ইস্তাহারের ঘোষণা খুব স্পষ্ট

গত বছর মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের এক প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় সরকারই জানিয়েছিল, দেশে প্রতি বছর ১২,০০০ কৃষক আত্মহত্যা করে৷ দেশে প্রতি বছর কোটি কোটি মেট্রিক টন কৃষিজ ফসল উৎপন্ন হয়৷ সে সব যায় কোথায়? কিছু সাধারণ মানুষ কেনে দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য, সেও চড়া দামে৷ আর বাকিটা যায় অ্যাগ্রো–ইন্ডাস্ট্রি অর্থাৎ কৃষিভিত্তিক শিল্পে৷ ভারতবর্ষ যে সুজলা–সুফলা তা এই শিল্পপতিদের দেখেই বোঝা যায়৷ কৃষিজ ফসলের শিল্পপতিরা ফুলে–ফেঁপে ঢোল হচ্ছে ক্রমশ৷ ফি–বছর তাদের কোম্পানিগুলোর নিট লাভের পরিমাণ দেখলে কোনও মতেই বোঝার উপায় নেই যে এদের বিদেশি গাড়ি, বিলাসবহুল বাড়ি ইত্যাদি সব কিছুরই উৎস দেশের নব্বই ভাগ হাড়–জিরজিরে চাষি, যারা ফসলের দাম না পেয়ে দেনার দায়ে আত্মঘাতী হচ্ছে বা তার প্রহর গুনছে৷ যারা চাষির ফসল হাতিয়ে রাঘব–বোয়াল হচ্ছে তারাই আবার এনজিও বানিয়ে ‘কৃষকের কিসে মঙ্গল হয়’ তার গাওনাও গাইছে৷

এই গোটা চক্রটাকে পাহারা দেয় বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার৷ সে জন্যই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন হেলিকপ্টার থেকে নেমে ঝাঁ–চকচকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে কৃষক সেজে বলেন, আমি চৌকিদার, সমঝদারেরা ইশারায় বুঝে যায় তিনি কাদের রক্ষাকর্তা৷ যে নিজেকে যত বড় ধুরন্ধর চৌকিদার প্রমাণ করতে পারে সে তত বড় ‘দক্ষ’ প্রশাসক হয়ে ওঠে৷ তাই দেখুন, লাগাতার কৃষক মারা যাচ্ছে, দেশে অনাহারী অর্ধাহারী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, কোনও টোটকা দিয়ে, ভাষণ দিয়ে, এমনকী গুলি করে খুন করেও সামলানো যখন যাচ্ছে না, তখন একজন দক্ষ প্রশাসকের মতো প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করে দেব’৷ সে জন্য একটা কমিটিও গড়ে ফেললেন৷ কমিটির মাথায় বসালেন এক দুঁদে আমলাকে যিনি সরকারি কোষাগারের বিস্তর টাকাপয়সা খরচ করে ‘চাষির আয় দ্বিগুণ করার পদ্ধতি’ উদ্ভাবন করেছেন৷

কী সেই পদ্ধতি? এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত রিপোর্ট, গাদাগুচ্ছের মিষ্টি মিষ্টি বুকনির আবর্জনা সরিয়ে, দেখা গেল তিনি আদতে বলতে চাইছেন, কৃষিক্ষেত্রে দেশি–বিদেশি বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশের কথাই৷ প্রশ্ন উঠেছে, ‘আয় দ্বিগুণ–করা কমিটিবাবুটি’ কাদের লোক? উত্তরও পাওয়া গেছে, তিনি আর যা–ই হোন, ভারতের মাটিতে সত্তর বছর ধরে তিলে তিলে মরতে থাকা কোটি কোটি হাড়–হাভাতে কৃষকদের কেউ নন৷ কিন্তু কর্পোরেটের হয়ে সরকারি রিপোর্ট লেখার দায় তাঁর থাকতে পারে, আশিভাগ ভারতীয়ের কোনও আগ্রহ তাতে নেই৷ কারণ, ধানের যে সহায়ক মূল্য তারা ঘোষণা করেছেন, তা স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী খরচের দেড়গুণও নয়৷ ফলে এসব ভাঁওতা হালে পানি পাবে না৷

