আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী মতলব ব্যর্থ করে দিল কিউবার মানুষ

কলকাতায় মার্কিন তথ্যদপ্তরের সামনে বিক্ষোভ। কুশপুতুলে আগুন দেন রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য

সমাজতান্ত্রিক কিউবা দ্বীপরাষ্ট্রটি দীর্ঘদিন ধরে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার চক্ষুশূল। গত ৬০ বছর ধরে কিউবার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে রেখেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। নানা ভাবে দেশটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার সাম্রাজ্যবাদী অপচেষ্টা ব্যর্থ করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো ও অর্থনীতি, সর্বোপরি দেশের মানুষের সমর্থনকে পুঁজি করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কিউবা। সম্প্রতি সরকারবিরোধী বিক্ষোভ সংগঠিত কর়ে কিউবার সুস্থিতি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ১১ জুলাই সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্যে পুষ্ট কিছু ‘বিক্ষোভকারী’ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখায়, সমাজতন্ত্রবিরোধী স্লোগান দিতে থাকে। এতটুকু সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমর্থন করে বিবৃতি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তার সাম্রাজ্যবাদী স্যাঙাৎ ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো। কিন্তু কিউবার সমাজতন্ত্রপ্রিয় জনসাধারণ দেশের প্রেসিডেন্টের ডাকে বিপুল সংখ্যায় পথে বেরিয়ে এসে তথাকথিত সেই বিক্ষোভ প্রতিহত করে। সরকার সমর্থক জনতার স্রোত দেখে আতঙ্কিত সাম্রাজ্যবাদের ভাড়াটে গুণ্ডারা পালিয়ে বাঁচে। আরও একবার ব্যর্থ হয় কিউবার বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র।

অর্থ, অস্ত্র সহ সমস্ত রকমের সাহায্য দিয়ে প্রথমে দেশের মধ্যে বিক্ষোভকারী গোষ্ঠী তৈরি করা, তাদের দিয়ে দেশের সুস্থিতি বিপন্ন করা এবং তারপর ‘স্বৈরাচার দমন’ কিংবা ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার’ ধুয়ো তুলে সেখানে সাম্রাজ্যবাদী হানাদারি চালিয়ে পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেদার লুটপাট চালানো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একটি পুরনো কৌশল। এই কৌশল ব্যবহার করে সে ও তার স্যাঙাৎ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি আফগানিস্তান ও ইরাকের মতো সমৃদ্ধ দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের জীবন দুর্বিষহ করে দিয়েছে। লাতিন আমেরিকাতেও নিজের আধিপত্য বিস্তারে প্রবল সচেষ্ট মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ২০০৪ সালে কিউবারই প্রতিবেশী দেশ হাইতিতে হামলা চালিয়ে সেখানকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে হঠিয়ে দিয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। আজ হাইতির মানুষ প্রবল দারিদ্র, আর্থিক অসাম্য, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হানাহানির মুখে পড়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে।

হরিয়ানার রোহতকে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পলিটবুরো সদস্য কমরেড সত্যবান

এই লাতিন আমেরিকাতেই ১৯৫৯ সালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র চোখে চোখ রেখে সেখানকার মানুষ ফিদেল কাস্তে্রার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করে সমাজতান্ত্রিক সরকার। সেই থেকে ওই অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিউবা। শুরু থেকেই আমেরিকা দাঁতে-নখে পিষে মারার চেষ্টায় কসুর করেনি এই ছোট্ট দেশটিকে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যে বিধিনিষেধ আরোপ, অর্থনৈতিক অবরোধ, জীবাণু যুদ্ধ সহ বহুবার কিউবা বিপ্লবের নেতা ফিদেল কাস্তে্রার প্রাণনাশের ব্যর্থ চেষ্টা– কিউবাকে হাতের মুঠোয় পুরতে কী না করেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির নির্দেশে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা কুখ্যাত সিআইএ কিউবার উদ্বাস্তুদের একটি গোষ্ঠীকে গোপন ট্রেনিং দিয়ে ১৯৬১ সালের ১৪ এপ্রিল কাস্তে্রা সরকার উচ্ছেদে হানাদারি চালিয়েছিল, যেটি ‘বে অফ পিগস অভিযান’ নামে পরিচিত। কিন্তু সে অপচেষ্টা তাদের ব্যর্থ হয়। এই অতিমারি পরিস্থিতিতেও অবরোধ তুলে নেওয়া দূরে থাক, ক্রমাগত আরও কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করে নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে অন্য দেশকেও কিউবার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাধা দিয়ে চলেছে আমেরিকা। গত চার বছরে আমেরিকা কিউবার বিরুদ্ধে নতুন করে ২৪০ রকমের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে, যার জেরে সে দেশের মানুষকে বর্তমানে অত্যন্ত সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

তা সত্ত্বেও এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো ও দেশপ্রেমিক জনসাধারণের সাহায্যে কিউবার উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গোটা বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলির ঈর্ষার কারণ। মার্কিন কোম্পানির বিধিনিষেধকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই ছোট্ট দেশ নিজেরাই কোভিড প্রতিরোধে কার্যকরী ভ্যাক্সিন তৈরি করেছে। শুধু তাই নয়, গত বছর কোভিড বিধ্বস্ত ৫৯টি দেশে মেডিক্যাল টিম পাঠিয়ে স্বাস্থ্য-সহযোগিতার অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে সমাজতান্ত্রিক কিউবা।

