করোনাকেও সাম্প্রদায়িকতার হাতিয়ার বানানো হচ্ছে

সমগ্র বিশ্ব করোনাঅতিমারির আতঙ্কে কম্পমান। মৃতের সংখ্যা লক্ষের ঘরে প্রবেশ করেছে। এ দেশেও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ আশা করেছিল ধর্ম, জাতি, ভাষার বিভাজন ভুলে দেশবাসীকে একসঙ্গে এই যুদ্ধে সামিল করানোর চেষ্টা হবে। বিদ্বেষ ভুলে সমগ্র সমাজকে নিয়ে এগোনোর চেষ্টা হবে। কিন্তু এই ভ্রান্ত ধারণা কাটতে বেশি সময় লাগল না যখন দেখা গেল দিল্লির নিজামুদ্দিনে তবলিগি জামাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে করোনা ভাইরাস-এর সাম্প্রদায়িকীকরণ ও ধর্মীয়করণ ঘটল। বিজেপির আইটি সেল, তার নেতারা, মন্ত্রীরা, চাটুকার সাংবাদিকরা নানা ফেক ভিডিও ও পোস্টের মাধ্যমে তবলিগি জামাতের ঘটনাকে নিয়ে এমনভাবে উঠে পড়ে লেগে গেল যেন করোনা ভাইরাস দিল্লির নিজামুদ্দিন মার্কেজ থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, মোদি সমর্থক নিউজ চ্যানেলগুলি প্রচার করতে থাকল, করোনার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর লড়াইকে ব্যর্থ করার জন্য সাবোতাজ করার চেষ্টা চলছে। তবলিগি জামাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীকে চক্রান্তকারী, দেশবিরোধী বলে প্রচার চালানো হতে থাকল। ওই পণ্ডিতপ্রবররা এতদূর পর্যন্ত বলছেন যে, এর প্রস্তুতি নাকি এক বছরেরও বেশি আগের। যখন সিএএ হয়নি, শাহিনবাগ তৈরি হয়নি, এমনকি করোনা নিয়েও কোথাও কোনও শব্দ উচ্চারিত হয়নি, তখন নাকি এ দেশে এরকম এক আত্মঘাতী জীবাণুর ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এই বিদ্বেষ প্রচারের ফলে দেশের নানা জায়গায় মুসলিমদের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটতে শুরু করল।

কেউ বলছে না, তবলিগি জামাত যা করেছে ঠিক করেছে। তারা যে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। তাই মার্চ মাসের মাঝামাঝি তাদের অধিবেশন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অংশগ্রহণকারীদের ফেরত পাঠানোরক্ষেত্রেও গাফিলতি দেখা গেছে। কিন্তু শুধু নিজামুদ্দিন কেন, কেন্দ্রীয় সরকারের সেই সময়ের আচরণ ও বক্তব্যে কি দেশের মানুষ একই জিনিস দেখেনি? ভারতে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের ঘটনা ঘটে ৩০ জানুয়ারি। জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্রিনিং শুরু হলেও করোনাজনিত এই পরিবেশের মধ্যে ট্রাম্পের ভারত আগমনকে কেন্দ্র করে লোক ভর্তি স্টেডিয়ামে উৎসব পালন করোনা জনিত পরিস্থিতির গুরুত্বকে কি হালকা করে দেয়নি? এমনকি ১৩ মার্চ, যে দিন তবলিগি জামাতের অনুষ্ঠান শুরু হয় সেই দিন কেন্দ্রীয় সরকার বিবৃতি দেয় যে, ‘ভারতে করোনা জাতীয় বিপর্যয় নয়, হেলথ এমার্জেন্সি নয়। ভয় পাবার কিছু নেই।’ সেদিন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের বিবৃতি অনুযায়ী পরিস্থিতিতে যদি সত্যিই ভয় পাবার মতো কিছু না-ই থেকে থাকে তা হলে ওই সময় ঘটা তবলিগি জামাতের জমায়েতকে আসামির কাঠগড়ায় তোলা যায় কি? একই সময় মহারাষ্ট্র সরকার সে রাজ্যে তবলিগি জামাতের সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে থাকে তা হলে অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশ এই অনুমতি দিল কেন? মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল দেশমুখ প্রশ্ন তুলেছেন, সেদিন মধ্য রাতে তবিলিগি জামাতের সাথে বৈঠকে জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা অজিত দোভাল কেন গিয়েছিলেন? বৈঠক করার কথা তো দিল্লি পুলিশ কমিশনারের! তা ছাড়া দোভালের সাথে বৈঠকের পরেই তবলিগি প্রধান নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন কী ভাবে? তবে কি ওই বৈঠকের সাথে এই নিরুদ্দেশ হওয়ার কোনও যোগ আছে? এ সব প্রশ্নের কোনও উত্তর কিন্তু সরকারের থেকে দেশের মানুষ পায়নি। তা ছাড়া, নিজামুদ্দিন থানার পাশেই কী করে এই ঘটনা ঘটতে দেওয়া হল? মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীনের মতো কোভিড-১৯ আক্রান্ত দেশ সহ মোট ৩০০ জন বিদেশি প্রতিনিধিকে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার ভিসা ভারত সরকার কেন দিল? যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক দাবি করছে, এই বিদেশিরা পর্যটক ভিসার ফাঁকে দেশে ঢুকেছে। কিন্তু আজকের দিনে সুরক্ষায় এত বড় ফাটল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনের ব্যর্থতাকেই স্পষ্ট করে দিল না কি?

