ত্রিপুরার নির্বাচনী ফলাফল : একটি পর্যালোচনা

70 Year 30 Issue 16 March 2018

বিজেপি নাকি ‘ঢেউ’ তুলেছে? অন্তত উত্তর–পূর্বের তিন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের পর তাদের প্রচার তাই বলছে বিজেপি জেতার পর ত্রিপুরা জুড়ে মহান লেনিনের মূর্তি ভেঙে অন্যান্য দলের কর্মী–নেতাদের উপর আক্রমণ করে ব্যাপক সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করেছে তারা৷ জার্মানিতে হিটলারের ফ্যাসিস্ট স্টর্ম ট্রুপারস বাহিনী যে কায়দায় বিরোধীদের গলা টিপে ধরত, আদর্শগত দিক থেকে দেউলিয়া বিজেপিরও সেই বর্বরতা আর তাণ্ডবই সম্বল৷ এই দিয়েই তারা জনগণকে অনুগত রাখতে চায়৷ তাণ্ডব শুধু ত্রিপুরাতেই নয়, উৎসাহিত আরএসএস–বিজেপি এবার দেশ জুড়ে মূর্তি ভাঙতে নেমে পড়েছে৷ পেরিয়ার, আম্বেদকর, গান্ধী মূর্তি ভেঙেছে কালি মাখিয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মূর্তিতে৷ অর্থাৎ আরএসএসের ছাঁচে না মিললেই তার উপর চলবে আক্রমণ, এই বার্তাই সম্বল বিজেপির৷ কোথায় সুশাসন? এই জন্যই কি মানুষ তাদের ভোট দিয়েছে?

প্রশ্ন উঠেছে, যে বিজেপি তার চার বছরের কেন্দ্রীয় শাসনেই সারা দেশে সাধারণ মানুষের ধিক্কার কুড়োচ্ছে, ব্যাঙ্ক জালিয়াতদের সাথে যে দলের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে, তারা হঠাৎ তথাকথিত ‘ঢেউ’ তুলে ফেলল কী করে? যদিও বাস্তব হল মেঘালয়তে বিজেপির প্রাপ্তি মাত্র দুটি আসন, নাগাল্যান্ডে বিজেপি আদৌ একক শক্তিতে লড়ার জায়গাতেই নেই৷ কিন্তু এইসব তথ্য চাপা দিয়ে ত্রিপুরাতে তাদের ৩৫টি আসনকে দেখিয়েই হই–হই করে সারা উত্তর–পূর্বের ‘ওয়েভ’ বলে প্রচার করে চলেছেন বিজেপির ছোট–বড় নেতা থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং৷ ত্রিপুরায় বিজেপি জিতেছে কি মানুষ তাদের ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছে বলে? নাকি সিপিএম সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের সুযোগ নিয়েছে বিজেপি

ভারতের যে কোনও ভোটে বর্তমানে একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জনগণ এখন কাউকে জেতানোর জন্য ভোট দেয় না, ভোট দেয় ক্ষমতাসীন সরকারি দলকে হারাতে৷ আবার কিছুদিন বাদে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ভোট দেয় অন্য কাউকে৷ ত্রিপুরাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ সিপিএমের দীর্ঘ অবাম শাসনে তিতিবিরক্ত জনগণ অন্য কোনও বিকল্প না পেয়ে ভোট দিয়েছে বিজেপিকে৷

এই বিজেপি কারা? ত্রিপুরায় বিজেপি মানে হল ভোটের সামান্য কিছুদিন আগে পর্যন্ত যারা কংগ্রেসের ঘর আলো করে বসেছিলেন সেই সব ধুরন্ধর নেতারা৷ যারা লক্ষ লক্ষ টাকা, কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় থাকা বিজেপির দেওয়া নানা টোপের প্রলোভনে বিজেপিতে গিয়ে ভিড়েছেন৷ কিছুদিন আগে এদের অনেকে তৃণমূল কংগ্রেসেও ভিড়েছিলেন৷ তারপর সুযোগ বুঝে আবার ডিগবাজি দিয়েছেন৷ ভোটের ফলে বিজেপির কেন্দ্রীয় কিছু নেতার ম্যাজিক দেখানোর যে সব গালগল্প সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে বাস্তবটা আদৌ তার ধারে কাছে নেই৷ 

