ইউক্রেন থেকে ছাত্রদের উদ্ধারে নয় মন্ত্রীদের নজর শুধুই প্রচারে

শেষ হল কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অপারেশন গঙ্গা।’ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনও শেষ। এতদিন নির্বাচনী সভাগুলোয় নিজেদের ঢাক পেটাতে বিজেপি’র চুনোপুঁটি নেতা থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সকলেই ‘অপারেশন গঙ্গা’র সাফল্য এবং মাহাত্ম্যের প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন। নিজের ঢাক নিজে পেটানোয় কেন্দ্রীয় সরকারের তৎপরতা এবং দক্ষতা ইতিমধ্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত। কাজেই, যাদের লক্ষ করে এই অপারেশন, ইউক্রেনে আটকে পড়া সেই ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের বাস্তব অবস্থা কী ছিল, কতটা সরকারি আনুকূল্য বা সহায়তা পেয়ে তারা দেশে ফিরলেন, তাঁদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করতেই বা কেন্দ্রীয় সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, এসব প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

‘যুদ্ধকালীন তৎপরতা’ বলে একটা কথা আছে। কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে ইউক্রেনে বিপন্ন ছাত্রছাত্রীদের উদ্ধারের কাজে এর সার্থক প্রয়োগ ঘটাতে পারত। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের আশঙ্কা অনেকদিন ধরেই পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। সামরিক অভিযান শুরুর আগেই কেন্দ্রীয় সরকার ভারতীয়দের দেশে ফেরানোর কাজ শুরু করতে পারত। তা হলে যুদ্ধবিধবস্ত বিদেশের মাটিতে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে দিনের পর দিন ভয়াবহ আতঙ্ক আর যন্ত্রণায় কাটাতে হত না। হয়তো এড়ানো যেত কর্ণাটকের ছাত্রটির মর্মান্তিক মৃত্যুও। কিন্তু সে সময় মোদিজি সহ বিজেপি’র নেতা-মন্ত্রীদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল উত্তরপ্রদেশের ভোট। কুর্সিতে বসার তাগিদে সাধারণ পড়ুয়াদের নিরাপত্তার কথা ভাবার সময় পাননি তাঁরা। বরং পরবর্তীকালে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গয়াল বলেছেন, সরকার আগেই নির্দেশিকা দিয়ে চলে আসতে বলেছিল, পড়ুয়ারা কান দেননি। এমন নির্লজ্জ মন্তব্য বিজেপিকেই মানায়। সুদূর ইউক্রেনের মাটি থেকে কয়েক দিনের নোটিশে দেশে ফিরে আসা যেন হাতের মোয়া, তাও আবার যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে এমন একটা সঙ্কটের সময়ে। দেশে ফেরার দায়িত্ব যখন পড়ুয়াদেরই, তা হলে বিদেশের মাটিতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে সরকারি দূতাবাস রাখার দরকার কী?

