দেরি করলে বাড়বে ক্ষতির বহর

টালবাহানার যেন শেষ নেই দু’বছর ধরে টালবাহানা চালিয়ে অবশেষে ‘শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯’ সংশোধন করে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাশ–ফেল চালুর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করল৷

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রাজ্যগুলি এ ব্যাপারে তাদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে৷ অর্থাৎ শিক্ষা আইনের ‘নো ডিটেনশন পলিসি’ বা পাশ–ফেল প্রথা খারিজ করার ধারাটি আন্দোলনের চাপে দেশব্যাপী বাতিল হল৷ ওড়িশা সরকারও ঘোষণা করেছে তারা এই শিক্ষাবর্ষ থেকেই পাশ–ফেল চালু করছে৷ অথচ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মন্তব্য করেছেন, এই ব্যাপারে তাড়াহুড়োর কোনও প্রয়োজন নেই৷

শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে যেহেতু আগামী বছর থেকে পাশ–ফেল চালুর কথা উল্লেখ রয়েছে, তাই তাঁরাও আগামী বছরেই সিদ্ধান্ত নেবেন৷ কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে এক বছর দেরি করা কেন? রাজ্যের শাসকদল উঠতে বসতে কেন্দ্রীয় সরকারের নানা বিষয়ে তাদের ভিন্নতা প্রকাশ করে আগামী লোকসভা নির্বাচনে মোদি সরকারকে পরাস্ত করার জন্য বিগ্রেডে মহা সমাবেশের আয়োজন করল৷ সেই দলের শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষা যুগ্ম তালিকাভুক্ত এ কথা জানা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় বিজ্ঞপ্তিকেই ‘গুরু বাক্য’ হিসাবে গ্রহণ করেছেন– এটা আশ্চর্যের বিষয় নয় কি?

২০১৭ সালের ১৭ জুলাই পাশ–ফেল চালুর দাবিতে রাজ্যব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল এস ইউ সি আই (সি)৷ ধর্মঘটের সমর্থনে জনমত ব্যাপক আকার নিলে, ধর্মঘটের কয়েকদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী এস ইউ সি আই (সি) নেতৃত্বকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, তাঁরা এই দাবির সাথে সহমত পোষণ করেন৷ কেন্দ্রীয় আইনটি পরিবর্তিত হলেই তাঁরা বুনিয়াদি স্তর থেকেই পাশ–ফেল চালু করবেন৷ এস ইউ সি আই (সি) নেতৃত্ব সেদিন শিক্ষামন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতির কথা রাজ্যের জনগণকে জানিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছিল৷ ক’দিন আগেও এস ইউ সি আই (সি) নেতারা যখন একই দাবি নিয়ে বিধানসভায় শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখা করলেন, তখনও তিনি বলেছিলেন, আমরা তো রেডি, শুধু আইনটা পাশ হলেই হল৷ তা হলে আজ যখন আইনের বাধা আর নেই, তখন এই সিদ্ধান্তকে অহেতুক এক বছর পিছিয়ে আরও অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর সর্বনাশ করা কেন? কোন শ্রেণি থেকে তা কার্যকরী হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে চলা কেন? এটা জনগণ সম্পর্কে সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় নয় কি?

২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর রাজ্য সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষক সংগঠনগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে একটা বৈঠক করেছিল৷ সেই বৈঠকে কেবল সিপিএম এবং তার শিক্ষক সংগঠন ছাড়া সকলেই প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেল ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিল৷ তারপরও এই ধোঁয়াশা নিয়ে চলা কেন? এখনও ‘বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে’ বলে অযথা কালক্ষেপ কার কেন?

পাশ–ফেল তো শুধু বছরের শেষে উপরের ক্লাসে ওঠা বা একই ক্লাসে থেকে যাওয়া নয়৷ পাশ–ফেল শিক্ষা পরিচালনায় বহু পরীক্ষালব্ধ একটা নীতি, যা শিক্ষণ ও শিক্ষার মূল্যায়নের একটা সূচক৷ এটা যেমন বিষয় পাঠে শিক্ষার্থীদের সচেতন ও আগ্রহী করে তোলে, তেমনি শিক্ষাদাতাদেরও তাদের কর্তব্যের প্রতি দায়িত্বশীল করে৷ এই নীতি না থাকার ফলে মূল্যায়নপত্রটি একটা অকার্যকরী বিষয়ে পর্যবসিত হয়৷ যার উপরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হয়নি তাকেই উপরের শ্রেণিতে তুলে দিয়ে তার শিক্ষার ভিত্তিটাকে আরও দুর্বল করে দেওয়া হয়৷ আরও একটি বছর ধরে এই অবাধ প্রোমোশন নীতি চলতে থাকলে আরও লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ সর্বনাশের মুখে পড়বে৷ রাজ্য সরকার জেনেশুনেও এই সর্বনাশ করছে কাদের স্বার্থ রক্ষা করতে!

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ২৫ সংখ্যা)