১৯৭৮ থেকে ২০১৮ এই ৪০ বছরের মধ্যে ৩৫ বছর সিপিএম ছিল ত্রিপুরার ক্ষমতায়৷ মাঝে পাঁচ বছর ছিল কংগ্রেস৷ এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারেও কংগ্রেস, বিজেপি ইত্যাদি দলগুলি পালা করে ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু উত্তর–পূর্বাঞ্চলের এই ক্ষুদ্র রাজ্যের জনজীবনের উন্নয়নের প্রশ্নটি অবহেলিতই থেকে গেছে৷ শিল্প প্রায় গড়েই ওঠেনি, কৃষিব্যবস্থা থেকে গেছে প্রায় মান্ধাতার আমলে৷ রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিবহণের হাল অত্যন্ত শোচনীয়৷ বিদ্যুৎ পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ৷ জ্বালানি এবং খাদ্যদ্রব্যের দাম এমনিতেই অন্য রাজ্যের থেকে বেশি, তার উপর এই দাম অনেকটাই নির্ভর করে প্রভাবশালী এবং সুযোগসন্ধানী ফাটকাবাজ ব্যবসায়ীদের উপর৷ কংগ্রেসের যে নেতারা বর্তমানে বিজেপিতে ভিড়েছেন তাদের অনেকেই ফাটকাবাজিতে যুক্ত৷ বেকার সমস্যা অত্যন্ত তীব্র৷ মুনাফার দৃষ্টিতে রেলকে দেখার ফলে ত্রিপুরা সহ উত্তর–পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রডগেজ রেল লাইন নিয়ে সব দলের কেন্দ্রীয় সরকারই টালবাহানা চালিয়ে গেছে৷ অবশেষে দীর্ঘ সময় পর ব্রডগেজ লাইন বসলেও রেল চলাচল অত্যন্ত অনিয়মিত৷ রেল যোগাযোগকে দীর্ঘদিন দুর্বল করে রাখার কাজে প্রভাবশালী ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কেন্দ্র–রাজ্যের কেষ্ট–বিষ্টুদের যোগাযোগও সর্বজনবিদিত৷ তাদের মধ্যে অনেকেই কংগ্রেসের নেতা ছিলেন, এখন বিজেপি হয়েছেন৷ এই হল বিজেপির ‘পার্টি উইথ এ ডিফারেন্সে’র (অন্য রকম দল) চরিত্র৷

ক্ষমতায় থেকে সিপিএম স্লোগান দিয়েছে উন্নয়নের নামে৷ অথচ রাজ্যের সাধ্যের মধ্যে থাকা কাজগুলি তো করেইনি বরং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ত্রিপুরার উন্নয়নের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য গণআন্দোলন গড়ে তোলারও চেষ্টা করেনি৷ আর পাঁচটা বুর্জোয়া দলের মতোই মানুষের অভাব, দারিদ্র, অনুন্নয়নকে তারা ব্যবহার করতে চেয়েছে কিছু কিছু পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে দলীয় স্বার্থসিদ্ধির কাজে৷ যে কোনও সরকার বিরোধী বিক্ষোভকে গায়ের জোরে দমন করতে সরকারি টাকা ব্যবহার করে সমাজবিরোধী ও মাফিয়াদের সঙ্গে প্রশাসনের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে এবং এইভাবে মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে চেয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গে যে কায়দাতে তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রেখেছিল তার একেবারে হুবহু কপি দেখা গেছে ত্রিপুরাতে৷

