এর নাম নাকি প্রজাতন্ত্র!

১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি নতুন সংবিধান গ্রহণ করে ভারত রাষ্ট্রের নাম দেওয়া হয়েছিল প্রজাতন্ত্র৷ প্রতি বছর দিনটিকে ঘটা করে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে পালন করা হয়৷ দিল্লির রাজপথে, রাজ্যে রাজ্যে সেদিন সমারোহ আর আড়ম্বরের শেষ থাকে না৷ কিন্তু প্রজাতন্ত্রে প্রজাদের স্থানটি কোথায় তা আর এই সমারোহ–আড়ম্বরের আড়ালে ঢেকে রাখা যাচ্ছে না৷ যত দিন যাচ্ছে ততই প্রকট হয়ে বেরিয়ে এসেছে প্রজাতন্ত্রের অন্তঃসারশূন্য, কঙ্কালসার চেহারাটি৷ সেই চেহারাটাকেই একেবারে বেআব্রু করে দিল এ বারের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের মঞ্চে আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘অক্সফ্যাম’–এর এক সমীক্ষা রিপোর্ট৷ তাতে বলা হয়েছে, ভারতের মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশ কুক্ষিগত করেছে এক শতাংশ ধনকুবের৷ গত এক বছরে তাদের সম্পদ বেড়েছে ২০.৯ লক্ষ কোটি টাকা৷ টাকার এই পরিমাণটা ২০১৭–১৮ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটের সমান৷

ওই সমীক্ষাতেই প্রকাশ পেয়েছে, দেশে ধনী–দরিদ্রের ব্যবধান কী ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে৷ ভারতে একশো কোটি টাকার মালিকের সংখ্যা এ বছর একশো ছাড়িয়ে গেছে৷ গত এক বছরেই ১৭ জন এমন শত–কোটির মালিক হয়েছে৷ অর্থাৎ দেশের একশো তিরিশ কোটি মানুষ উদয়াস্ত কঠোর পরিশ্রম করে যে সম্পদ প্রতিদিন তৈরি করছে, তা নিঃশেষে লুঠ করছে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি৷ এ চিত্র শুধু পুঁজিবাদী ভারতেরই নয়৷ সারা পুঁজিবাদী বিশ্বেরই পরিস্থিতি প্রায় একই রকম৷ ২০১৭ সালে গোটা বিশ্বে তৈরি হওয়া সম্পদের ৮২ শতাংশ কুক্ষিগত এক শতাংশ পুঁজিপতির হাতে৷ আর, দারিদ্রসীমার সবচেয়ে নিচে বসবাসকারী পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ, অর্থাৎ প্রায় ৩৭০ কোটি মানুষের সম্পত্তি বাড়েনি এতটুকুও৷ বৈষম্যটা আরও স্পষ্ট হয় এই তথ্যে যে, এ দেশে পোশাক সংস্থার সব থেকে বেশি বেতন পাওয়া শীর্ষ কর্তার এক বছরের আয়ের সমান আয় করতে গ্রামাঞ্চলে ন্যূনতম মজুরি পাওয়া এক কর্মীর লাগবে ৯৪১ বছর৷ মার্কিন মুলুকে এক জন সিইও তথা শীর্ষকর্তা প্রায় এক দিনেই পান সে দেশের সাধারণ কর্মীর বছরভরের রোজগার৷

কী সীমাহীন এই বৈষম্য, কী নির্মম, কী কুৎসিত একদিকে দেশের কোটি কোটি মানুষ খাদ্যের জন্য হাহাকার করছে, বিনা চিকিৎসায় মরছে, অশিক্ষার অন্ধকারে পড়ে রয়েছে, খোলা আকাশের নিচে জীবন কাটাচ্ছে৷ অন্য দিকে মুষ্টিমেয় ধনকুবেরদের সম্পদের পাহাড় ক্রমশ আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে৷ পুঁজিবাদী উন্নয়নের মূল্য চোকাতে কোটি কোটি মানুষ গৃহহীন হয়ে, সম্পদহীন হয়ে শহরের বস্তিতে, নিকাশি খালের ধারে, নর্দমার ধারে, ফুটপাথে অমানুষের জীবনযাপন করছে৷ অপমানিত নারীত্বের হাহাকারে দেশের বাতাস ভারি হয়ে উঠছে৷ অপুষ্টিতে, শিশুমৃত্যুতে দেশ বিশ্বে শীর্ষে৷ ধনকুবেরদের মুনাফার লালসা মেটাতে লক্ষ লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করছে, লকআউট আর ছাঁটাইয়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ভিখারিতে পরিণত হচ্ছে, সপরিবারে আত্মহত্যা করছে৷ সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধের খেলায় কোটি কোটি মানুষ দেশ হারিয়ে বাঁচার আশায় এক দেশে থেকে তাড়া খেয়ে আর এক দেশে ছুটছে, ছুটতে গিয়ে কোথাও সমুদ্রে ডুবে মরছে, সৈন্যদের গুলিতে মরছে, অনাহারে মরছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে৷

