আফগানিস্তানের ঘটনা আবার দেখাল মৌলবাদীরা সাম্রাজ্যবাদের মিত্রই

বিশ্বের মানুষ অবাক হয়ে দেখল,একটানা ২০ বছর দখলদারি এবং পুতুল সরকারের মাধ্যমে আফগানিস্তান শাসন করার পর মার্কিন শাসকরা সব গুটিয়ে ফিরে গেছে। মার্কিন বাহিনীর হাতে অত্যাধুনিক ট্রেনিং প্রাপ্ত ৩ লক্ষ আফগান সরকারি সেনা এবং ১৪ হাজারের মতো মার্কিন সেনা ছাড়াও ন্যাটোভুক্ত আরও বেশ কয়েকটি দেশের সেনা, ৬০ হাজার তালিবানের কাবুল দখলের বিরুদ্ধে কার্যত কোনও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টাই করেনি। আফগান সেনাবাহিনী যেন অপেক্ষা করে ছিল, কখন তালিবান এসে তাদের দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয়! মার্কিন শাসকদের বসানো পুতুল সরকারের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি আহমদজাই জনগণকে অসহায় অবস্থায় রেখে লুটের বখরা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এখন তালিবান যোদ্ধারা মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র, ট্যাঙ্ক, আর্মার্ড কার, হেলিকপ্টার নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, প্রবল প্রতাপশালী মার্কিন বাহিনী সব অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে গেছে– এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? যে মার্কিন বাহিনী চাইলে একটা সুইচ টিপেই হাজার হাজার মাইল দূরে নির্দিষ্ট লক্ষে্য ক্ষেপণাস্ত্র ফেলতে পারে, তারা চাইলে তালিবানের মতো একটা একেবারেই প্রান্তিক শক্তিকে কাবু করতে পারত না? বোঝাপড়ার ভিত্তিতে মার্কিন সেনা তালিবানের হাতে শাসন তুলে দিতে না চাইলে এমনটা ঘটতে পারে কি?

মার্কিন বাহিনীকে এভাবে আফগানিস্তান ছাড়তে দেখে অনেকে মনে করেছেন, এটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পরাজয়। অনেকে আবার ভেবেছেন, তালিবান যেহেতু আফগানিস্তানেরই একটি শক্তি, অতএব স্বদেশি শক্তির হাতেই ক্ষমতা গেছে! এর মধ্যে কেউ কেউ আবার আফগান জাতীয়তার উত্থানের সম্ভাবনাও দেখছেন। এই প্রশ্নে অত্যন্ত খোলা মন নিয়ে আফগানিস্তান পরিস্থিতির বিচার করা আজ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন মানুষের কাছে অত্যন্ত জরুরি।

তালিবান মুখপাত্ররা আপাতত শান্তি এবং স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেও তার মূল্য যে কার্যত শূন্য, তা বোঝা যাচ্ছে ক্ষমতা দখলের পরই তাদের আচরণে। তারা সাধারণ আফগানদের উপর গুলি চালাচ্ছে, মহিলাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিচ্ছে– কঠোরভাবে শরিয়তি আইন মেনেই তাঁদের চলতে হবে। ৪ সেপ্টেম্বর মহিলাদের অধিকারের দাবিতে কাবুলে মিছিল হলে প্রবল অত্যাচার চালিয়েছে তালিবান বাহিনী। আধুনিক শিক্ষার যতটুকু ব্যবস্থা আফগানিস্তানে হয়েছিল, তাকে পাল্টে ‘ইসলামিক শিক্ষা’ ব্যবস্থা চালুর কথা বলেছে তালিবান। ইতিমধ্যেই দেখা গেছে ইসলামে গান নিষিদ্ধ এই অজুহাতে তারা লোক শিল্পীকে হত্যা করেছে। একাধিক সাংবাদিককে গুলি করে মেরেছে, টিভি চ্যানেলে ঢুকে বন্দুক ধরে ফতোয়া মেনে সংবাদ পরিবেশনে বাধ্য করছে। এদিকে এই সুযোগে মার্কিন শাসকদের হাতেই একদা সৃষ্ট আইএস-খোরাসান গোষ্ঠীর নামে আর একদল সন্ত্রাসবাদী কাবুলে এবং অন্যত্র হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করে ডামাডোলের বাজারে সামনে এসে ক্ষমতার ভাগ চাইছে।