ত্রিপুরার জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশের বেশি আদিবাসী৷ তাদের শোচনীয় আর্থিক পরিস্থিতি থেকে একটু স্বস্তি দেওয়া, পশ্চাদপদতা দূর করা, আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো– এই সমস্ত কাজের বদলে সিপিএম ব্যস্ত থেকেছে আদিবাসী এবং অ–আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজনকে খুঁচিয়ে তুলে জনগণকে বিভক্ত রাখার চেষ্টায়৷ বামপন্থী আদর্শে সমস্ত জনগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার কোনও চেষ্টাই তারা করেনি৷ এর সুযোগে ত্রিপুরায় বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মাথা চাড়া দিতে পেরেছে এবং আদিবাসীদের স্বার্থরক্ষার চ্যাম্পিয়ান সাজা একদল স্বার্থান্বেষীর হাতে আদিবাসীদের সঁপে দেওয়া হয়েছে৷ আদিবাসী ভোটের দিকে তাকিয়ে সিপিএম ত্রিপুরা ট্রাইবাল অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল গঠন করলেও তাদের হাতে কোনও স্বায়ত্তশাসন দেয়নি৷ সিপিএম সরকার ককবরক, ত্রিপুরি ইত্যাদি ভাষাকে দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিলেও তার অগ্রগতির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি৷ একদল আদিবাসীকে আর একদলের সঙ্গে লড়িয়ে দিতে রিয়াঙ্গা, জামাতিয়াদের সঙ্গে বরক, নাগা ইত্যাদিদের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাতে চেয়েছে তারা৷ ১৯৯০ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এনএলএফটি–র হিংসাত্মক কার্যকলাপের অজুহাতে অন্য বুর্জোয়া সরকারের মতোই দানবীয় আফস্পা আইন ত্রিপুরায় চালু করতে উদ্যোগী হয়েছে৷ অন্যদিকে গোমতি নদী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসীদের পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা দূরে থাক, নতুন চর এলাকায় বসতি স্থাপনের ব্যাপারে তারা বাঙালি সেন্টিমেন্টের কারবারি হয়ে ভোটব্যাঙ্ক নিশ্চিত করতে চেয়েছে৷ সিপিএম বিজেপির কায়দাতেই কল্পিত হাজার হাজার অনুপ্রবেশ হচ্ছে বলে বিতর্ক তুলেছে যাতে উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালি ভোট ব্যাঙ্ককে কব্জা করা যায়৷ সিপিএমের বড় অংশের নেতা–কর্মীরা জাতপাত ধর্মবর্ণের বিভাজন মুছে দেওয়ার প্রশ্নে সঠিক মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে চলা এবং এইসব সেন্টিমেন্টের ঊর্ধ্বে ওঠার বদলে নিজেরাই বাঙালি, উপজাতি এইসব সেন্টিমেন্টের শিকার৷ তাদের প্রশাসনের আমলারাও মূলত উচ্চবর্ণের এবং বাঙালি জাত্যভিমানের ভিত্তিতেই চলার ফলে বিজেপির বিভাজনের রাজনীতির জমি তৈরি হয়েই ছিল৷ বিজেপি এর ফলে একদিকে আদিবাসী ক্ষোভকে কাজে লাগাতে পেরেছে৷ অন্যদিকে হিন্দু বাঙালি ভোটব্যাঙ্ককে সিপিএমেরই তোলা ‘অনুপ্রবেশের’ জুজু দেখিয়ে মেরুকরণ করতে পেরেছে৷ সিপিএম বামপন্থাকে বিসর্জন দিয়ে সংসদীয় ক্ষমতার রাজনীতির লাইন নিয়ে বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির পাতে খাবার বেড়ে দিয়েছে৷ এর সঙ্গে, বৃহৎ পুঁজিপতিদের আশীর্বাদ বিজেপির দিকে বেশি ছিল, কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সরাসরি সাহায্য তারা পেয়েছে, রাজ্যের আমলাকুলের বড় অংশ মেরুকরণের এই রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক হিসাবে কাজ করায় বিজেপির সুবিধা হয়েছে৷ তাছাড়া উগ্র মেরুকরণের কৌশলে বিজেপি সিপিএমের তুলনায় বেশি দক্ষ, টাকার জোরও তাদের বেশি, ফলে স্রোতের মতো টাকা ঢেলে তারা ভোট কিনেছে৷ মাসল পাওয়ারকেও এই পথে কব্জা করেছে৷ ফলে ভোট রাজনীতিতে তারা সাফল্য পেয়েছে বেশি৷ অন্যদিকে আদিবাসী নেতার তকমা এঁটে ধুরন্ধর স্বার্থান্বেষীরা যখন দেখেছে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আশীর্বাদ পেলে তাদের লাভ বেশি– তারা বিজেপির দিকে ঢলে পড়েছে৷ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে কীভাবে বিএসএফের অফিসার এবং আরএসএস নেতারা যৌথভাবে উগ্র জাতিবাদীদের অস্ত্র শিক্ষা দিয়েছে, যাতে তারা সাধারণ আদিবাসী এবং অ–আদিবাসী গরিব মানুষের উপর দাপট ধরে রাখতে পারে৷ আমলা, কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনীর সাহায্যে পেশিশক্তির জোরেই বহু জায়গাতে ভোট করেছে বিজেপি৷ বামপন্থার পথ পরিত্যাগ করার ফলে সিপিএম তার বিরুদ্ধে নৈতিক শক্তি নিয়ে কর্মীদের দাঁড় করানোর চেষ্টাটুকুও করতে পারেনি৷

