জ্বলছে অরণ্য গলছে হিমবাহ, পুঁজির সর্বগ্রাসী লোভে বিপন্ন সভ্যতা


জ্বলছে আমাজন অরণ্য৷ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ আমাজনের সবুজ বনানী যা জোগান দেয় বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদান অক্সিজেনের মোট প্রয়োজনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ, শুষে নেয় ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন ডাই অক্সাইডের বিপুল অংশ৷ বিপন্ন হয়ে পড়ছে এই অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের প্রায় ৪০০ গোষ্ঠীর মানুষের জীবন৷ ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৪০ হাজার প্রজাতির গাছ–গাছালি, ৩ হাজার প্রজাতির মাছ, ১৩০০ প্রজাতির পাখি, ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী সহ বনের জীবকুল৷ বিপন্ন হচ্ছে আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্যও৷

প্রায় ৫৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের আমাজন অরণ্যের প্রায় ৬০ ভাগ রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে৷ অথচ আগুন লাগার পর তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও এই মারাত্মক বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে সেখানকার প্রেসিডেন্ট, দক্ষিণপন্থী ‘সোস্যাল লিবেরাল পার্টি’র নেতা জেয়ার বোলসোনারোকে বিশেষ উদ্বিগ্ন ও তৎপর হতে দেখা যায়নি৷ আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র আইএনপিই জানাচ্ছে, শুধু এ বছরেই আমাজনের জঙ্গলে ৭২ হাজার ৮৪৩টি দাবানলের ঘটনা ঘটেছে যা গত বছরের তুলনায় ৮৩ শতাংশ বেশি৷ স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, আমাজনের মতো একটি বৃষ্টি–অরণ্যে (রেইনফরেস্ট), যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি, সেখানে বার বার এভাবে আগুন লাগছে কীভাবে এবং অগ্নিকাণ্ড এত দিন ধরে চলতেই বা পারছে কী করে৷ অভিযোগ উঠছে, প্রাকৃতিক কারণে নয়, এই আগুন ইচ্ছাকৃত ভাবে লাগানো হয়েছে৷ জঙ্গলের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড, সেখানকার বিপুল জলসম্পদ ও মাটির নিচে থাকা মূল্যবান খনিজ সম্পদের উপর দখলদারি কায়েম করতে বৃহৎ পুঁজির মুনাফাবাজ মালিকরা আমাজন অরণ্যের বিভিন্ন স্থানে, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বার বার আগুন লাগাচ্ছে৷ এবং এই ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ডের পিছনে রয়েছে ব্রাজিলের দক্ষিণপন্থী সরকারের মদত৷ যার প্রতিনিধি প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো৷

২০১৮–র অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন বোলসোনারো৷ তার বহু আগে থেকেই ব্রাজিলের পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ ও আইনগুলির বিরোধী তিনি৷ নির্বাচনী প্রচারে নেমে বোলসোনারো পুঁজিপতিদের ঢালাও প্রতিশ্রুতিও দেন যে, প্রেসিডেন্ট পদে বসে আমাজন অরণ্যের সংরক্ষিত অঞ্চলগুলি ব্যবসার জন্য খুলে দেবেন৷ একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ওই অরণ্যের ৬৮টি সংরক্ষিত এলাকা এখন আগুনের গ্রাসে৷

