এ কোন খাদের কিনারায় দেশকে নিয়ে চলেছে বিজেপি

একটি শিশুর ওপর এমন নির্যাতন চালাতে পারে কোনও মানুষ? পাশবিক নির্যাতনের পর এমন করে তাকে হত্যা করতে পারে কোনও মানুষ? কোনও মানুষ পারে সেই শিশুর জাত কী, ধর্ম কী প্রশ্ণ তুলে তার হত্যাকে সমর্থন করতে? এই প্রশ্নটাই ভাবাচ্ছে তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করা ভারতবাসীকে৷ কোন অন্ধকারের পথে চলতে চলতে এমন সর্বগ্রাসী খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েছে দেশ!

জম্মুর আসিফা, গুজরাতের সুরাতে পাশবিক আক্রমণের শিকার নাম না জানা কিশোরীর ছিন্ন–বিচ্ছিন্ন দেহ, উত্তরপ্রদেশের বিজেপি বিধায়কের শিকার উন্নাওয়ের তরুণী, এমন কত– আরও কত শিশু কন্যা–তরুণী–নারী পাশবিক লালসায় দগ্ধ হয়ে গেলে তবে ‘বেটি বাঁচাতে’ নামবেন প্রধানমন্ত্রী?

জম্মুর শিশুকন্যা আসিফাকে মন্দিরে আটকে রেখে বেশ কয়েকদিন ধরে ধর্ষণ করা হল৷ তারপর ঠাণ্ডা মাথায় খুন করল ওই মানুষদেহধারী পশুর দল৷ তাদের দোসর হয়ে দাঁড়াল পুলিশের একাধিক কর্মচারী৷ যখন এই দুষ্কর্ম চাপা থাকল না, তখন ধর্ষক–খুনিদের হয়ে রাস্তায় নামল হিন্দু ধর্মের স্বঘোষিত অভিভাবক আরএসএস–বিজেপির অন্যতম শাখা ‘হিন্দু একতা মঞ্চ’৷ নরপশুদের মুক্তি চেয়ে মিছিলে সামিল হলেন জম্মুর দুই বিজেপি মন্ত্রী চন্দ্রপ্রকাশ গঙ্গা এবং লাল সিংহ৷ এক বিজেপি নেতা এতে পাকিস্তানের চক্রান্ত খুঁজে পেলেন আর এক বিজেপি নেতা ফেসবুকে পোস্ট করে দিলেন, যা হয়েছে তা ভালই হয়েছে৷ কে বলতে পারে এই মেয়েই একদিন পুলিশের দিকে পাথর ছুঁড়ত না প্রধানমন্ত্রী, অনেক টালবাহানার পর আপনি বলেছেন, আপনি বেটিদের বাঁচাবেন অথচ আপনার দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ জম্মুতে গিয়ে হিন্দু একতা মঞ্চের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের অভয় দিয়ে এসেছেন৷

উত্তরপ্রদেশের উন্নাওতে বিজেপি বিধায়ককে ভাইয়া বলে ডেকেছিল যে মেয়ে তাকে দীর্ঘদিন ধরে আটকে রেখে ধর্ষণ করল বিজেপির সেই বিধায়ক কুলদীপ সিংহ সেঙ্গার এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা৷ বিষয়টি জানাজানি হয়ে যেতে নির্যাতিতা তরুণীর পরিবারকে চাপ দেওয়া হল অভিযোগ তুলে নিতে৷ উত্তরপ্রদেশের পুলিশ প্রধান বলে দিলেন, বিধায়ক সম্মানীয় ব্যক্তি, তাঁর সম্মান রক্ষা করতে হবে, এফআইআরেও নাম রাখল না পুলিশ৷ নির্যাতিতার বাবাকে বিধায়কের ভাইয়ের নির্দেশে তুলে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে খুন করা হল পুলিশের হেফাজতেই৷ হাইকোর্ট আদেশ দেওয়ার আগে পর্যন্ত নির্বিকার থাকল, তদন্তটুকুও শুরু করল না রামরাজ্যের কর্ণধার যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হতে বিজেপি বিধায়ককে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ৷ তারপরেও জেলবন্দি বিধায়ক এবং তার ভাইয়ের তরফ থেকে চরম পরিণতির হুমকি পাচ্ছে নির্যাতিতার পরিবার৷

এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের ভাইব্র্যান্ট গুজরাটের সুরাতে এক কিশোরীর ওপর যে ধরনের নির্যাতন চলেছে, তাকে পাশবিক বললে পশুকেও অপমান করা হয়৷ এমন ঘটনা শুধু ঘটাতে পারে মনুষ্যত্বহীন মানবদেহধারী কিছু পশুই৷ একটা ঘটনা শেষ হতে না হতেই হরিয়ানার রোহতক, দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গে পর্যন্ত অসংখ্য নারী নির্যাতন–ধর্ষণ–খুনের ঘটনা যেন স্রোতের মতো সামনে আসছে৷ কিন্তু কোন পরিস্থিতি বিরাজ করলে ধারাবাহিকভাবে এমন পশুদের সৃষ্টি করে সমাজ? দেশের ৪৯ জন প্রাক্তন আমলা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে বলেছেন, ‘আট বছরের মেয়ের ধর্ষণ ও খুনের হিংস্রতা ও বর্বরতা বুঝিয়ে দিচ্ছে আমরা কতটা নিচে নেমেছি৷ স্বাধীনতা–উত্তর ভারতে এটাই সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়৷ … এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আমরা কোথাও আলো দেখছি না৷ লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে৷’ তাঁরা আরও লিখেছেন, ‘উত্তরপ্রদেশের উন্নাও৷ সেখানে পিতৃতন্ত্র আর সামন্ততন্ত্রের নিকৃষ্টতম ঘরানার মাফিয়া ডনদের উপরেই ভোট আর ক্ষমতা দখলের জন্য নির্ভর করা হয়৷ ধর্ষণ–খুন আর তোলাবাজির স্বাধীনতাকেই এই মাফিয়ারা নিজস্ব ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রকৃষ্ট উপায় বলে মনে করে৷’

এই বিকৃতি বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী রাষ্ট্রে আছেই৷ কিন্তু তা আরও ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছচ্ছে আরএসএস–বিজেপির মধ্যযুগীয় ধর্মীয় কূপমণ্ডুক দৃষ্টিভঙ্গিতে পুরুষতন্ত্রের চোখ দিয়ে মেয়েদের কেবল ভোগের বস্তু হিসাবে দেখার মানসিকতা সমাজকে ছেয়ে ফেলছে বলে৷ আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী দর্শনের মূল কথার মধ্যেই আছে মেয়েদের জন্মই পুরুষের সেবার কাজে৷ পুরুষ যদি মেয়েদের উপর কিছু অন্যায়ও করে তার জন্য দায়ী মেয়েরাই৷ কিছুদিন আগে দিল্লির নির্ভয়া ঘটনার সময় আরএসএস–বিজেপির একের পর এক নেতা এমন সব কথাই বলেছিলেন৷ হরিয়ানায় এক তরুণীর গাড়ি ধাওয়া করে বিজেপি নেতার ছেলে মেয়েটির শ্লীলতাহানি করলে এক মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এই সব একটু আধটু ভুলের জন্য ছেলেদের ক্ষমা করে দিতে হয়৷’ অন্যান্য বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের মানসিকতাতেও এই ধরনের চিন্তা গেড়ে বসে আছে৷ তাই এই কদর্য মানসিকতার প্রসার ঘটতে পারছে সহজেই৷ একইসাথে, যে ভাবে হোক ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র লোভ চরিতার্থ করতে এইসব লম্পটদের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে৷ অন্যদিকে যুব সমাজকে মদ–মাদকের নেশা, বিকৃত যৌনতার ঘূর্ণিতে ফেলে সম্পূর্ণ দিশাহারা করে দিয়ে তাদের যথেচ্ছ ব্যবহার করছে বিজেপি–কংগ্রেসের মতো ভোটবাজ বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি৷ সমস্ত ধরনের নীতি–নৈতিকতা, পারিবারিক সম্পর্কের মাধুর্য, বন্ধুত্ব, ভালবাসা সহ সমস্ত সুকুমার বৃত্তিকে পুরোপুরি সমাজ থেকে মুছে দেওয়ার কাজে সচেষ্ট পুঁজিপতি শ্রেণি৷ একাজে তাদের হাতিয়ার ভোটবাজ দলগুলির নীতিবর্জিত রাজনীতি৷ এর সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপক প্রসার সমাজে টিকে থাকা ছিটেফোঁটা মনুষ্যত্বকেও ধুয়ে মুছে সাফ করে দিচ্ছে৷

এই গভীর অন্ধকারের মধ্যেও আশার আলো দেখিয়েছে দেশ জোড়া স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ৷ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদে নেমেছেন৷ একদিন হিন্দু–মুসলমানের দাঙ্গার মধ্যে মন্দির–মসজিদের সামনে মৃত শিশুর লাশ কোলে ভিখারিনী মাকে দেখে নজরুলের কলম গর্জে উঠে বলেছিল– এতেও দেবতা টললেন না, মসজিদ থেকে কোনও শক্তি এসে মায়ের চোখের জল মোছালো না৷ তিনি মানবতাকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান৷’ জম্মুর শিশু আসিফার উপর মন্দিরের মধ্যেই অত্যাচার করতে পেরেছে তথাকথিত ধর্মধ্বজীরা, তাকে রক্ষার দায়িত্ব ছিল যে পুলিশ–প্রশাসনের তারাও দায়িত্ব পালন না করে দুষ্কৃতীদের পক্ষ নিল৷ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, যাদের দায়িত্ব জনস্বার্থ রক্ষা করা, তারা উৎপীড়কের ভূমিকায়৷ মানুষের সামনে তবে কোন পথটি খোলা থাকল? প্রতিবাদ, জোরালো প্রতিবাদ ছাড়া? এই প্রতিবাদই মনুষ্যত্বের শিখাটিকে জ্বালিয়ে রেখে মানুষকে পথ দেখাতে পারে৷ এই শিখাকে যে কোনও মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে৷ ঘোর অন্ধকারের মাঝে সেটাই আশার আলো৷

(৭০ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা ২০ এপ্রিল, ২০১৮)