আফগানিস্তানের গণতন্ত্রীকরণ বারবার ব্যাহত হয়েছে

আফগানিস্তানের পাহাড় এবং উপত্যকা ঘেরা বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলিতে আঞ্চলিক উপজাতীয় প্রধান, তাদের যুদ্ধ সেনাপতি এবং সামন্ততান্ত্রিক মোল্লা-মৌলবীদের দাপটই ছিল শেষ কথা। আফগান ভূখণ্ডকে ঘিরে কোনও অখণ্ড আফগান জাতীয়তাবাদও তৈরি হয়নি। আমির আমানুল্লার মতো কোনও কোনও শাসক উপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে কিছু গণতান্ত্রিক সংস্কারের চেষ্টা করলেও অচিরেই তা ব্যর্থ হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ আধিপত্য দুর্বল হলে রাজা জাহির শাহ আধুনিকতার দিকে কিছু সামাজিক পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। তিনি সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য চেয়েও না পেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝোঁকেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রী দাউদ খান এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী ছিলেন। সে সময় মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের তত্ত্বাবধানে আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তানের মতো মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলিতে মধ্যযুগীয় অন্ধকারকে ভেঙে আধুনিক শিক্ষা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা, নারী মুক্তির ব্যাপক আন্দোলন চলছিল। মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশেই যার প্রভাবে সামন্ততান্ত্রিক কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। নারীর অধিকারের দাবি উঠতে থাকে। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেও সোভিয়েত নেতৃত্ব কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করেই আন্তরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা চর্চার পরিবেশ তৈরির সামাজিক আন্দোলন যাতে তৈরি হয় তার চেষ্টা করেন। কিছু গণতান্ত্রিক শক্তিও গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৬৫ সালে গোপনে আফগান কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হয়। বামপন্থী দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান (পিডিপিএ)-ও জন্ম নেয়। তারা ১৯৬৯ সালে সংসদে একজন প্রতিনিধি পাঠাতেও সক্ষম হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আদর্শের জয়যাত্রা আফগানিস্তানে গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী শক্তিগুলিকে শক্তি দেয়। তাঁরা আফগানিস্তানের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে একেবারে নিচুতলা থেকে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সংশোধনবাদী ত্রুশ্চেভ নেতৃত্ব সোভিয়েতে ক্ষমতা দখল করার পর তারা সাম্রাজ্যবাদীদের পাল্টা সোভিয়েত প্রভাবাধীন অঞ্চল তৈরির ভ্রান্ত নীতি নেয়।

