তেলেঙ্গানা বিদ্যুতের দাম কমাতে পারলে পশ্চিমবঙ্গ পারবে না কেন?

বিদ্যুৎ আজ সভ্যতার চালিকাশক্তি৷ সেই কারণেই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিদ্যুতের ব্যবহার বর্তমানে উন্নয়নের চাবিকাঠি৷ কিন্তু মূল কথা হল, এই বিদ্যুৎ দেশের সাধারণ মানুষ আদৌ ব্যবহার করতে পারছে কি না৷ অর্থাৎ এটি সুলভ কি না৷ তথ্য বলছে, বিদ্যুতের দাম বা মাশুল সারা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই সর্বোচ্চ৷ পশ্চিমবঙ্গ নদীমাতৃক রাজ্য– জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পক্ষে খুবই উপযুক্ত৷ এ রাজ্যে কয়লা খনিও অনেক এবং কয়লার গুণমানও ভাল৷ তাই তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় অন্য রাজ্যের তুলনায় কম৷ কিন্তু বিদ্যুৎ মাশুলের বেলায় উল্টো৷ এখানে মাশুলের হার আগের সিপিএম–ফ্রন্ট সরকারের আমলেই ছিল সর্বাধিক, বর্তমান তৃণমূল সরকারও সেই ধারা বজায় রেখেছে৷ কেন? এর সদুত্তর উভয় সরকারই সযত্নে এড়িয়ে যায়৷

বিদ্যুৎ মাশুলের প্রশ্নটা জীবন–জীবিকার সাথে কত গভীর ভাবে সম্পর্কিত, দিনে দিনে তা প্রকট হয়ে উঠছে৷ যে কৃষকসমাজ সকলের খাদ্য জোগায়, তার কী দুরবস্থা– তা কহতব্য নয়৷ কৃষির আনুষঙ্গিক দ্রব্যগুলি দেশি–বিদেশি কর্পোরেটদের কুক্ষিগত হওয়ার ফলে উৎপাদন ব্যয় বিপুল হারে বেড়ে গেছে৷ অথচ ওই কর্পোরেট মালিকদের কৌশলেই কৃষককে উৎপাদিত ফসল জলের দরে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে৷ ফলশ্রুতিতে রাজ্যে রাজ্যে বেড়ে চলেছে ঋণগ্রস্ত কৃষকদের মৃত্যু কিংবা আত্মহত্যার মিছিল৷ এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক বিক্ষোভ ফেটে পড়ছে৷ এমনকী প্রতিকারের দাবিতে সোচ্চার কৃষক–কণ্ঠ কাঁপিয়ে দিয়েছে রাজধানী দিল্লিকে৷ বিভিন্ন রাজ্য সরকার এই চাপে বাধ্য হচ্ছে কিছু না কিছু ব্যবস্থা নিতে৷ সম্প্রতি তেলেঙ্গানা সরকার কৃষক পরিবারের জন্য বিজ্ঞাপন জারি করে কতকগুলি প্রকল্প ঘোষণা করেছে (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০–৫–১৮)৷ ৫৮ লক্ষ কৃষক পরিবারকে ১ কোটি ৪২ লক্ষ একর জমির জন্য একর পিছু বার্ষিক ৮০০০ টাকা করে সহায়তা প্রদান করা শুরু হয়েছে ওই দিন থেকেই৷ এই কারণে ২০১৮–’১৯–এর বাজেটে ১২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে তেলেঙ্গানা রাজ্য সরকার৷ এছাড়া তারা ২০১৮–র ১ জানুয়ারি ওই পত্রিকার প্রথম পাতায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘোষণা করেছিল, কৃষিবিদ্যুৎ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ২৪ ঘন্টা সরবরাহ করা হচ্ছে বলে৷ এ দিনের বিজ্ঞাপনে ওই সিদ্ধান্তের পুনরুল্লেখ করে জানানো হয়েছে যে, তেলেঙ্গানা রাজ্যের মোট ২৩ লক্ষ মোটর পাম্পে বিদ্যুৎ বিনামূল্যে সরবরাহ করছে তারা৷ ইতিপূর্বে পাঞ্জাবে বিনামূল্যে কৃষিবিদ্যুৎ চালু হয়েছে৷ ৩ একর পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে অন্ধ্র, তামিলনাড়ু প্রভৃতি রাজ্যে৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এক মহা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কৃষকদের ফেলা হয়েছে৷ এ রাজ্যে টিওডি মিটারে কৃষিবিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট ৭ টাকা ৪৮ পয়সা পর্যন্ত দিতে হয় বলে স্বয়ং বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বিধানসভাতেই স্বীকার করেছেন৷ সোনার বাংলা গড়ার কী অপূর্ব নিদর্শন!