প্রশ্ন হল, যদি দেশ সত্যিই প্রজাতান্ত্রিক হয় তবে নিরানব্বই ভাগ মানুষকে এমন চরম অমানুষের জীবনে ডুবিয়ে রেখে এক শতাংশ মানুষ এমন লুঠতরাজ বছরের পর বছর ধরে চালাতে পারছে কী করে? এর মধ্যে কোথায় প্রজাতন্ত্র? এই বীভৎসতা, নির্মমতাকে আটকানোর কী ব্যবস্থা রয়েছে এই প্রজাতন্ত্রে? এর নিয়ম–নীতি, আইন–কানুনের কী কার্যকারিতা রয়েছে? সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ (প্রজা?) শুধু মুখ বুজে পশুর মতো পরিশ্রম করে চলেছে, আর এক দল কোনও পরিশ্রম না করেই এদের পরিশ্রমের ফল লুঠ করে সমস্ত ধনসম্পদের মালিক হয়ে জীবন কাটাচ্ছে৷ এর নাম কি প্রজাতন্ত্র এ তো ধনতন্ত্র– পুঁজিবাদ৷ তাই তো এত বড় অন্যায়ের কোনও প্রতিবিধান, তাকে আটকানোর কোনও উপায় এই ব্যবস্থায় নেই৷ প্রজাতান্ত্রিক নাম নিয়েই তো তার সংবিধানে শোষণ ন্যায়সঙ্গত, মুনাফা ন্যায়সঙ্গত৷ অন্যের পরিশ্রমের ফল তাকে বঞ্চিত করে আত্মসাৎ করা অন্যায় নয়৷ বুর্জোয়া আইনে তাকে আটকানোর কোনও ব্যবস্থা নেই৷ আইন যতটুকু আছে মালিকরা আজ আর তার তোয়াক্কা করে না৷ আইন সকলের জন্য সমান– কথাটা আজ পরিহাস মাত্র৷ধনকুবেররা আজ আইনকে বুড়ো আঙুল দেখায়, আইনই তাদের মর্জিমাফিক চলে৷ রাষ্ট্র আজ একচেটিয়া পুঁজির লেজুড়ে পরিণত৷ রাষ্ট্র এবং সরকারের পূর্ণ মদতেই চলে ধনকুবেরদের এই লুঠতরাজ৷ এই ধনকুবেরদের প্রতিনিধি হিসাবেই দাভোসের মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের পুঁজিপতিদের কাছে এক রঙিন ভারতের ছবি তুলে ধরে ঘোষণা করলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতীয় অর্থনীতির আয়তন দ্বিগুণ বেড়ে ৫ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছাবে৷ প্রধানমন্ত্রী যে উন্নয়নের, যে আর্থিক বৃদ্ধির বড়াই করলেন, তার সাথে দেশের সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কী? তা তো শুধুমাত্র ওই এক শতাংশ অতিধনীদেরই৷ একটা দেশের মধ্যে আসলে আছে দুটো দেশ– একটা ধনীর, আর একটা দরিদ্রের৷ উন্নয়ন হচ্ছে এই ধনীর দেশের এবং তা হচ্ছে ৯৯ শতাংশ মানুষের শ্রমের ফসল চুরি করে৷ তাই তো বৈষম্য এমন সীমাহীন, এমন নির্মম, এমন নির্লজ্জ৷