সোভিয়েত নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৩ সালে দাউদ খান প্রাসাদ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাজাকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করে আফগানিস্তানকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক) ঘোষণা করেন। দাউদ খান ক্ষমতা পেয়েই তাঁর পুরনো উদার ভাবমূর্তি ছেড়ে ক্রমাগত স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে থাকেন। এর মোকাবিলায় আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষকে সামিল করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার বদলে সংশোধনবাদীরা নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে কূ্যপের মতো ঘটনাপ্রবাহের সাহায্যে দাউদ খানকে সরিয়ে পিডিপিএ-র ‘খালক’ গোষ্ঠীর নেতা মহম্মদ তারাক্কিকে ক্ষমতায় বসায়। এক বছর যেতে না যেতেই সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী হাফিজুল্লা আমিন সোভিয়েত পক্ষ ত্যাগ করে ক্ষমতা করায়ত্ত করতে ‘মুজাহিদিন’দের সাহায্য নিতে থাকেন। তাঁর মদতে তারাক্কি খুন হন। এই সুযোগে মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনী সিআইএ প্রত্যক্ষভাবে ‘মুজাহিদিন’ নাম দিয়ে মৌলবাদী শক্তিগুলিকে সংগঠিত করে প্রস্ফুটিত হতে থাকা গণতান্ত্রিক পরিবেশকে ধ্বংস করার কাজটি চালিয়ে যেতে থাকে। তারা অঢেল অস্ত্র ও অর্থ মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলির হাতে তুলে দেয়। আফগানিস্তান জুড়ে তীব্র গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। হাফিজুল্লা আমিন মার্কিন সাহায্যে ‘ডেমোক্রেটিক আফগানরিপাবলিক’ ভেঙে দিতে চাইলে আফগান সরকারের একাংশের আহ্বানের যুক্তিতে ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। হাফিজুল্লা আমিন সহ তার অনুগামীদের মৃত্যুদণ্ড হয়। রাষ্ট্রপতি হন বারবাক কারমাল। আফগানিস্তানের জনগণ এমনিতেই কাবুলের উপর সোভিয়েতের একের পর এক গা-জোয়ারি সিদ্ধান্তকে মানতে পারছিল না। তার উপর এই সামরিক হস্তক্ষেপকে তারা তাদের স্বাধীনতার উপর আঘাত হিসাবেই নেয়। আফগানিস্তানের পাহাড়ে উপত্যকায় প্রতিরোধ সংগঠিত হতে শুরু করে। রক্তাক্ত সংঘর্ষে ছিন্নভিন্ন আফগানিস্তান থেকে লক্ষাধিক মানুষ পাকিস্তান, ইরান ইত্যাদি দেশে পালিয়ে যান। ১৯৮৭ সালে পিডিপিএ নেতা মহম্মদ নাজিবুল্লা সোভিয়েত সাহায্যে প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু নানা ঘটনাবলীর কারণে ১৯৮৮ সালের জেনেভা চুক্তি মেনে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সৈন্য আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায়। জেনেভা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সোভিয়েত সামরিক বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়লেও শর্ত লঙ্ঘন করে মার্কিন শাসকরা মুজাহিদিনদের অস্ত্র সরবরাহ চালিয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তানের মাটিতে সিআইএ মুজাহিদিনদের সশস্ত্র ট্রেনিং ক্যাম্প সংগঠিত করে। দেশের বহু অংশে প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লা সরকারের কার্যত কোনও নিয়ন্ত্রণই ছিল না। তিনি কিছুদিন দুর্বলভাবে চেষ্টা করেছিলেন আফগানিস্তানে নারী শিক্ষা এবং গণতান্ত্রিক প্রশাসন চালু করতে। কিন্তু মৌলবাদীদের সাথে সমঝোতা করে ক্ষমতা ধরে রাখতে ১৯৯০ সালে তিনি সমাজতন্তে্রর কথা বাদ দিয়ে আফগানিস্তানকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’-এ পরিণত করা, ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে মেনে নেওয়া এইসব পদক্ষেপ নিতে থাকেন। কিন্তু এই আপসেও কাজ হয় না। ১৯৯১ সালের পর সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যয় আফগানিস্তানের বুকে গণতান্ত্রিক শাসন, আধুনিক শিক্ষা, নারীর অধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কবর রচনায় আরও বেশি সাহায্য করে। ১৯৯২ সালে মুজাহিদিনরা মার্কিন মদতে কাবুল দখল করে। নাজিবুল্লা রাষ্ট্রসংঘের আশ্রয়ে প্রাণ বাঁচান। কিন্তু গৃহযুদ্ধ থামার বদলে বেড়ে যায়। ১৯৯৭ সালে নাজিবুল্লাকে রাষ্ট্রসংঘের দূতাবাস থেকে বার করে এনে কাবুলের রাস্তায় প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয় তালিবানরা।

ভ্রান্ত সোভিয়েত পদক্ষেপের সুযোগ নিয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ

তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের এই পাহাড়প্রমাণ ভ্রান্তির সুযোগে বামপন্থা ও সমস্ত গণতান্ত্রিক চেতনাকে পুরোপুরি শেষ করার জন্য সৌদি আরবের নাগরিক ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তানে উড়িয়ে আনে সিআইএ। তাকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিয়ে ১৯৮৮ সালে গড়ে তোলে আল কায়দা সংগঠন। পাকিস্তানের বুর্জোয়া শাসকদের নানা সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে সিআইএ পাকিস্তানের মাটিকে ব্যবহার করে আফগানিস্তান, পাকিস্তান জুড়ে ইসলামিক মৌলবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটি তৈরির চেষ্টা করতে থাকে। ট্র্যাজেডি হল, আফগানিস্তানের স্বাধীনতাকামী সকল উপজাতি, সমস্ত ধর্মের মানুষ চাইছিল স্বাধীনতা– অথচ তার সম্বন্ধে তাদের কারও স্পষ্ট ধারণা ছিল না। আফগানিস্তানের চরম দুর্দশাগ্রস্ত অনাথ কিশোর-যুবকদের কাজে লাগিয়ে ১৯৯৫ সালে মার্কিন ও পাকিস্তানী বুর্জোয়া শাসকরামৌলবাদী শক্তির সাহায্যে গড়ে তোলে তালিবান। ধর্মীয় কড়া অনুশাসনের ভিত্তিতে কিছুটা শৃঙ্খলা আনা, আফিম চাষ বন্ধ করা ও গৃহযুদ্ধ থামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা জনমানসে জায়গা নিতে চেষ্টা করে। ১৯৯৬ সালে পরোক্ষ মার্কিন মদতেই তারা কাবুল দখল করে।