প্রেসিডেন্ট পদে বসার কয়েক মাস পরে এ বছরের জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)–এর সভায় বোলসোনারো এক ‘নতুন ব্রাজিল’ তৈরির রূপরেখা পেশ করেন৷ তাঁর সেই ‘নতুন’ ব্রাজিলে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষত আমাজন অরণ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিয়ে কৃষি ও খনি ব্যবসার দিগন্ত খুলে দেওয়ার কর্মসূচি দাখিল করেন তিনি৷ এই সভায় উপস্থিত বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রপ্রধানদের মুখে সেদিন আপত্তির টুঁ শব্দটিও শোনা যায়নি৷ অথচ মাঝে মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়, পরিবেশ রক্ষায় এঁরা কতই না উদ্বিগ্ন, বড় বড় সভা করে ঢাক–ঢোল পিটিয়ে তার প্রচার করতে৷ কিন্তু ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলির অপরিণামদর্শী মুনাফালোভের কারণে বিশ্ব–উষ্ণায়নের যে বিপদ গোটা পৃথিবীতে ঘনিয়ে এসেছে, তা থেকে রেহাই পেতে নির্দিষ্ট কার্যক্রম নিতে এতটুকু উদ্যোগী নন এইসব রাষ্ট্রপ্রধানরা৷ ছলে বলে কৌশলে এর দায় তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলির উপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্যই যত ব্যগ্রতা তাঁদের৷ ফ্রান্সে সাতটি শক্তিধর পুঁজিবাদী দেশের সংগঠন জি–৭–এর সাম্প্রতিক সভায় বিশ্বের এই বড়কর্তাদের আমাজন রক্ষায় খুব উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা গেছে৷ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ থেকে শুরু করে জার্মানির চ্যান্সেলর মের্কেল– সকলেই আমাজন অরণ্যকে বাঁচানোর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করেছেন, ব্যবসা বন্ধের হুমকিও দিয়েছেন৷ কিন্তু এসবই যে বিশ্ববাসীর চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য নেহাত বলতে হয় তাই বলা, নানা ঘটনাক্রমে তা স্পষ্ট৷ বাস্তবে আমাজনের আগুন নেভাতে যতটা তাঁরা আগ্রহী, তার থেকে তাঁদের ঢের বেশি উৎসাহ আগুনে পুড়ে যাওয়া আমাজনের বিস্তৃত অংশগুলিকে কৃষি–ব্যবসা আর খননের জন্য বেসরকারি বহুজাতিক পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিতে৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্বয়ং টুইট করে আগুন নেভাতে ব্রাজিলকে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছেন৷ পাশাপাশি বলেছেন, ‘‘আগামী দিনে আমাদের (ব্রাজিল ও আমেরিকা) মধ্যে ব্যবসা–বাণিজ্যের সম্ভাবনা খুবই উদ্দীপনাময়৷ আমাদের সম্পর্ক দৃঢ়, হয়তো আগের তুলনায় দৃঢ়তর’’ (পলিটিকো ডট কম, ২৩ আগস্ট, ’১৯)৷ এই মন্তব্যের পর তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়৷ বিশেষত যখন জানা যায়, গত ২৬ আগস্ট জি–৭–এর বৈঠকে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংক্রান্ত আলোচনাসভায় যেখানে আমাজনের আগুন ছিল অন্যতম আলোচ্য বিষয়, সেখানে তিনি যোগদান করারও প্রয়োজন বোধ করেননি৷

শুধু কি এই? বিশ্ব পুঁজিবাদের ইঞ্জিন বলে খ্যাত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন৷ তিনি যা বলেছেন, মুখ ফুটে না বললেও দুনিয়ার আরও কয়েকটি ধনী পুঁজিবাদী দেশের কর্তাদের মনোবাসনা আলাদা কিছু নয়৷ উত্তর মেরুবৃত্তের অন্তর্গত বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ বরফে ঢাকা গ্রিনল্যান্ড এখন সকলেরই আগ্রহের বিষয়৷ এর কারণ কী? এর পিছনেও যে রয়েছে বৃহৎ পুঁজির মালিকদের মুনাফার আগ্রাসী লালসা, মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট মাইক পম্পেয়োর কথা থেকেই তা স্পষ্ট৷ তিনি বলেছেন, উত্তর মেরুবৃত্তে বরফ গলে বাণিজ্যিক জাহাজ পরিবহণের সহজ একটি রাস্তা তৈরি হয়েছে৷ এই রাস্তায় আমেরিকা থেকে এশিয়ায় পণ্য নিয়ে যেতে সময় লাগবে অনেক কম৷ খরচ কমবে ব্যবসায়ীদের৷ পুঁজিপতিদের রাজনৈতিক ম্যানেজার ট্রাম্প সহ অন্যান্য দেশের কর্তাদের শকুনের দৃষ্টি তাই এখন গ্রিনল্যান্ডের উপর৷ পুঁজিবাদী রাশিয়া ইতিমধ্যে মেরুবৃত্তে ২৭টি সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে ফেলেছে৷ চীনও গ্রিনল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগের ছক কষছে৷