পুঁজি যত একচেটিয়া স্তরে পৌঁছেছে তার শোষণ ততই নির্মম হয়েছে৷ আর সেই নির্মম লুঠতরাজে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়ছে৷ বেকারত্বে দেশ ছেয়ে যাচ্ছে৷ মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া৷ শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থানের খরচ আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে৷ আগে বাড়ির একজনের রোজগারেই সংসার চলে যেত৷ এখন সারা পরিবার কঠোর পরিশ্রম করেও সংসার চালাতে পারছে না৷ পুঁজিপতি শ্রেণির পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে সরকারগুলি পুঁজিপতিদের লুঠতরাজে সহায়তা করলেও অতীতে সাধারণ মানুষের ন্যূনতম জীবনধারণের জন্য খাদ্যে শিক্ষায় চিকিৎসায় কিছুটা ভরতুকি দিত৷ আজ সে সব বন্ধ করে নগ্নভাবে পুঁজিপতিদের সেবা করছে৷ তাই যত দিন যাচ্ছে ততই মানুষ দারিদ্রের গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে আর পুঁজিপতিদের মুনাফা উল্কাগতিতে বেড়ে চলেছে৷

আজ বিশ্বের কোথাও কোনও পুঁজিবাদী সমাজেই দরিদ্রের দাঁড়াবার এতটুকু জায়গাও নেই, নেই মানুষ হিসাবে সামান্য স্বীকৃতিটুকুও৷ তার একমাত্র পরিচয় সে পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফা উৎপাদনের যন্ত্র৷ তার দুবেলা পেট ভরে খাওয়ার অধিকার নেই, শিক্ষার অধিকার নেই, রোগে চিকিৎসার অধিকার নেই৷ শুধু একটা অধিকারই তার আছে– তাকে শোষণ করবার, নিংড়ে নেবার অধিকার কে পাবে, কিছুদিন অন্তর ভোট দিয়ে তাকে নির্বাচন করার৷ তাই সরকার বদলায়, সরকারের রঙ বদলায়, সরকারের মন্ত্রীরা বদলায়, কিন্তু শোষণ–লুণ্ঠনের বদল হয় না৷

কিন্তু এই কি চলতে থাকবে? নিরানব্বই শতাংশ মানুষের জীবনে এই কি ভবিতব্য? দেশের শোষিত প্রবঞ্চিত ৯৯ শতাংশ মানুষ কি মুখ বুজে চিরকাল তাই মেনে চলবে? সভ্যতার অগ্রগতি কি আজ পুঁজিপতিদের পায়ের তলায় এসে স্তব্ধ হয়ে থাকবে? কোটি কোটি মানুষের বিক্ষোভকে কি উন্নয়নের ঝকমকে আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখতে পারবে শাসক শ্রেণি?

না৷ ইতিহাস তা বলে না৷ শাসক শ্রেণির অত্যাচার যত নির্মম হোক, যত দীর্ঘস্থায়ী হোক, তা কখনও চিরস্থায়ী নয়, তার অবসান হবেই৷ ইতিহাসের তাই নিয়ম৷ হাজার হাজার বছরের নির্মম দাসব্যবস্থার অবসান হয়েছে৷ কয়েক হাজার বছরের রাজতন্ত্র তথা সামন্তব্যবস্থার অবসান হয়েছে৷ পুঁজিবাদ আজ তার আপন দুষ্কর্মের পরিণতিতেই জরাগ্রস্ত, মুমূর্ষু৷ সমাজকে, সভ্যতাকে তার আর দেওয়ার কিছু নেই৷ বরং সে আজ সভ্যতার গতিরোধ করে দাঁড়িয়েছে৷ এই অবস্থায় পুরনো সমাজ আজ নতুন সমাজের জন্ম দেওয়ার গর্ভযন্ত্রণায় ছটফট করছে৷ মহান মার্কস দেখিয়ে গিয়েছেন, পুঁজিবাদ নিজেই নিজের কবর খুঁড়ছে৷ সে যেমন তীব্র শোষণের মধ্য দিয়ে পুঁজির পাহাড় জমিয়েছে, তেমনই শোষণের ফল হিসাবেই তীব্র বাজার সংকটের জন্ম দিয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের বারুদ জমা করেছে৷ তার কবরে মাটি দেওয়ার জন্য জন্ম দিয়েছে শ্রমিক তথা শোষিত শ্রেণির৷ শ্রমিক শ্রেণিই আজ বিপ্লবী শ্রেণি৷ কিন্তু শ্রেণি হিসাবে শ্রমিক শ্রেণি আজও অসচেতন, অসংগঠিত৷ অথচ বিপ্লবের জন্য, সমাজ পরিবর্তনের জন্য, নতুন সমাজের জন্ম দেওয়ার জন্য  সচেতন  হওয়া,  সঠিক  নেতৃত্বে  সংগঠিত  হওয়া  একান্ত জরুরি৷