উচ্চবর্ণের হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির কারবারি বিজেপি দেশের নানা জায়গায় তথাকথিত নিম্নবর্ণ এবং দলিত সম্প্রদায়ের উপর বারবার আক্রমণ চালাচ্ছে৷ এই বিজেপির হাতে আদিবাসী জনগোষ্ঠী কি আদৌ নিরাপদ থাকতে পারে? বিজেপির ইতিহাসই হচ্ছে ধর্ম–বর্ণ–জাতপাতে ভিত্তিতে দাঙ্গা বাধানোর ইতিহাস৷ তারা ত্রিপুরাতেও এই বিভাজনের ভিত্তিতেই ভোট পেয়েছে৷ বিজেপির সর্বনাশা রাজনীতিকে ঠেকাতে গেলে যেখানে যথার্র্থ বামপন্থার পথে আদিবাসী, বাঙালি থেকে শুরু করে সমস্ত শোষিত নিপীড়িত মানুষের ঐক্যের ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার, সিপিএম সেই রাস্তার কথা এখনও ভাবতে পারছে না৷ বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে সেক্যুলার তকমা দিয়ে সিপিএম তাদের সাথে হাত মিলিয়ে আবার পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরার মসনদ ফিরে পেতেই আগ্রহী৷ সৎ বিবেকবান সিপিএম কর্মী যাঁরা বামপন্থার স্বপ্ন দেখেই সিপিএমের সাথে থেকেছেন, তাঁদের বুঝতে হবে কংগ্রেসের মতো দল কোনও দিন যথার্থ সেক্যুলার রাজনীতির চর্চা করতে পারে না শুধু তাই নয়, বহু দাঙ্গার জন্য তারাই দায়ী৷ ত্রিপুরাতেও বহু রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার পিছনে কংগ্রেসের মদত ছিল৷ বামপন্থা বিসর্জন দিয়ে তাদের হাত ধরলে বিজেপির উত্থানের জমি আরও উর্বর হয়ে উঠবে না কি? বিজেপির মতো একটি জনবিরোধী শক্তির উত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেলে কোনও নতুন নির্বাচনী কৌশল নয়, সঠিক বামপন্থার পথে জনগণের দাবি নিয়ে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ একই সাথে বিজেপির পুঁজিবাদী এবং সাম্প্রদায়িক উভয় চরিত্রের বিরুদ্ধে তীব্র মতবাদিক সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে৷