তাই চার বছর ধরে চমকদার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও দেশের আশিভাগ মানুষের মূল সমস্যার সমাধান হল না কেন– এ প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে উঠছে৷ জনগণ ধরে ফেলছেন, ওগুলো ছিল ‘জুমলা’– কথার কথা৷ ২০১৯–এর লোকসভা ভোট যত এগিয়ে আসছে, আচ্ছে দিনের কারবারি নেতা–মন্ত্রীরা প্রশ্নে–বিক্ষোভে জেরবার হয়ে তত প্রলাপ বকছেন৷ আর পাঁচটা বিষয়ে ঘোঁট পাকিয়ে মূল সমস্যা থেকে জনতার নজর ঘোরাতে চাইছেন৷ ধর্মের নামে মানুষ মারছেন, গো–রক্ষার নামে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করছেন৷ শিল্পপতিরা মুচকি হেসে বলছেন, দক্ষ প্রশাসকই বটে!

এই পরিস্থিতিতে কর্পোরেট মিডিয়া, যেমন তারা বরাবরই করে, মানুষের ক্ষোভ সামলাতে বিকল্প এক প্রশাসককে সামনে এনে দিতে চাইছে৷ বিভিন্ন কাগজে রোজ কংগ্রেস সভাপতির একাধিক ছবি এবং তিনি যে একজন খুবই কৃষকদরদি তা প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা চলছে৷ নানা টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন স্লটে আবহসঙ্গীত–সহ তাঁর বাণী পরিবেশিত হচ্ছে৷ কিন্তু কেউ প্রশ্ন করছে না, স্বাধীনতার পর থেকে কত দিন দেশ শাসন করেছে কংগ্রেস? নব্বই ভাগ গরিব কৃষকের জন্য কী করেছে তারা? আজ নরেন্দ্র মোদিকে সরিয়ে রাহুল গান্ধী যদি প্রধানমন্ত্রী হনও, কী উপায়ে তিনি কৃষকের সর্বনাশ ঠেকাবেন? হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মুনাফাখোর এই ব্যবস্থায় সর্বনাশ ঠেকানোর যদি উপায় থাকত, তাহলে বিগত সত্তর বছরে ঠেকানো হল না কেন? খাদ্যশস্য গুদামে পচে নষ্ট হয়ে যায়, তবু গরিব মানুষ খেতে পায় না কেন?

কে দেবে এসব প্রশ্নের উত্তর? কর্পোরেটের আপাদমস্তক গোলাম বিজেপি? কংগ্রেস? যারা দিতে পারে সেই শোষিত–মেহনতি মানুষদের দমনের জন্য পুলিশ–মিলিটারি ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সদা প্রস্তুত হয়ে রয়েছে৷ তবু তারা আছে৷ প্রত্যেক খেতে, প্রতিটি কলে–কারখানায়, রাস্তায় রাস্তায়, তারা আছে এবং লড়াই গড়ে তুলছে৷ পুলিশ–মিলিটারি–গোলা-বারুদ-ট্যাঙ্ক-কামান এক নিমেষে গুঁড়িয়ে দেওয়া তাদের কাছে খুব কঠিন হবে কি? স্মরণে রাখা ভাল, তাদের সংখ্যা কিন্তু অগুন্তি এবং ক্ষোভ অপরিমেয়৷ আর, তাদের সংগ্রামের ইস্তাহারের ঘোষণাও খুব স্পষ্ট– অগণিত নির্যাতিত নিষ্পেষিত কৃষকের নামে শপথ নাও, জোট বাঁধো, তৈরি হও৷

(৭১ বর্ষ ৪ সংখ্যা ২৪ আগস্ট, ২০১৮)