সংবাদপত্রে, সোস্যাল মিডিয়ায় ইউক্রেনে আটকে পড়া ভারতীয়দের অসহায় অবস্থার কথা জেনে উদ্বিগ্ন হয়েছেন সাধারণ মানুষ। লখনউয়ের ছাত্রী গরিমা মিশ্র বাঁচতে চেয়ে হাতজোড় করে কাতর আবেদন করছেন, এ দৃশ্য নাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের। সকলেই চেয়েছেন, ওরা সুস্থভাবে দেশে ফিরুক। এরই মধ্যে খারকিভের রাস্তায় খাবার কিনতে বেরিয়ে বোমার আঘাতে মৃত্যু হয়েছে কর্ণাটকের ছাত্র নবীন শেখরাপ্পার। যেসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা ইউক্রেনে ছিলেন, এই খবর স্বাভাবিকভাবেই তাদের আতঙ্ক এবং দুশ্চিন্তা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ঠিক এরকম একটা সময় খারকিভের আর এক ভারতীয় ছাত্রী টুইট করে বলেন, ‘গত ছ’দিনে ভারতীয় দূতাবাসের তরফে খারকিভের ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য কিচ্ছু করা হয়নি। এর মধ্যেই আজ একজন ভারতীয় ছাত্র নিহত হলেন। কাল হয়তো আরও ১০০ জন মারা যাবেন। তারপর ১০০০। …বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর কি আমাদের ৮০০০ দেহ ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান?’ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দূরে থাক, এমনকী ভারতীয় দূতাবাস তাদের ফোনও ধরেনি বলে অভিযোগ জানান ওই ছাত্রী। একটি তরতাজা প্রাণের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং অন্য পড়ুয়াদের এই বিপন্নতা পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয়, সরকার যতই লম্বা চওড়া প্রতিশ্রুতি দিক, বাস্তবে তারা নাগরিকদের প্রাণরক্ষার মতো একটি বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে দেরি করেছে এবং স্বভাবতই তাদের আস্থা অর্জনেও ব্যর্থ হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। ইউক্রেন থেকে ফেরা ছাত্রছাত্রীরা দিল্লিতে নেমে যা বলেছেন, তা থেকে বোঝা যায়, আটকে পড়া ছাত্রদের উদ্ধারের চেয়ে কেন্দ্র অনেক বেশি ব্যস্ত ছিল এই উদ্ধারের কৃতিত্ব নেওয়া এবং ‘অপারেশন গঙ্গা’-কে প্রধানমন্ত্রীর বিরাট সাফল্য বলে চালানোর কাজে। ওই ছাত্ররা বলেন, ইউক্রেনের মাটিতে সরকার বা দূতাবাসের কোনও সাহায্য তারা পাননি। তাদের বলা হয়েছিল ইউক্রেনের পিচমে কোনও সীমান্তে পৌঁছে যেতে। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে, প্রবল ঠাণ্ডায়, ট্রেনে বাসে বা মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে তারা কোনও মতে সীমান্তে পৌঁছেছেন। সেখানেও ইউক্রেনের পুলিশ, সেনার হাতে তাদের মার খেতে হয়েছে। বহু স্টেশনে ভারতীয় বলে ট্রেনে উঠতে দেওয়া হয়নি। ভারতীয় দূতাবাসকে জানিয়েও সাহায্য মেলেনি। এতকিছু পেরিয়ে যখন তারা ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশগুলোয় পৌঁছেছেন, তখন তাদের বিমানে চাপিয়ে দেশে ফেরানোর কাজটুকু করেছে মোদী সরকার, যা ছাত্ররা নিজেরাই করতে পারতেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা দিয়ে পথ দেখিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনাই যথার্থ উদ্ধারকাজ। সেটা করার ক্ষমতা নেই, তাই যুদ্ধ নেই এমন দেশগুলোয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা বলেছিলেন শুধুমাত্র ‘অপারেশন গঙ্গা’র ঢাক পেটাতে। ইউক্রেন ফেরত পড়ুয়াদের গোলাপ ফুল দিতে গেলে পড়ুয়াদের এসব অভিযোগের মুখোমুখি কার্যত নীরব দর্শক হয়েই থাকতে বাধ্য হয়েছেন বিজেপির মন্ত্রীরা। এক ছাত্রী সপাটে বলেছেন, ‘কেউ বিমানের ফ্রি টিকিট চায়নি। সবাই ইউক্রেনের মধ্যে সাহায্য চেয়েছিল। সেটাই মেলেনি।’ বায়ুসেনার বিমানে মন্ত্রীদের সাথে ‘মোদিজি কি জয়’ স্লোগানেও গলা মেলাননি বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরা। মিথ্যে বলার তোড়ে এমনকি অন্য দেশের প্রশাসনের কাছেও সমালোচিত হতে হয়েছে কেন্দ্রের মন্ত্রীকে। রোমানিয়ার একটি শহরে গিয়ে বিমানমন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ছাত্রছাত্রীদের বোঝাতে গিয়েছিলেন, ভারত সরকারই তাদের জন্য সব করেছে। শহরের মেয়র তাঁকে বলেন, থাকার জায়গা খাবারের ব্যবস্থা তাঁরাই করেছেন। দিল্লির মন্ত্রী বরং তাদের কী ভাবে দেশে ফেরানো যায়, সেটা নিয়ে ভাবুন। ঘটনা যাই ঘটুক, তথ্য-অভিজ্ঞতা যাই বলুক, নির্লজ্জতার প্রতিযোগিতায় বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের হারায় সাধ্য কার! এতকিছুর পরেও কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী ইউক্রেনে ডাক্তারি পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের কটাক্ষ করে বলতে পেরেছেন, ‘যাঁরা বিদেশে পড়তে যান, তাঁদের নববই শতাংশ এদেশে ডাক্তারি করার যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষায় ফেল করেন।’ অর্থাৎ, ভারতবর্ষ থেকে যে এত ছাত্রছাত্রী বিদেশে ডাক্তারি পড়তে যাচ্ছেন, তার জন্য কংগ্রেস-বিজেপি সহ বিভিন্ন সময় কেন্দে্র ক্ষমতাসীন দলগুলোর ভ্রান্ত শিক্ষানীতির কোনও দায় নেই, যত দায় ছাত্রদের। তারা যেন নিজেদের অপরাধের শাস্তি ভোগ করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে স্বভাবতই এই অমানবিক মন্তব্যের কোনও প্রতিবাদ করা হয়নি। ‘অপারেশন গঙ্গা’ তো শেষ হল। কিন্তু এই ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ? সামনে কোনও নির্বাচন নেই, তাই এ নিয়ে সরকারের মাথাব্যথাও নেই।