করোনা আক্রান্ত দেশ ইরান এবং আরব থেকে মুসলিম তীর্থযাত্রীদের বিমানে ভারতে ফেরত আনার সময় একটা মহল থেকে খুবই হালকা স্বরে প্রচার করার চেষ্টা হল যে, মুসলিম দেশগুলো থেকে আমরা সংক্রমণ আমদানি করছি। কিন্তু যখন ইতালি, ব্রিটেন সহ নানা আক্রান্ত দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত হিন্দু উচ্চশ্রেণির মানুষজনকে দেশে ফেরানো হল এবং বাস্তবে এদের মধ্য দিয়ে করোনার আগমন ঘটল তখন ধর্মের কথা উঠল না কেন? কলকাতায় লন্ডন-ফেরত যে যুবক এবং তার পরিবার করোনা ধরা পড়ার পর শহর জুড়ে দাপিয়ে ঘুরে বেড়াল সেটা যদি কোনও মুসলিম পরিবার হত তা হলে সেটাকে যে একটা ভিন্ন মাত্রা দেওয়ার চেষ্টা হত তা বলার অপেক্ষা রাখে কি?

তবলিগি জামাতের বেপরোয়া আচরণের জন্য যারা প্রশ্ন তুলছেন, একটি গোটা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে অপরাধী বানিয়ে দিচ্ছেন, ওই সময়ে অন্যান্য ধর্মের সভা বা উৎসব বহাল তবিয়তে চললেও তারা কিন্তু এই বিষয়ে পুরো নীরব। ১০ থেকে ১২ মার্চ, পাঞ্জাবের আনন্দপুর সাহিবে হোলি উপলক্ষে শিখদের পবিত্র উৎসব ও মেলা হোলিমহল্লায় প্রায় দশ হাজার লোকের সমাগম হয়েছিল। সেই উৎসবে ইউরোপ-খ্যাত গ্রন্থি বলদেব সিং নির্বিচারে করোনা ভাইরাস ছড়ান এবং পরে নিজে মারা যান। এরপর আনন্দপুর সাহিবে আশপাশের ২০টি গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে কোয়ার্যান্টাইন করা হয়। ১৬ মার্চ হিন্দু মহাসভার নেতা ও সদস্যরা বেশ কয়েকটি জায়গায় সহস্রাধিক জনসমাগম করে করোনা প্রতিরোধে গোমূত্র পানের আয়োজন করে। উল্লেখ্য, ওই দিনই দিল্লি সরকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা করে। এই সময়ই তিরুপতি মন্দির সহ বহু হিন্দু মন্দিরে তীর্থযাত্রী ছিলেন বা আটকে পড়েছিলেন। এর মধ্যে বহু বিদেশিও ছিলেন। ২২ মার্চ জনতা কার্ফুর দিন স্বাস্থ্যবিধি শিকেয় তুলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেশজুড়ে তাঁর ভক্তের দল থালা-কাঁসর-ঘণ্টা সহযোগে দলে দলে নগর সংকীর্তনে বের হয়। ২৫ মার্চ লকডাউনের দিন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উড়িয়ে দিয়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ঢাকঢোল বাজিয়ে শতাধিক সাঙ্গোপাঙ্গ সহ রামলালা মন্দির অভিযান করলেন অযোধ্যায়। এমনকি রামনবমী উপলক্ষে বহু জায়গায়শোভাযাত্রাও বের হয়। এগুলো নিয়ে সেইসব পেটোয়া সংবাদমাধ্যম কিন্তু একেবারে নিশ্চুপ। যদি জামাত আইন ভঙ্গ করে থাকে তা হলে এই সমস্ত শিখ ও হিন্দু সংগঠন সহ বাকিরা একই অপরাধ করেনি কি?

