কেন্দ্রীয় কৃষি বাজেট  কৃষককে ঠেলে দেবে বহুজাতিকের গ্রাসে

সুকুমার রায়ের আবোলতাবোলে মুখের সামনে লোভনীয় সুস্বাদু খাবারের টুকরো ঝুলিয়ে হাড়–জিরজিরে খুড়ো খাবারের টানে পাঁচ ঘণ্টার পথ তিন ঘণ্টায় ছোটেন৷ গ্রামের ঋণ–জর্জর কৃষকদের উন্নয়নে(?)–র পথে হাঁটাতে এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী সেই ‘খুড়োর কল’–কে ব্যবহার করেছেন৷

‘২০২২ সালের মধ্যে সমস্ত কৃষকের আয় দ্বিগুণ হবে’– প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সেই আশ্বাসবাণীর লোভ দেখিয়ে অর্থমন্ত্রী কৃষকদের উদারিকরণের পথে হাঁটানোর চেষ্টা করেছেন৷

তিনি ২০১৬ সালের চাষের জমি লিজ আইন, ২০১৭ সালের কৃষিপণ্য ও গবাদি পশু বিপনণ আইন এবং ২০১৮ সালের চুক্তির ভিত্তিতে কৃষিপণ্য উৎপাদন ও গবাদি পশু প্রজনন আইন–এই তিন আইনকে ব্যবহার করে রাজ্য সরকারগুলিকে উদারিকরণের অশ্বমেধ ঘোড়াকে ছোটানোর নির্দেশ দিয়েছেন৷ বাজেট ভাষণে তিনি ১৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন৷ এর ফলে দেশি–বিদেশি কর্পোরেটগুলি তাদের বিপুল পুঁজির সম্ভার নিয়ে গ্রামীণ ক্ষেত্রের উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং বিপনণের সমস্ত জায়গাজুড়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করবে৷ মন্ত্রীর ঘোষিত কর্মসুচিগুলি তারই পথ সুগম করবে৷ বিপরীতে গরিব কৃষকদের স্বার্থরক্ষার দায়বদ্ধতা থেকে সরকার বেরিয়ে আসতে চেয়েছে এই বাজেটে৷

গ্রামীণ মানুষের সারা বছরের কাজ পাওয়ার সমস্যা যেখানে প্রবল, একশো দিনের কাজকে আরও ব্যাপক রূপ দিয়ে বছরে দু’শো দিন করা যায় কি না এই ভাবনা যখন করা দরকার, সেখানে এই ‘রেগা’ প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ ৯ হাজার ৫০২ কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হল৷ সারে ভর্তুকি কমানো হল ১১ শতাংশ৷ এর ফলে সারের দাম বাড়বে৷ সরকার জমিতে রাসায়নিক প্রয়োগ কমাতে বলছে৷ অথচ জৈব সার বা পরম্পরাগত সারের ক্ষেত্রে সরকার ব্যয়বরাদ্দ করেছে মাত্র ৬৮৭.৫ কোটি টাকা৷ এই টাকায় এতবড় দেশে সারের ব্যবস্থা হয়? আসলে এর মধ্য দিয়ে সারের কালোবাজারিকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে৷ গত বছর লোকসভা নির্বাচনের মুখে বাজেটে প্রতি কৃষি পরিবারকে বছরে ছয় হাজার টাকা সাহায্য করার ‘পি এম কিষাণ প্রকল্পে ৭৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল৷ এ বছরের সংশোধিত বাজেটে দেখা গেল সেই খাতের ২১ হাজার কোটি টাকা খরচ করা গেল না এবং কৃষি ঋণ প্রকল্পে ধার্য করা দেড় লক্ষ কোটি টাকা কেবল তাদের জন্য বরাদ্দ করা হবে, যারা পিএম কিষাণ প্রকল্পে সাহায্য পেয়েছেন৷ বোঝাই যাচ্ছে ভোটে ফায়দা লোটার জন্যই এই বৈষম্য৷