তাছাড়া গ্রিনল্যান্ডের বরফের নিচে রয়েছে খনিজ সম্পদের বিপুল ভাণ্ডার, যা মুনাফালোলুপ পুঁজিপতিদের কাছে অত্যন্ত লোভনীয়৷ এতদিন দুর্ভেদ্য বরফের আস্তরণ থাকায় এই খনিজের নাগাল পাওয়া যেত না৷ এখন পুঁজিবাদী কার্যকলাপের অপরিণামদর্শী প্রসারের কারণে সৃষ্টি হওয়া বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে মেরুবৃত্তের বরফ গলছে৷ সুযোগ মিলছে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের৷ সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করছে গোটা বিশ্বের ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলি নিজের নিজের দেশের বৃহৎ পুঁজিপতিদের মুনাফার ভাণ্ডার আরও ভরিয়ে তুলতে৷ কিন্তু বিজ্ঞানীরা যে বলছেন, উত্তর মেরুবৃত্তে পুঁজিবাদী কার্যকলাপ অনেক গুণে বাড়িয়ে তুলবে বিশ্ব–উষ্ণায়নের বিপদ, যার ফলে ধ্বংসের পথে চলে যাবে গোটা দুনিয়া সেখানকার হিমবাহ দ্রুত গলে বাড়িয়ে তুলবে সমুদ্রতলের উচ্চতা৷ তলিয়ে যাবে অসংখ্য ভূ–ভাগ৷ বিপন্ন হবে মানুষ৷ তার বেলা?

কুছ পরোয়া নেহি কারণ বিশ্ব জুড়ে এখন বিরাজ করছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, যার একমাত্র লক্ষ্য সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন৷ মুনাফার এই লোভ এতখানি প্রবল যে মানবিকতা, মূল্যবোধ রক্ষা দূরের কথা, মানবসভ্যতার কেবলমাত্র অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখার জন্যও এমনকি পুঁজিপতিদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই৷ আমাজন অরণ্যের আগুন বা গ্রিনল্যান্ডের খনিজ সম্পদের দখলদারি– এসবের ফলে বিশ্ব–উষ্ণায়নের তীব্রতা বেড়ে গিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ যে চূড়ান্ত বিপন্ন হয়ে পড়ছে, বিপন্ন হয়ে পড়ছে মানুষ সহ গোটা জীবজগতের অস্তিত্ব, বিজ্ঞানীরা বার বার হুঁশিয়ারি দেওয়া সত্ত্বেও কর্ণপাত করছে না বৃহৎ পুঁজির মালিক ও তাদের রাজনৈতিক ম্যানেজার দেশ–বিদেশের পুঁজিবাদী সরকারগুলি৷ এভাবে চললে প্রকৃতির আসন্ন বিপর্যয়ের সর্বনাশা পরিণতি থেকে রেহাই পাবেন না কেউই, এমনকি খোদ পুঁজিপতিরা নিজেরাও– এ কথা জানা সত্ত্বেও যেন মৃত্যুকূপে ঝাঁপ দিতে ছুটে চলেছে বৃহৎ পুঁজির মালিক ও তাদের শাসনাধীন রাষ্ট্রগুলি৷

আসলে এটাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দস্তুর৷ মুনাফার লোভই পুঁজিবাদের চালিকাশক্তি৷ এই ব্যবস্থার ভিত্তি হল মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণ– শ্রমিক শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে অল্প কয়েকজন পুঁজিমালিকের বিপুল মুনাফার অধিকারী হওয়া৷ নিজেদের মধ্যেকার হিংস্র প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে সর্বোচ্চ মুনাফা লুঠের এই প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি, পরিবেশ কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করলে চলে না পুঁজিপতি শ্রেণির৷ শুরু থেকেই তারা তা করেওনি৷ যত দিন গেছে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সংকট জর্জরিত হয়ে মুমূর্ষু হয়েছে৷ ক্রমাগত বাজারসংকট গ্রাস করেছে তাকে৷ আজ এই ব্যবস্থার নির্মমতা আক্ষরিক অর্থেই সীমাহীন৷ মুনাফা লুঠের রথে চড়ে চোখ কান বুজে অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাওয়া– পুঁজিবাদের এটাই একমাত্র ভবিতব্য৷ তাই মানবসভ্যতাকে রক্ষা করার দায়িত্ব দেশে দেশে সাধারণ মানুষের৷ পুঁজিবাদী এই বিধ্বংসী লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে তাদেরই সংগঠিত ভাবে এগিয়ে আসতে হবে৷ রাস্তাও একটাই– সেটি হল এই সর্বনাশা আত্মধ্বংসী শোষণমূলক ব্যবস্থাটিকে সমূলে উচ্ছেদ করা৷ এ ছাড়া মানুষের আর বাঁচার উপায় নেই৷ (তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮ ও ৩০ আগস্ট, ’১৯)

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ৬ সংখ্যা)