলেন তিনি দেশমাতৃকার চরণে৷ দেশবন্ধু পরম ঈশ্বর বিশ্বাসী ধার্মিক হয়েও আধ্যাত্মিক মুক্তি সাধনায় নিজেকে নিযুক্ত করেননি৷ মাতৃভূমির রাজনৈতিক মুক্তির জন্য সমগ্র জীবনব্যাপী বীর সৈনিকের মতোই তিনি যুদ্ধ করে গেছেন৷ আগলে রেখেছিলেন সে যুগের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ উৎসর্গ করতে আসা তরুণ–যুবকদের৷

দেশবন্ধু সব সময় চেষ্টা করতেন হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যেন পারস্পরিক প্রীতি–ভালবাসা জাগরিত হয়৷ তিনি হিন্দু ধর্মকে এত ভালোবাসতেন যে তার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলেন অথচ তাঁর মধ্যে গোঁড়ামি আদৌ ছিল না৷ সেই জন্য তিনি ইসলামকেও ভালবাসতে পারতেন৷ নেতাজি বলেছিলেন, ‘আমি জিজ্ঞাসা করি কয়জন হিন্দু নায়ক বুকে হাত দিয়া বলিতে পারেন তাহারা মুসলিমকে আদৌ ঘৃণা করেন না? কয়জন মুসলিম জননায়ক বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন তাহারা হিন্দুকে ঘৃণা করেন না?…কিন্তু তাঁহার বুকের মধ্যে সকল ধর্মের লোকের স্থান ছিল৷’

দেশবন্ধুর ১৫০তম জন্মবর্ষে দাঁড়িয়ে দেশের বর্তমান নেতাদের দেখলে শুধু এই কথাই আমাদের মনে হয়, যারা নিজের সম্পত্তি বৃদ্ধির জন্য মানুষ ঠকিয়ে রাজনীতি করেন তারা মানুষের কোন মঙ্গল আনতে পারেন? মানুষের জন্য কী ভাল করতে পারেন? সাধারণ মানুষ আজ এইসব ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি বীতশ্রদ্ধ৷ আজ প্রয়োজন দেশবন্ধুর মতো বড় চরিত্র সৃষ্টির রাজনীতির চর্চা৷ কারণ মহৎ চরিত্রের চর্চা ছাড়া মানুষের বড় চরিত্র গড়ে উঠতে পারে না৷ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের হৃদয়ের স্পর্শে সুভাষচন্দ্র ‘নেতাজি’ হয়েছিলেন৷ তাঁর প্রতি রইল আমার বিনম্র শ্রদ্ধা৷

গৌতম দাস, মালদা

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১৫ সংখ্যা)