তালিবানের চরম অত্যাচারী শাসন

আফগানিস্তানের মাটির তলায় থাকা লিথিয়াম, তামা, সোনা ইত্যাদি খনিজ সম্পদের মূল্য এক দশক আগে নির্ধারিত হয়েছিল প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। শুধু তাই নয় ভূ-রাজনৈতিক দিক থকে আফগানিস্তানের গুরুত্ব অপরিসীম। তেল সমৃদ্ধ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল, রাশিয়া, চিন, ভারতীয় উপমহাদেশের এক সংযোগস্থল তার অবস্থান। এই ভূখণ্ড তেলের পাইপলাইন টানার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তানের এই সম্পদ ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান দখলের জন্য পুঁজিবাদী চিন ও রাশিয়ার সাথে মার্কিন সাম্রাজবাদের টক্কর চলছে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন শাসকরা অজুহাত খুঁজছিল কখন তালিবান জমানাকে হটিয়ে পুতুল সরকারের মাধ্যমে তাদের নয়া সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসানের পথ পরিষ্কার করা যায়। সে সুযোগ মার্কিন শাসকরা পেয়ে যায় ২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনায়। এই ঘটনার সাথে ওসামা বিন লাদেন ও আলকায়দা যুক্ত এবং তালিবান তাকে আশ্রয় দিয়েছে, এই অভিযোগে মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে ব্যাপক আক্রমণ চালায়। বিপুল ধ্বংসলীলা চালানোর পর তারা হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে এক অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি করে। পরে নির্বাচনের প্রহসনের মধ্য দিয়ে সরকারকে তারা স্থায়ী রূপ দেয়। মার্কিন প্রতিশ্রুতি ছিল স্বচ্ছ প্রশাসন ও এক আধুনিক ইসলাম তারা উপহার দেবে।

আফগান জনগণের চরম দুর্দশা

২০ বছর ধরে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের নামে মার্কিন বাহিনী যে নির্বিচার বোমা বর্ষণ করেছে, সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাহাড়, পর্বত জনপদ ধ্বংস করেছে সেই যুদ্ধে ১ লক্ষ ৬৭ হাজারের বেশি অফগান নাগরিক ৪ হাজার মার্কিন ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। ২০ হাজারের বেশি মার্কিন সৈন্য আহত হয়েছে। এই সময় ৩২ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়েছেন, ২৭ লক্ষ মানুষ দেশছাড়া হয়েছেন (বিবিসি নিউজ, ২৯ আগস্ট২০১৯) সরকারি হিসাবেই শুধু শেষ দশ বছরে বরফে জমে, খিদের চোটে মারা গেছে ৮০০০-এর বেশি শিশু (আল জাজিরা, ১০ মে, ২০২১) মার্কিন পুতুল সরকারের সদ্য প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি নিজেই বলেছেন, আফগানিস্তানে ৪০ কোটি জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের আয় দিনে ২ ডলারের কম। মাথা পিছু আয়ের নিরিখে বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে ১৭৭ নম্বরে আছে আফগানিস্তান। বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাবে আফগানিস্তানের জাতীয় আয়ের ৪৫ শতাংশই হল বিদেশি ঋণ বা সাহায্য। কার্যত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খুব সামান্য। দেশের একটা বিরাট অংশের আর্থিক পরিস্থিতি নির্ভর করে গোপন ড্রাগ উৎপাদন ও তা পাচারের উপর। তালিবান, এবং নানা উপজাতির যুদ্ধ প্রধানরা যেমন এর উপর নির্ভরশীল, একইভাবে মার্কিন পুঁজি মালিকদের অনেকেই গোপনে এর সাথে যুক্ত। আফগান সরকারের কর্তারাও এর বড় ভাগিদার (নরওয়েজিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স রিপোর্ট ২০১৭)। সীমাহীন দুর্নীতি, জালিয়াতি মার্কিন-আফগান প্রশাসনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।

