ট্রাম্পের সফরে খরচ হল দেড়শো কোটি টাকা জনগণ কী পেল?

কলকাতা

মহা আড়ম্বরে হয়ে গেল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফর। শুধু তাঁর আপ্যায়নে ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি– এই দু’দিনের মোট ৩৫ ঘন্টায় খরচ হয়ে গেল দেশের খেটে-খাওয়া মানুষের ঘাম-রক্ত মাখা দেড়শো কোটিরও বেশি টাকা। এর আগেও মার্কিন প্রেসিডেন্টদের ভারত সফর দেখেছে মানুষ। কিন্তু দক্ষিণপন্থী এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি নিজের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী কার্যকলাপ, বর্ণবিদ্বেষ, ঘরহারা অভিবাসীদের প্রতি নির্মমতা ও বেশ কয়েকটি যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনায় পূর্ববর্তীদের ছাপিয়ে গেছেন, তাঁকে ভারতে স্বাগত জানাতে যে এলাহি বন্দোবস্তের আয়োজন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং যেভাবে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার প্রদর্শনী করলেন, তা আগে কখনও দেখা যায়নি।

এ ঘনিষ্ঠতা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। মতাদর্শগত ভাবে চরম হিন্দুত্ববাদী, সাম্প্রদায়িক বিজেপির বড়কর্তা নরেন্দ্র মোদি ও চরম দক্ষিণপন্থী, বর্ণবিদ্বেষী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক নৌকারই সহযাত্রী। তবে এটুকুই সব নয়়। এই সফর করা ও করানোর মধ্য দিয়ে দুই রাষ্ট্রনেতাই নিজের নিজের দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির ঝুলি ভরে দেওয়ার পাশাপাশি নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা চালিয়েছেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্য ছিল প্রতিরক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করে ডুবতে থাকা মার্কিন কোম্পানিগুলি ও সেখানকার অর্থনীতিকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করা। পাশাপাশি চীনের সাথে বাণিজ্যের টক্করে জিততে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপান ও অস্টে্রলিয়ার সঙ্গে ভারতকেও সহযোগী হিসাবে পাওয়া। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী মোদিও চেয়েছিলেন আমেরিকার সাথে বাণিজ্য চুক্তির পাশাপাশি চীনের দখলে থাকা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে ভারতীয় পুঁজিপতিদের কিছুটা অন্তত জায়গা করে দেওয়ার জন্য দুর্বল দেশগুলিকে সামরিক নখ-দাঁত দেখানো। তাই মোদির চাই ট্রাম্পের সাহায্য।

এসব অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উদ্দেশ্য ছাড়াও ট্রাম্প ও মোদি– দু’জনেরই নিজস্ব রাজনীতিগত কিছু স্বার্থসিদ্ধির বিষয় ছিল। সফরের সময়টা লক্ষ করার মতো। আমেরিকায় এ বছরেই অনুষ্ঠিত হতে চলেছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ফলে প্রার্থী হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায় রয়েছে ভারতের মতো বিরাট মাপের বাজারওয়ালা একটি দেশের সঙ্গে শত শত কোটি ডলারের অস্ত্রচুক্তি এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে ভারতের শক্তিকে যথাসম্ভব ব্যবহার করে মার্কিন একচেটিয়া পুঁজিপতি, বহুজাতিক সংস্থার মালিকদের মুনাফা লুঠের বন্দোবস্ত করে দেওয়া। এর মাধ্যমে তাদের কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করা। এতে আসন্ন নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় আসার পথ সুগম হবে। অন্যদিকে আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তির পাশাপাশি মার্কিন সহযোগিতা পেয়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজের আধিপত্য বাড়িয়ে দেশীয় পুঁজিপতিদের আস্থা ধরে রাখার সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল।

বিজেপির কাশ্মীর নীতির ব্যর্থতা প্রকট। এনআরসি, সিএএ চালু করা সহ বহু নগ্ন সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপে শাসক দল বিজেপির নেতা হিসাবে মোদি ও অমিত শাহের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। বিশ্বের দরবারে মাথা হেঁট হয়েছে। মোদি চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দেশে নিয়ে এসে, বিপুল অঙ্কের যুদ্ধাস্ত্র কেনা সহ নানা সুবিধা দিয়ে তাঁর সঙ্গে ব্যাপক ঘনিষ্ঠতা প্রদর্শনের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার বড়দাদা আমেরিকার সমর্থন আদায় করতে। এর দ্বারা একদিকে দেশীয় পুঁজিপতি শ্রেণির আস্থা অর্জন, অন্য দিকে দেশের অগণিত মানুষের সামনে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন– এই ছিল নরেন্দ্র মোদির প্রধান উদ্দেশ্য।

