গুজরাটের সিলেবাসে হিটলারী ফ্যাসিবাদের জয়ধ্বনি

২০১৪ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপির নেতৃত্বে এন ডি এ কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন হওয়ার পর থেকেই বিজেপি এবং আরএসএস তাদের উগ্র হিন্দুত্ববাদী পরিকল্পনা রূপায়ণে উঠে পড়ে লেগেছে৷ এরই অঙ্গ হিসাবে তারা দেশে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর নামে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং ভারতীয়করণের নামে শিক্ষার গৈরিকীকরণ করছে৷ বিজেপি পরিচালিত বিভিন্ন রাজ্যে তারা পাঠক্রম এমনভাবে পরিবর্তন করছে এবং করার কথা বলছে যা দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলছে৷ তারা ইতিহাসকেও বিকৃত করছে৷ সম্প্রতি ‘গুজরাট স্টেট বোর্ড অফ স্কুল টেক্সট বুকস’ প্রকাশিত সমাজবিজ্ঞান বইয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের ত্রুটি দেখানো হয়েছে এবং মানবতার ঘৃণ্য শত্রু ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদকে মহিমান্বিত করা হয়েছে৷ সেখানে বলা হয়েছে গান্ধীজির তুলনায় হিটলার বড়৷ ‘গান্ধীযুগ ও জাতীয় আন্দোলন’ শীর্ষক অধ্যায়ে ‘নেতিবাচক দিকগুলি’ (দ্য নেগেটিভ আসপেক্ট) নামে একটি অনুচ্ছেদ আছে৷

দশম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞান বইয়ে ‘হিটলার, দি সুপ্রিমো’ এবং ‘নাৎসিবাদের অভ্যন্তরীণ অবদান’ শীর্ষক দুটি অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ দশম শ্রেণির বইয়ে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের জয়গান করা হয়েছে৷ বলা হয়েছে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ জার্মানিতে বলিষ্ঠ জাতীয় গৌরববোধ জাগ্রত করেছিল এবং আমলাতন্ত্র ও প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি করেছিল৷ এ ছাড়া আরও কিছু অবদান বিস্তারিতভাবে  আলোচিত হয়েছে৷ কিন্তু ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের অমানবিক দিকগুলি, যেমন ইহুদিদের উপর নির্মম অত্যাচার, ৬০ লক্ষ ইহুদিকে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা, ট্রেড ইউনিয়নগুলির প্রতি নির্মম আক্রমণ, যারা মুসোলিনি বা হিটলারের সংজ্ঞা অনুযায়ী ন্যায্য নাগরিক নয় তাদের উপর অত্যাচার প্রভৃতিকে বিশ্বের মনীষীরা ও সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যে নিন্দা করেছেন, তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ এই বইয়ে করা হয়নি৷ ‘নাৎসিবাদের মতবাদ’ (আইডিয়োলজি অফ নাজিজম) শীর্ষক অনুচ্ছেদে হিটলারের প্রশংসা করে বলা হয়েছে, ‘একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক পরিকাঠামো প্রতিষ্ঠা করে হিটলার অল্প সময়ের মধ্যে জার্মান সরকারকে মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করেছেন৷ তিনি বৃহত্তর জার্মান রাষ্ট্র গঠন করেছেন … জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন … জার্মানিকে সমৃদ্ধ করেছেন’৷ অবশ্য এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ কারণ বিজেপি যে মতাদর্শ নিয়ে চলে সেই আরএসএস–এর তাদের নেতা গোলওয়ালকর তাঁর ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ নামক বইয়ে বলেছেন, ‘জাতি এবং সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য জার্মানি সেমেটিক জাতি ইহুদিদের শুদ্ধিকরণ করে বিশ্বকে বিস্মিত করেছেন৷ এখানে তার সর্বোচ্চ জাতীয় গর্ব প্রকাশ করা হয়েছে৷ জার্মানি দেখিয়েছে, যে সমস্ত জাতি ও সংস্কৃতির মূলগত পার্থক্য রয়েছে তাদের একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে সংগঠিত করা প্রায় অসম্ভব, যা আমরা যারা হিন্দুস্থানে আছি তাদের কাছে শিক্ষণীয়’৷

বিজেপির এই অপপ্রয়াস দেশকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে? তারা কি দেশকে ফ্যাসিবাদের পথে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছে? তাই কি তারা নানাভাবে ছাত্রদের যুক্তিবাদী মনকে মেরে দিয়ে ও ফ্যাসিবাদের জয়গান গেয়ে দেশে ফ্যাসিবাদের জমি প্রস্তুত করছে? শিক্ষক সমাজ ও সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এই অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন৷ না হলে ভবিষ্যৎ আমাদের ক্ষমা করবে না৷

ডাঃ প্রদীপ কুমার দত্ত, প্রাক্তন প্রধান,

পদার্থবিদ্যা বিভাগ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা

(৭০ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা ১৮ মে, ২০১৮)