কিন্তু দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে চলা অর্থনৈতিক অবরোধের জেরে ও সাম্প্রতিক অতিমারির কারণে পর্যটন শিল্পে ভাটা আসার দরুণ বাস্তবিকই কিউবার মানুষ আজ কিছুটা সমস্যার মুখোমুখি। দেশে খাদ্যভাণ্ডারের পরিমাণ কমে আসছে, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সবসময় মিলছে না, এমনকি বিদ্যুৎ সঙ্কটও দেখা দিচ্ছে। আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাম্রাজ্যবাদী লুটপাটের স্বার্থে সংকটের এই সময়টাকেই বেছে নিয়েছেন। সমস্যায় জেরবার কিউবার মানুষের একাংশের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এই সময়টাকেই তিনি ব্যবহার করতে চেয়েছেন সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চাগিয়ে তুলে দেশের সুস্থিতি বিপন্ন করার অপচেষ্টায়। সাম্রাজ্যবাদী চেলা-চামুণ্ডাদের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচিত সরকার ফেলে দিয়ে কিউবাকে যদি হাতের মুঠোয় এনে ফেলা যায়, তাহলে গোটা লাতিন আমেরিকায় আধিপত্য বিস্তারের পথ অনেকটাই মসৃণ হয় আমেরিকার কাছে। সেই লক্ষে্যই বিপুল অঙ্কের ডলার খরচ করে, কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-কে কাজে লাগিয়ে কিউবার মধ্যে তারা গড়ে তুলেছে বিক্ষুব্ধ মানুষদের একটা গোষ্ঠী। কিউবা থেকে নির্বাসিত দক্ষিণপন্থী একটি গোষ্ঠী সহ আরও কিছু কায়েমী স্বার্থবাদী সহায় হয়েছে তাদের। ১১ জুলাই-এর তথাকথিত এই বিক্ষোভকে কিউবার সমাজতান্ত্রিক সরকারবিরোধী জনগণের বিক্ষোভ বলে তুলে ধরতে তাই চেষ্টার কসুর করেনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সহ তার অপকর্মের সঙ্গী দেশগুলি। তাই এই বিক্ষোভকে সমর্থন করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিবৃতির পরে পরেই ব্রাজিলের দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো বিক্ষোভকারীদের প্রতি সংহতি প্রদর্শনে এগিয়ে আসেন এবং বলেন, কিউবা নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসনে নিষ্পেষিত হচ্ছে। মার্কিন শাসকগোষ্ঠীর একটি অংশ এগিয়ে এসে বলতে থাকে কিউবার মানুষের সাহায্য প্রয়োজন।

সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রের স্বরূপ বুঝতে অসুবিধা হয়নি কিউবার সরকার ও জনগণের। ওই দিনই প্রেসিডেন্ট দিয়াজ-কানাল টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করার আহ্বান জানান দেশবাসীর কাছে। ভাষণে তিনি প্রশ্ন করেন, কিউবার দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের প্রতি এতই যদি দরদ আমেরিকার, তাহলে একের পর এক অবরোধ চাপিয়ে তাদের টুঁটি টিপে ধরছে কেন তারা! সাম্রাজ্যবাদের এই ভাড়াটে গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক মানুষকে পথে নামার আবেদন জানান তিনি। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কাতারে কাতারে সমাজতন্ত্রপ্রিয় কিউবাবাসী জাতীয় পতাকা হাতে রাস্তায় নেমে আসে। মুখে তাদের বিপ্লবের নামে জয়ধ্বনি। গান গেয়ে, স্লোগান তুলে তারা ঘোষণা করে– স্বাধীন কিউবাকে রক্ষার জন্য আমাদের সবটুকু দিয়ে দিতে রাজি আছি। বলেছে, ফিদেল আমরা তোমার। আর এইসব রাস্তা আমাদের। আমরা জিততে এসেছি। জয় আমাদের হবেই। ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সরকারের সমর্থনে স্লোগান দিয়েছেন মহিলারা। গলা মিলিয়েছে রাস্তার মিছিলে। তথাকথিত বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত কিউবার শ্রমিক সংগঠনের এক নেতা বলেছেন, ওদের আক্রমণে আমার মাথায় সাতটা সেলাই পড়েছে। কিন্তু রক্তমাখা পতাকা হাতে নিয়ে এই মিছিলে আমি হাঁটব বিপ্লবকে রক্ষা করার জন্য। কারণ আমি জানি দেশের জন্য মৃত্যু মানে আসলে জীবন লাভ করা।

সমাজতন্ত্র রক্ষায় দৃঢ়পণ দেশপ্রেমিক মানুষের স্রোতে এ দিন খড়কুটোর মতো ভেসে যায় সাম্রাজ্যবাদের ভাড়াটে গুণ্ডারা। আশ্রয় নেয় তাদের গোপন ডেরায়। গোটা দুনিয়ার মানুষ একযোগে ধিক্কার জানায় কিউবার বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকে। দেশে দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে পা মেলায় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ।

ভারতে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর নেতৃত্বে ১৪ জুলাই প্রতিটি রাজ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল হয়। মিছিলে স্লোগান ওঠে, অবিলম্বে কিউবায় সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়– সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার শাসক শ্রেণির সাথে ভারত সরকারের ঘনিষ্ঠতা দেশের মানুষ মেনে নেবে না।

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৪০ সংখ্যা