ফলে বিশ্বের মানুষ সাক্ষী থাকল পারস্পরিক পিঠ চাপড়ানির এক অভিনব প্রদর্শনীর। ২০১৯-এ আমেরিকার হাউস্টনে ‘হাউডি মোদি’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প ৫০ হাজার অভিবাসী ভারতীয়ের সামনে মোদিকে ‘হিরো’ হিসাবে তুলে ধরেছিলেন। এবার ‘নমস্তে ট্রাম্প’-এর মধ্য দিয়ে মোদিজি ট্রাম্পসাহেবকে তার কৃতজ্ঞ প্রতিদান দিলেন। আমেরিকার নাগরিকত্ব নেওয়া ভারতীয়দের ২৫ শতাংশই গুজরাটি হওয়ায় ‘নমস্তে ট্রাম্প’-এর সূচনা করা হয়েছিল গুজরাটে। সেখানে মোতেরা স্টেডিয়ামে এবং আমেদাবাদ থেকে সবরমতী আশ্রমে যাওয়ার ২২ কিমি রাস্তায় বহু মানুষকে জড়ো করে, তাদের দিয়ে মিনিটে মিনিটে ট্রাম্পের জয়ধ্বনি তুলিয়ে আসন্ন নির্বাচনে মার্কিনী-ভারতীয়দের ভোট তাঁর দিকে টানার ব্যবস্থা করে দিলেন মোদি। বিনিময়ে ট্রাম্প সিএএ, এনআরসি, কাশ্মীরের মানুষের উপর নির্মম রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, এমনকি সফর চলাকালেই রাজধানী দিল্লিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতীদের পরিকল্পিত ভয়ঙ্কর হামলা নিয়ে শুধু মুখ বন্ধ রেখেছেন তাই নয়, মোদিকে ধর্মীয় সহিষুiরতার সার্টিফিকেট পর্যন্ত দিয়ে গেছেন।

পরদিন দিল্লিতে ট্রাম্প সাহেবের সঙ্গে মোদির কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কেমন সেই চুক্তি? দুই রাষ্ট্রপ্রধান মোট তিনটি চুক্তি করেছেন– প্রতিরক্ষা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও স্বাস্থ্য বিষয়ে। কথা হয়েছে ভারত ৩০০ কোটি ডলার, অর্থাৎ প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা খরচ করে বেশ কিছু মার্কিন সমরসম্ভার কিনবে। মার্কিন সংস্থা এ’ন মোবিলের সঙ্গে ইন্ডিয়ান অয়েলের চুক্তি অনুযায়ী ভারত আমেরিকা থেকে আরও বেশি পরিমাণে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস কিনবে। এছাড়াও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও দু’দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। তবে ভারতীয় শিল্পপতিদের বহুপ্রতীক্ষিত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে কথা বিশেষ এগোয়নি। এক কথায় জনগণের কষ্টার্জিত দেড়শো কোটি টাকা ব্যয়ে ট্রাম্পের এই মহাসফরের মধ্য দিয়ে দেশের সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের জীবনে সামান্য সুফল আনার ব্যবস্থা করা দূরের কথা, এমনকি শিল্পপতিদের জন্যও বিশেষ সুবিধা জোগাড় করতে পারলেন না মোদি।

আরেকটি বিষয় লক্ষ করার মতো। দুই রাষ্ট্রপ্রধান এবার ঘোষণা করেছেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করবেন তাঁরা। অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদির সহযোগিতায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চলেছেন ট্রাম্প– যিনি দুনিয়া জুড়ে দুর্বল দেশগুলিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আগ্রাসন লাগাতার চালিয়ে যাচ্ছেন! এই চুক্তির অন্যদিকে রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি যিনি নগ্ন সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বেলে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে এ দেশের সাধারণ মানুষের ঐক্য ভেঙে দেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন– যা তাঁর রাজনীতির তুরুপের তাস। আর এঁরাই নাকি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করবেন! এর চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে!

ট্রাম্পের এই সফর প্রমাণ করল ‘রতনে রতন চেনে’। ঘৃণার কারবারি দুই রাষ্ট্রপ্রধান মিলিত হয়ে একে অপরের পিঠ চাপড়ে নিজের নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য পূরণের চেষ্টা চালিয়ে গেলেন, যার সঙ্গে দুই দেশের সাধারণ মানুষের জীবনের কোনও যোগ নেই। স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিবাদ উঠেছে। দেশ জুড়ে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ নানা সংগঠনের নেতৃত্বে আওয়াজ তুলেছেন ‘ট্রাম্প ফিরে যাও’। পোড়ানো হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন প্রেসিডেন্টের কুশপুতুল। বিক্ষোভ হয়েছে মার্কিন দূতাবাসের সামনেও।

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ৩০ সংখ্যা)