২০০৪ সালে কারজাই সরকারকে সামনে রেখে যে সংবিধান আফগানিস্তানে মার্কিন কর্তারা চালু করিয়েছেন, তাতে রাজনৈতিক দলের কোনও গুরুত্ব নেই। ফলে কোনও নীতির ভিত্তিতে সংগঠিত হওয়া এবং তার ভিত্তিতে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ আফগানিস্তানে নেই। মূলত ধনী ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী আমলা, সেনাকর্তা, উপজাতীয় আঞ্চলিক প্রভু এরাই একক ভাবে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পায়। তাদের মর্জিমাফিক দু’চারজন সাধারণ মানুষ সংসদে আসন পেতেও পারে, কিন্তু তারাও ওই ক্ষমতাশালীদের দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য। এছাড়া আছে নির্বাচনে সীমাহীন দুর্নীতি। ২০১৪ সালে আশরাফ গনির নির্বাচনটাও ছিল পুরো জালিয়াতি। গণনা না করেই ভোটের কয়েক সপ্তাহ পর মার্কিন শাসকদের ইচ্ছানুসারে গনিকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে দেওয়া হয়। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল্লা আবদুল্লাকেও পকেটে ভরে রাখতে মার্কিন কর্তাদের নির্দেশে নতুন করে সিইও (মুখ্য কার্যনির্বাহী) পদ সৃষ্টি করে তাতে বসিয়ে দেওয়া হয়।

২০ বছরের মার্কিন উপস্থিতি মৌলবাদীদের শক্তি বাড়িয়েছে

দখলদারির ২০ বছর সময় ধরে মার্কিন প্রভুরা তাদের সামরিক পরিকাঠামো, দূতাবাস, বহুজাতিক কোম্পানিগুলির ইংরেজি শিক্ষিত স্থানীয় কর্মচারীর অভাব মেটাতে কিছু উন্নত স্কুল, কলেজ, ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট ইত্যাদি খুললেও জনশিক্ষা বিস্তারের কোনও চেষ্টাই করেনি। মার্কিন হাতের পুতুল আফগান সরকারও এর কোনও দায় অনুভব করেনি। এর সুযোগ নিয়ে তালিবান সহ ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তিগুলি দেশের বিস্তীর্ণ অংশে তরুণদের মধ্যে মৌলবাদের প্রসার ঘটিয়ে গেছে অবাধে। শহরের কিছু অর্থবান পরিবারের মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পেলেও বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে নারী জীবন মধ্যযুগীয় অন্ধকারেই ডুবে থেকেছে।

মার্কিন পুঁজির বিপুল লুঠ বজায় রেখেই সৈন্য প্রত্যাহার

মার্কিন সরকার আফগানিস্তানে যে বিপুল অর্থ ২০ বছরে খরচ করেছে তার পুরোটাই সেনা কার্যকলাপের পিছনে গেছে। আফগানিস্তানের উন্নয়ন, পরিকাঠামো তৈরিতে তা কোনও কাজেই আসেনি। আবার এই অর্থ পরোক্ষভাবে মার্কিন অস্ত্র কোম্পানিগুলিরই পকেটে গেছে। আফগান সরকারের জন্য মার্কিন কর্তারা যে অস্ত্র ও সেনা পরিকাঠামো সরবরাহ করেছেন, তার পুরোটাই জুগিয়েছে কয়েকটি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি। দরিদ্র আফগান জনগণের ঘাড় ভেঙে তারা বিপুল মুনাফা করেছে। আর মার্কিন সরকার বিশ্বের কাছে সন্ত্রাসবাদ বিরোধিতার চ্যাম্পিয়ান সেজেছে।

