কলেজে কলেজে লাগামছাড়া তোলাবাজি নেতাদের অজান্তে নয়

নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে দলীয় সভায় মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘টাকা তোলা ছাত্রদের কাজ নয়’৷ এ কথা তিনি বললেন নিজের দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের উদ্দেশে৷ কিন্তু এই সভার পরেও রাজ্যের কলেজে কলেজে তোলাবাজির যে কদর্য চিত্র ফুটে উঠল, তাতে বোঝা গেল তাঁর বার্তায় কোনও কাজ হয়নি৷ শুধু বোঝা গেল না, নেতাজি ইনডোর থেকে ফিরে এসে তাঁর দলের ছাত্রনেতারা যে আরও উৎসাহে টাকা তুলতে লেগে গেল, তা কার ‘অনুপ্রেরণায়’?

বোতল থেকে দৈত্য একবার বেরিয়ে পড়লে তাকে আর বোতলে ঢোকানো যায় না৷ কলেজে ভর্তির তোলাবাজির ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই৷ ছাত্র–অভিভাবকদের উদ্বেগকে কাজে লাগিয়ে গোছা গোছা টাকা তোলার এমন সহজ রাস্তার খোঁজ পেয়ে যাওয়া তৃণমূল ছাত্রপরিষদের নেতাদের ক্ষেত্রে কলেজ গেটে সতর্কতামূলক ব্যানার, সোস্যাল মিডিয়ায় প্রশাসনিক আশ্বাস, পুলিশি পাহারা, কোনও টোটকাতেই কাজ হচ্ছে না৷ পাশ করার আনন্দ ভুলে উদ্বিগ্ন ছাত্রছাত্রীরা অসহায় বাবা–মায়ের হাত ধরে আসছে কলেজে গেটে৷ অনেক কষ্টে অ্যাডমিশন ফি জোগাড় হয়েছে, কিন্তু তালিকায় নাম থাকলেও কাউন্সেলিংয়ের চৌকাঠ পার হওয়া যাবে না, টাকা চাই, টাকা– অনেক টাকা৷ পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতোই কলেজের গেটে গেটে ‘উন্নয়ন’ দাঁড়িয়ে আছে৷ মায়ের কানের দুল কিংবা বাবার শেষ সম্বল দু’বিঘা জমি বিক্রি করে দিয়ে এদের তুষ্ট না করলে ‘উন্নয়ন’ নড়ে না৷ কলেজের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছাত্রনেতা নামধারী ক্রিমিনালরা৷ কলেজের এক কোণে কিংবা পাশের গলিতে ভর্তির প্রলোভনে ডেকে নিয়ে গিয়ে কেড়ে নিচ্ছে অরিজিন্যাল মার্কসিট, অ্যাডমিট কার্ড৷ টাকা না দিলে সেগুলো ফেরতও পাওয়া যাবে না৷

একের পর এক অসংখ্য এমন ঘটনা যখন সামনে আসতে থাকল, সংবাদমাধ্যমে কিছুটা হইচই শুরু হল, রাজ্য জুড়ে সাধারণ মানুষ সরকারের শিক্ষাদপ্তর, মন্ত্রী–নেতাদের কাঠগড়ায় তুলতে থাকল তখন হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রী একটি কলেজে পৌঁছে গেলেন৷ পৌঁছে তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষের কৈফিয়ত তলব করলেন? ভর্তি হতে আসা ছাত্রদের সাথে কথা বললেন? না, এসব কিছুই তিনি করলেন না৷ কয়েক মিনিটের মধ্যে কলেজের গেটে এসে সংবাদমাধ্যমে ছবি তুলে জানিয়ে দিলেন, পুলিশকে বলে দিয়েছি ব্যবস্থা নিতে৷

এর মধ্যে পুলিশ আসছে কোথা থেকে? তাঁর দলের ছাত্রনেতারা কলেজে ঘাঁটি গেড়ে প্রশাসনের এক অংশের যোগসাজশে অসহায় ছাত্রছাত্রীদের থেকে যথেচ্ছ টাকা তুলবে, আর সেটা আটকাবে– কলেজ কর্তৃপক্ষ নয়, দলের নেতারা নন– পুলিশ? ছাত্র–অভিভাবকদের সাথে এর থেকে নির্মম রসিকতা আর কী হতে পারে? তাই শিক্ষামন্ত্রীও কয়েকটি কলেজে নাম কা ওয়াস্তে ঘুরে এসে জানিয়ে দিলেন, কোথাও কোনও দুর্নীতি নেই৷ কেউ এক পয়সাও দাবি করেনি৷ কতখানি নীতিহীন হলে একটি শাসক দলের নেতা–মন্ত্রীরা ছাত্রস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ছাত্রনেতা নামধারী দলের তোলাবাজদের এমন করে আড়াল করতে পারে?

