উগ্র ধর্মান্ধতার সাথে পাকিস্তান বিরোধিতার মিশেল

সংবাদপত্রে সম্প্রতি লক্ষ করা গেল, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এখন পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও শান্তির সম্পর্ক রক্ষা করবে না৷ প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের শাসক শ্রেণি কেন শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক চায় না? ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দৃঢ়তার সঙ্গে, বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিতে পাকিস্তান সহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সাথে আন্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করা হবে৷ বিজেপি সরকারের এই সিদ্ধান্ত কি তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ?

বিজেপির অতীত বলে, কোনও নির্বাচন এলেই তারা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলার চেষ্টা করে৷ ত্রয়োদশ লোকসভা নির্বাচনের আগে ১৩ মাসের বাজপেয়ী সরকার ১৯৯৯ সালে দু’মাস ধরে কার্গিল যুদ্ধ চালিয়েছিল৷ বেশ কয়েকশো সেনা ও সাধারণ মানুষের প্রাণহানির বিনিময়ে প্রবল পাকিস্তান বিরোধী আবহে প্রথমবার গরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়েছিল বিজেপি৷ কার্গিল যুদ্ধ বাজপেয়ী সরকারের আমলে ৮০ টাকা কেজি পেঁয়াজের ঝাঁঝ ভুলিয়ে দিয়েছিল৷ উত্তরপ্রদেশের গত বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে ভারতীয় সেনা পাকিস্তানের ভিতর ঢুকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছিল, এমনটা দাবি করে মোদি সরকার জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ তোলার চেষ্টা চালায়৷ আবার গুজরাটে গত বিধানসভা নির্বাচনের আগেও ঠিক এমনি করে পাকিস্তান বিরোধিতার সুরকে অনেক উচ্চগ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ তা হলে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন এলেই জাতীয়তাবাদী সুর চড়াতে পাকিস্তান বিরোধিতায় নেমে পড়ে বিজেপি সরকার৷ ২০১৯–এর লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়েই কি তবে পাকিস্তান বিরোধিতায় শান লাগাচ্ছে মোদি সরকার?

পাকিস্তান সহ সমস্ত প্রতিবেশী দেশের শাসকগোষ্ঠীও ভারতবিরোধিতার জিগির তুলে নিজেদের জনস্বার্থবিরোধী শাসন আড়াল করে থাকে৷ এটা শাসক বুর্জোয়াদলগুলির বৈশিষ্ট্য একটু বিচার করলেই দেখা যাবে দেশের শাসকদের পাকিস্তান বিরোধিতার সঙ্গে দেশপ্রেমের কোনও সম্পর্ক নেই৷ ভোটব্যাঙ্ক তৈরির লক্ষ্য থেকেই এই জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগের সৃষ্টি৷ কার্গিল যুদ্ধের সময়ে যখন বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, ঠিক তখনই বাজপেয়ীর জামাই পাকিস্তানের সঙ্গে ‘চিনি’ বাণিজ্যে যুক্তছিলেন৷ দুই দেশের পুঁজিপতির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তখনও অটুট৷ এখনও যুদ্ধ যুদ্ধ আবহ সৃষ্টির আড়ালে দু’ দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট মোদি সরকার সে দেশের শাসকের সাথে গোপনে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে৷

বাস্তবে নোট বাতিল–জিএসটি–এফআরডিআই থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসে গণহত্যা, লাগামছাড়া দুর্নীতি এবং বেকারত্ব–মূল্যবৃদ্ধি ২০১৪–র মোদি ঝড় দেশ থেকে কার্যত উধাও৷ মুখ থুবড়ে পড়েছে ‘আচ্ছে দিন’, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’–র গাল ভরা স্লোগান৷ এ সব থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই মোদি সরকার আগামী লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে একদিকে দেশের মধ্যে উগ্র ধর্মান্ধতা–জাতিবিদ্বেষের সাথে পাকিস্তান বিরোধিতার মিশেল ঘটাচ্ছে৷ অপরদিকে জনগণের করের টাকায় আমেরিকা–ইজরায়েল–ফ্রান্স-রাশিয়ার মতো সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর থেকে লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ে যুদ্ধ সরঞ্জাম কিনছে, শিক্ষা–স্বাস্থ্যে বরাদ্দ কমিয়ে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে৷ এতে প্রতিরক্ষা কতটা বাড়বে, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল, কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতির পরিণামে জনজীবন আরও তছনছ হয়ে যাবে৷

আগামী নির্বাচনের মুখে মোদি সরকার পাকিস্তান বিরোধী হাওয়া গরম করার পুরনো খেলায় মেতেছে৷ এর মধ্যে দেশপ্রেমের ছিঁটেফোঁটাও নেই৷

পলাশ মল্লিক, কলকাতা–৬০

(৭০ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা ২০ এপ্রিল, ২০১৮)