কৃষক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রামীণ ভারত বনধ সফল করুন — এ আই কে কে এম এস

বিজেপি সরকারের কৃষক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রামীণ ভারত বনধ সফল করুন

এ আই কে কে এম এস-এর আহ্বান

দেশের আমজনতা যখন করোনা অতিমারিতে বিধ্বস্ত, গ্রামীণ কৃষক-খেতমজুর যখন সপরিবারে অনাহারের যন্ত্রণায় ছটফট করছে, ঠিক সেই সময় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা মারল। এমন তিনটি আইন তারা পাশ করাল যা শুধু কৃষক জীবনে নয়, সাধারণ খেটে-খাওয়া গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনেও সর্বনাশ ডেকে আনবে।

কী সেই নীতি যার বিরুদ্ধে আজ সমস্ত ভারতের কৃষক সমাজ পথে নেমেছে? প্রতিবাদ প্রতিরোধের শপথ নিচ্ছে? বিজেপি সরকার তিনটি আইন সংশোধন করেছে– ১) দি ফার্মার্স প্রডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন অর্ডিন্যান্স-২০২০, ২) দি ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিওরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস অর্ডিন্যান্স-২০২০, ৩) দি এসেন্সিয়াল কমোডিটিস অ্যামেন্ডমেন্ট অর্ডিন্যান্স-২০২০। এই সব অর্ডিন্যান্স বিজেপি সরকার এ বছর জুন মাসে জারি করেছিল, যা এবার আইনে পরিণত করে দিল তারা।

বিস্তৃত আলোচনার মধ্যে না গিয়ে বলা যায়, প্রথম আইনটির মধ্য দিয়ে রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রিত রেগুলেটেড মার্কেট বা মান্ডির বাইরেও কৃষকরা যে কোনও ব্যবসাদার বা বাণিজ্যিক সংস্থার কাছে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারবে।

দ্বিতীয় আইনটির দ্বারা বহুজাতিক কোম্পানি চুক্তিচাষের মাধ্যমে যে কোনও পণ্য কৃষকদের দিয়ে উৎপাদন করিয়ে নিতে পারবে।

তৃতীয় আইনটির দ্বারা যে কোনও বহুজাতিক কোম্পানি বা ব্যবসাদার কৃষিপণ্য সহ অন্যান্য দ্রব্য যত খুশি কিনে মজুত করে রাখতে পারবে। এতে আইনের কোনও বাধা থাকবে না। সংক্ষেপে এই হল এই তিনটি আইনের মর্মবস্তু।

প্রথমত মনে রাখা দরকার, এই তিনটি আইন পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়, সম্পর্কযুক্ত। এদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এক। তা হল সমগ্র কৃষিজাত দ্রব্যকে বহুজাতিক পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া। এই উদ্দেশ্য পূরণে সরকার এমন ভাবে আইন তৈরি করেছে যাতে এতে কোনও বাধা না থাকে।

শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার সময় ওরা প্রথমে সরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ ক্ষেত্রেও ঠিক একই কাজ করছে ওরা। সরকারি পরিচালনায় কৃষিপণ্যের যতটুকু দাম পাওয়ার ব্যবস্থা এখনও আছে তাকেই ওরা ধ্বংস করে দিচ্ছে। কী সেই ব্যবস্থা? বিভিন্ন রাজ্য সরকারের পরিচালনায় এ দেশে বড় বড় নিয়ন্ত্রিত বাজার বা মান্ডির সংখ্যা ২৪৭৭ এবং তুলনায় ছোট ছোট মান্ডির সংখ্যা ৪৮৪৩টি। কৃষকরা এই সব বাজারে কৃষিপণ্য নিয়ে যায় এবং সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্ট ছাড়া কোনও ব্যবসাদার এখানে চাষির কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনতে পারে না। এই মান্ডিতে কৃষককে খাজনা দিতে হয়। এর ফলে কৃষক সরকারি সহায়ক মূল্যে তার পণ্য বিক্রি করতে পারে। যদিও এর মধ্যে প্রচুর দুর্নীতি হয়, কৃষকরা বঞ্চিত হয়। তবুও সরকারের তত্ত্বাবধানে বিপুল পরিমাণ কৃষিপণ্য এই সব মান্ডিতে বেচাকেনা হয়। তাই এই মান্ডি বা নিয়ন্ত্রিত বাজার কৃষকদের কিছুটা হলেও দাম পেতে সাহায্য করে।