বাজেটে ১০০টি খরাপ্রবণ জেলাকে সোলার পাম্পের সাহায্যে সুসংহত সেচের আওতাভুক্ত করা, পতিত জমিতে সোলার বিদ্যুৎ তৈরির ব্যবস্থা করা, পচনশীল পণ্য পরিবহণের জন্য পিপিপি মডেলে ‘বিশেষ ট্রেন’ এবং উত্তরপূর্ব অঞ্চলের জন্য ‘বিশেষ উড়ান’–এর ব্যবস্থা করা, মাছের উৎপাদন বাড়াতে ‘সাগর মিত্র’ নামে ৩,৪৭৭ টি মৎস্যজীবী সংগঠন তৈরি, ২০২৪–এর মধ্যে ৫০০টি কৃষি সংস্থা গড়ে তুলে এক লক্ষ কোটি টাকার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা তৈরি এই সমস্ত গালভরা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে৷ কৃষকদের সমস্যা নিয়ে সরকারের যে উদাসী দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে এসব প্রতিশ্রুতির কতটুকু গরিব কৃষকদের জীবনে পরিবর্তন আনবে তাতে সন্দেহ থেকেই যায়৷ দেশি–বিদেশি কর্পোরেটদের পুঁজি বিনিয়েগের মৃগয়াক্ষেত্রের ব্যবস্থা করবে এই বাজেট৷

এ দেশের গরিব এবং প্রান্তিক কৃষকদের সংখ্যা মোট কৃষকের ৮৬.২ শতাংশ৷ এই কৃষকদের মূল্য সমস্যা হল তাঁদের চাষের কাজ চালাবার মতো পুঁজি থাকে না৷ সার, বীজ, কীটনাশকের কালোবাজারি, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সেচের ব্যয়বৃদ্ধি, বছর বছর চাষের খরচ বাড়িয়ে তোলে৷ সরকারি ঋণ পাওয়ার নানা অসুবিধায় কৃষকদের চড়া সুদে মহাজনি ঋণের শরণাপন্ন হতে হয়৷ তারপর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি না হলে ফসল ঘরে তোলেন৷ কিন্তু সে ফসলের ন্যায্য দাম জোটে না৷ ফলে ঋণশোধের তাড়নায় জলের দরে ফসল বিক্রি করে কৃষক৷ তারপর পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারায় কিংবা ঋণের দায়ে কৃষক আত্মঘাতী হন৷

বস্তুত গ্রামীণ সাধারণ কৃষকদের স্বার্থরক্ষায় সরকারের কোনও ভূমিকাই নেই৷ সরকারের প্রচার করা প্রকল্পগুলির সুবিধা কতটুকু গরিব কৃষকদের কাছে পৌঁছায়, তা সরকারের মন্ত্রী–আমলারা ভালই জানেন৷ গ্রামীণ ক্ষেত্রে পুলিশ–আমলা–শাসকদলের নেতা–ফড়ে–বিদেশি পুঁজির এজেন্ট–কায়েমি স্বার্থবাদীদের এই দুষ্টচক্রই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে৷ এদের কাছে গরিব কৃষক অসহায়৷ এই অবস্থায় দিশাহীন এই কৃষকদের কাছে সরকারের মদতে পৌঁছে যাবে কর্পোরেটদের দালালরা৷ কৃষকদের সাথে চুক্তি করে তার হাতে ধরিয়ে দেবে আগাম টাকা৷ ফসল বিক্রির সমস্যা নেই৷ এজেন্টই এসে নিয়ে যাবে৷ কৃষক ভাববে মহাজন–ফড়েদের হাত থেকে রক্ষা পেল৷ কিন্তু কিছু দিন বাদেই সে বুঝতে পারবে তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়েছে সে৷ কোন ফসল চাষ হবে, তা ঠিক হবে বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হলে দায় কৃষকের৷ নিজের জমিতেই সে মজুরে পরিণত হবে৷ তাকে ছুটে বেড়াতে হবে বিশ্ববাজারের চাহিদা পূরণে৷

কৃষকদের মৌলিক সমস্যা সমাধানের কোনও দিশা এই বাজেটে নেই৷ বরং এই বাজেট কৃষকদের উপর বহুজাতিকদের থাবাই বাড়াবে৷ বাজেটের মধ্য দিয়ে কৃষক স্বার্থ বিপন্ন করার প্রতিবাদে অল ইন্ডিয়া কিষাণ খেতমজদুর সংগঠন সহ বিভিন্ন কৃষক সংগঠনগুলির যুক্ত সংঘর্ষ মোর্চা সর্বভারতীয় স্তরে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২৭ সংখ্যা)