আসলে বিজেপি নেতারা অস্বীকার করতে পারছেন না যে, দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প-এর ভারত আগমন উপলক্ষে উৎসব, দিল্লির গণহত্যা, মধ্যপ্রদেশ সরকার ভাঙা-গড়ার খেলায় ব্যস্ত থাকতে গিয়ে করোনার ভয়ঙ্করতা নিয়ে সরকারের হালকা মনোভাব এই মারণ ভাইরাসকে অনেকটাই জায়গা করে দিয়েছে। তার ওপর দেশজুড়ে দুর্বল স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, মাস্ক, স্যানিটাইজার, টেস্ট কিট, পিপিইর অভাব। যে আশাকর্মীরা গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবার মেরুদণ্ড তাঁদের ন্য়ূনতম সুরক্ষা ছাড়া কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। লকডাউনে গরিব খেটে খাওয়া মানুষ, পরিযায়ী শ্রমিকরা তাদের কাজের জায়গায় আটকে। তাদের কাজ নেই, খাদ্য নেই, নেই রেশনের কোনও ব্যবস্থা। নেই কোনও সরকারি ব্যবস্থা। এই অবস্থায় লকডাউনকে উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ অনাহারী পরিযায়ী শ্রমিকের দীর্ঘ ঐতিহাসিক পদযাত্রা। সব মিলিয়ে সরকারের ব্যর্থতা তখন একেবারে ফুটে বেরোচ্ছে। ক্রমাগত ধূমায়িত হচ্ছে জনরোষ। কিছুদিন আগে এনপিআর-এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনে দেশব্যাপী ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মানুষের ঐক্য দেশের মানুষ যেমন দেখেছে, শাসক বিজেপিও দেখেছে। সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল শাহিনবাগ আন্দোলন। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে প্রমাদ গুনলেন বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা। প্রমাদ গুনলেন নাগপুরের হেডকোয়ার্টার। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে তারা পুরানো তাসই খেললেন। হিন্দু-মুসলমানের বিভাজনের রাজনীতি আর অপরদিকে করোনার লড়াইয়ে ব্যর্থতা থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে দেওয়া হল থালা বাজানো আর মোমবাতি জ্বালানোর কর্মসূচি। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। মানুষ করোনার লড়াইয়ে সরকারি ব্যর্থতা ভুলে গিয়ে বিভাজনের বিদ্বেষের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও এবারও তারা ব্যর্থ হয়েছে। একমাত্র অন্ধ ভক্ত ছাড়া মানুষ তাদের চালাকি ধরতে পেরেছে। এটা বুঝেই বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা তার দলের নেতা, মন্ত্রী ও পদাধিকারীদের এক ভিডিও কনফারেন্সে বলতে বাধ্য হলেন, ‘করোনা ভাইরাসকে সাম্প্রদায়িক রং কেউ দেবেন না।’

কিন্তু বিভাজনের এমন ষড়যন্ত্র বিজেপি নেতারা বারে বারেই চালাবেন। সাধারণ মানুষকে এগিয়ে এসে তার মোকাবিলা করতে হবে।