তেলেঙ্গানা একটি সদ্যগঠিত ছোট রাজ্য৷ চতুর্থ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাজ্য সরকারের ওই বিজ্ঞপ্তি৷ তারা যদি পারে, তবে পশ্চিমবঙ্গে এই কৃষক পেষণ চলতে থাকবে কেন? ওখানে ২৩ লক্ষ মোটরচালিত পাম্পে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে কৃষিকাজে সহায়তার ব্যবস্থা করেছে সরকার৷ পশ্চিমবঙ্গে মোটর পাম্পের সংখ্যা মাত্র আড়াই লক্ষ৷ তবুও পূর্বতন সরকারের মতোই চাষিদের পাশে দাঁড়ায়নি বর্তমান তৃণমূল সরকার৷

শুধু কি তাই? ২০০৫–এ রাজ্যের কৃষকদের সংগঠিত করে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সংগঠন অ্যাবেকার ডাকে সল্টলেকে বিদ্যুৎ ভবনের সামনে জমায়েত হওয়ার অপরাধে বিগত সিপিএম সরকার পুলিশের গুলিতে নদিয়ার দরিদ্র কৃষক খোদ্দার সেখ সহ বহুজনের রক্তে মাটি ভিজিয়ে দিয়েছিল৷ বর্তমান সরকারও অ্যাবেকার ডাকে নবান্ন অভিযানে পুলিশ লেলিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের সঞ্জয় ঘটমের মাথা ফাটিয়ে আগের সরকারের যোগ্য উত্তরসূরির পরিচয় রেখেছে৷ বিগত কয়েক বছর ধরে জঙ্গল মহলের দরিদ্র অধিবাসীদের উপর বিপুল পরিমাণে বিদ্যুৎ বিল চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে হাজার হাজার গ্রাহককে সংগঠিত করে অ্যাবেকার ধারাবাহিক আন্দোলনের চাপে ২০১৬ সালে রাজ্য সরকার ২২ কোটি ২০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করতে বাধ্য হয়েছিল৷ ২০১৮ সালে আবার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে ওই এলাকার আদিবাসী সহ দরিদ্র মানুষের বিল মকুব ঘোষণা করেছে বলে সংবাদে প্রকাশ৷

কেউ কেউ মনে করছেন, এটা রাজনৈতিক কারণ৷ অর্থাৎ পঞ্চায়েতে বিজেপির সিট বেড়েছে, তাই নাকি এই ব্যবস্থা৷ কিন্তু সকলের জানা আছে, বিজেপি কখনও বিদ্যুতের দাবি তোলেনি৷ পঞ্চায়েত নির্বাচনে কোথাও এই দাবি শোনা যায়নি৷ অ্যাবেকাই সুলভে বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে৷ সদ্য পঞ্চায়েত নির্বাচনেও সকল দলমতের প্রার্থীকে এই প্রশ্নে জনগণের কাছে মতামত জানানোর জন্য দাবি তুলে রাজ্য জুড়ে হ্যান্ডবিল সহযোগে প্রচার করেছে অ্যাবেকা৷ তাতে কৃষকের বাঁচার প্রশ্নটি যেমন ছিল, তেমনই জঙ্গলমহলের দুর্দশাক্লিষ্ট মানুষের দাবিও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছিল৷

রাজ্য সরকার কর্তৃক অবিলম্বে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে ওই এলাকার আদিবাসী সহ সব স্তরের সাধারণ গ্রাহকদের উপর চাপিয়ে দেওয়া বিপুল পরিমাণের বিল মকুব করা দরকার৷ এখনই তেলেঙ্গানার মতো কৃষক স্বার্থে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সহ কৃষি সহায়তার আর্থিক অনুদান প্রকল্প ঘোষণা জরুরি৷

(৭০ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা ২৯ জুন, ২০১৮)