 মুখ্যমন্ত্রী দেখাতে চান, এই দুর্নীতি–তোলাবাজি বন্ধ করতে তাঁরা কত আন্তরিক মানুষকে এতই বোকা ভাবেন ওঁরা৷ মনে করেন এসব লোক–দেখানো নাটক মানুষ বোঝে না৷ না হলে এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য, কলেজে কলেজে দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা কী করে তা মুখ্যমন্ত্রী জানেন না, শিক্ষামন্ত্রী জানেন না? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, দল তথা মুখ্যমন্ত্রী ছাত্রনেতাদের এই তোলাবাজি বন্ধ করতে চাইছেন অথচ করতে পারছেন না? শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, একটাও অভিযোগ জমা পড়েনি, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ কে অভিযোগ করবে? কার বিরুদ্ধে কোথায় অভিযোগ করবে? যে দাদা এতক্ষণ আসন নিয়ে দরদাম করছিল, ‘অন্যদের থেকে আশি হাজার নিয়েছি, তুই এত করে বলছিস, সত্তরের নিচে এক পয়সা কম হলে হবে না’, সেই দাদাই তো কলেজের ‘স্বচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া’ মন্ত্রীকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল৷ আর মন্ত্রী বলছেন, টাকা যারা চাইছে তারা বহিরাগত৷ ভাবখানা এমন, এই ‘বহিরাগত’দের সাথে ওঁদের কোনও সম্পর্ক নেই৷ কিংবা তারা বহিরাগত হলে সরকারের আর কোনও দায়িত্ব থাকে না৷ বাস্তবে এই বহিরাগতরা তো তাঁদের দলেরই লোক৷ এদের সাথে কলেজের কেন, শিক্ষাজগতের কোনও সম্পর্ক না থাকলেও এরাই বাস্তবে কলেজ চালায়৷ এরাই কলেজের শিক্ষিকাকে জগ ছুঁড়ে মারে, অধ্যাপককে চড় মারে, অধ্যক্ষাকে গালিগালাজ করে– এরাই শাসক দলের সম্পদ৷

কলেজগুলির সংসদের দখল রাখতে ছাত্রদের যে সমর্থন দরকার সেই সমর্থন আদায় করার মতো কোনও নীতি বা আদর্শের বালাই শাসক দলের নেই৷ তা হলে উপায়? উপায় গায়ের জোর, গুন্ডামি, দাদাগিরি,  বিরোধী ছাত্র সংগঠনকে কলেজের ত্রিসীমানায় আসতে না দেওয়া৷ কিন্তু এই ভাবে দাদাগিরি করে কলেজের দখল যারা এনে দেবে তারা কী পাবে? তাদের পাওয়ার জন্যই তোলাবাজির এমন ব্যবস্থা৷ পাবলিকের পকেট কেটে যা–খুশি লুটে নাও৷ দেখেও কেউ দেখবে না৷ বরং কীভাবে তা আড়াল করা যায় তা নেতা–মন্ত্রীরা দেখবে৷ কিন্তু তৃণমূল নেতারা ভুলে যাচ্ছেন, জনগণ সব দেখছেন৷ এই লুটপাঠ, এই তোলাবাজি আপাতত তাদের সুবিধা দিলেও এর জবাব জনগণ চাইবেই৷ সিপিএম নেতারাও একদিন এমন করেই মনে করেছিলেন কেউ কিছু দেখছে না, কেউ কিছু করতে পারবে না৷ আজ তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে৷ তৃণমূল নেতাদের ইতিহাসও অন্য রকম কিছু হওয়ার নয়৷

(৭০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা ১৩ জুলাই, ২০১৮)