এখন কী হবে? মান্ডির বাইরে যথেচ্ছ কৃষিপণ্য কেনার অধিকার থাকায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিপুল টাকার ভাণ্ডার নিয়ে ময়দানে নামবে, প্রয়োজন হলে প্রথম দিকে মান্ডির থেকে বেশি দাম দেবে এবং শেষ পর্যন্ত এই সব মান্ডিগুলোকে ধ্বংস করে দেবে। আর সরকার তো এই সব বহুজাতিক পুঁজির ক্রীতদাস। তারাও এই প্রক্রিয়া সফল করতে পুঁজিপতিদের সাহায্য করবে। ফলে কৃষক সহায়ক নিয়ন্ত্রিত বাজার বা মান্ডি ধ্বংস হয়ে কৃষকরা গিয়ে পড়বে বহুজাতিক পুঁজির খপ্পরে।

কিন্তু কৃষকরা যা তৈরি করবে এই বহুজাতিক পুঁজি তা-ই কিনবে, বিষয়টা তো এমন নয়। তারা কিনবে তাদের পছন্দমতো জিনিস। অর্থাৎ যে জিনিসের বাজার আছে, যে জিনিস বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা ঘরে তোলা যাবে। আর এই জন্য দরকার চুক্তি চাষ। দ্বিতীয় আইনে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। চুক্তি হবে কাদের মধ্যে? বহুজাতিক কোম্পানির সাথে দুই“তিন বিঘা জমির মালিকদের। দাম ঠিক করবে কে? বহুজাতিক কোম্পানি। পণ্যের গুণমান ঠিক করবে কে? বহুজাতিক কোম্পানি। আইনে বলা হয়েছে, কৃষকের কাছ থেকে পণ্য নেওয়ার সময় তিন ভাগের দু’ভাগ দাম দিতে হবে। বাকি টাকা পণ্যের গুণমান ঠিক করার পর দিতে হবে। এখানেই তো মার। কোম্পানিগুলো তো সততার মূর্ত প্রতীক নয়। তারা বলবে তোমার পণ্য উপযুক্ত গুণমানের নয়। ফলে আর কোনও টাকা পাবে না। কী করবে কৃষক? এই সব বহুজাতিক কোম্পানির সাথে সে আইনি লড়াই করে পারবে? চোখের জলে বুক ভাসিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে তাকে পথে বসতে হবে। যে সব দেশে চুক্তিচাষ জোর কদমে চালু হয়েছে, সেই ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতা এ কথাই বলে।

এই ভাবে সমস্ত কৃষিজ দ্রব্যের উপর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর ওরা কী করবে? ওরা কৃষকের কাছ থেকে জলের দরে কৃষিপণ্য কিনবে এবং চড়া দামে তা সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করবে। চাষি থেকে ক্রেতা সকলেই শোষিত হবে। এই ভাবে মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলবে ওরা। ইচ্ছা করলে বাজারে মালের জোগান কমিয়ে দিয়ে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে অনেক বেশি বেশি মুনাফা ঘরে তুলবে ওরা। তৃতীয় আইনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থাই করা হয়েছে।

বেসরকারিকরণ করে বহুজাতিক পুঁজির হাতে শিক্ষা-স্বাস্থ্য সহ অন্যান্য ক্ষেত্র তুলে দেওয়ার বিষময় ফল কী, তা আমরা সবাই জানি। এই সব এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। টাকার অভাবে করোনা রোগীকে নার্সিংহোমের বাইরে বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়, এমন ঘটনাও আমরা প্রত্যক্ষ করছি। পুঁজিপতিদের কাছে এ ছাড়া অন্য কিছু আশা করা যায় না। মুনাফা ছাড়া এই দুর্বৃত্ত পুঁজিবাদ আর কিছু বোঝে না। এদের হাতে যদি চাল গম ডাল তৈলবীজ আলু সব্জি ফল দুধ হাঁস মুরগি ছাগল শুয়োর মাছ পাট তুলো পশুখাদ্য ইত্যাদির একচেটিয়া অধিকার চলে যায় তা হলে জনজীবনে যে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নেমে আসবে, তা ব্যাখ্যা করে বোঝাবার প্রয়োজন নিশ্চয়ই নেই।

কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার জনজীবনে এই সর্বনাশ নামিয়ে আনছে, নামিয়ে আনছে পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের পথ অনুসরণ করে, তাকে আরও বীভৎস রূপে কার্যকর করে।

এরই বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে দেশের বিভিন্ন কৃষক সংগঠনগুলোর সাথে একযোগে ২৫ সেপ্টেম্বর এআইকেকেএমএস গ্রাম ভারত বনধ-এর ডাক দিয়েছে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর ঘোষ এই বনধকে সর্বাত্মক সফল করার আহ্বান জানিয়েছেন।

(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ৬ সংখ্যা_২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০)