মার্কিন শাসকরা বুঝেছে, জনজীবনের এই শোচনীয় পরিস্থিতিতে আমেরিকার হাতের পুতুল আফগান সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ একই সাথে মার্কিন বিরোধী তীব্র ক্ষোভে পরিণত হবেই। এই ক্ষোভ-বিক্ষোভকে ধর্মীয় মৌলবাদ ভিত্তিক উগ্র জাতীয়তার প্রচারের সাহায্যে নিজেদের পক্ষে টানার সুযোগ পেয়ে যায় তালিবান। সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের আশঙ্কা ছিল, এই গণবিক্ষোভকে কেন্দ্র করে দুর্বল হলেও গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন আফগানিস্তানে আবার মাথা তুলতে পারলে তা মার্কিন নয়া সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধেও ধাবিত হবে। আফগান জনগণ একদিন সচেতন সমাজবিপ্লবের পথেও চলে যেতে পারে। তাতে সামগ্রিকভাবেই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের সর্বনাশ। তাই গণবিক্ষোভকে কিছুটা স্তিমিত করার চেষ্টা এবং গণতান্ত্রিক শক্তির বদলে তালিবানের হাতে ক্ষমতা দিয়ে পরোক্ষে আফগানিস্তানে প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করতেই মার্কিন কর্তারা আপাতত সেনা প্রত্যাহারের পথে গেছে।

মার্কিন সেনা রণতরী নিয়ে ভারতের সাথে মিলে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ চিন সাগরে যতই দাপট দেখাক, পুরনো মার্কিন-মিত্র পাকিস্তানের সাথে সখ্যতা বাড়িয়ে চিন তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ইরানের সাথে এবং রাশিয়া সংলগ্ন দেশগুলির সাথে চিনের বোঝাপড়া বাড়ছে। চিন চেষ্টা চালাচ্ছে মার্কিন বিরোধী ক্ষোভকে তার পক্ষে টানতে। তালিবান শীর্ষ কর্তারা কিছুদিন আগেই রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় চিন সফর করে এসেছেন। পুঁজিবাদী রাশিয়াও তালিবানের সাথে বোঝাপড়া করে আফগানিস্তানে তার উপস্থিতি রাখতে চাইছে। তারা দফায় দফায় তালিবানের সাথে গোপন এবং প্রকাশ্য আলোচনা চালিয়েছে। এ ছাড়া, সিরিয়া এবং পারস্য উপসাগরীয় এলাকাতেও রাশিয়ার সাথে টক্করে মার্কিন নীতি প্রবল চ্যালেঞ্জের সামনে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ পুতুল সরকারের জমানা দিয়ে আফগানিস্তানকে ধরে রাখতে গেলে মার্কিন শাসকদের আম-ছালা দুটোই খোয়াবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। এই কারণেই আপাতত তারা আফগানিস্তান থেকে হাত গোটানোর কথা বলে তালিবানের মাধ্যমেই আফগানিস্তানে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার পরিকল্পনা করেছে।

তালিবান মার্কিন গোপন বোঝাপড়া

২০১৮ সাল থেকেই এই কাজ শুরু করেছে মার্কিন শাসকরা। সেই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাতারের রাজধানী দোহায় তালিবানের সাথে আলোচনা শুরুর উদ্যোগ নেন। তালিবানদের দাবি মেনে মার্কিন সরকার সমস্ত রীতিনীতি লঙ্ঘন করে নিজেদের মদতপুষ্ট আফগান সরকারকেই আফগানিস্তান সংক্রান্ত আলোচনা থেকে বাদ দিয়ে দেয়। যে তালিবানের বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রবল যুদ্ধহঙ্কার ক্রমাগত শুনেছে পৃথিবী, যাদের বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক সন্ত্রাসবাদী বলে অভিহিত করেছিল মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষ পেন্টাগন, তাদের সাথেই এক বছর ধরে আট রাউন্ড আলোচনা চালায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার। ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে তালিবান হামলায় এক মার্কিন সেনার মৃত্যুর জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আলোচনা স্থগিত করে দিলেও অচিরেই আলোচনার ব্যগ্রতা দেখায় আমেরিকান প্রশাসন। কারণ, এই সুযোগে চিন এবং রাশিয়া বাড়তি সুবিধা আদায় করে নেবে এই আশঙ্কা তাদের ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল, আলোচনায় মার্কিন আগ্রহটাই বেশি। অবশেষে ২০২০-র ২৪ ফেব্রুয়ারি মার্কিন-তালিবান চুক্তি হয়। যুদ্ধবিদ্ধস্ত আফগানিস্তানের মানুষের কাছে যুদ্ধ শেষ হওয়ার চিন্তাটাই বড় হয়ে ওঠে। ফলে তাঁরা চুক্তির খুঁটিনাটি নিয়ে বেশি মাথা ঘামাননি।

চুক্তির প্রধান পাঁচটি বিষয় ছিল, তালিবান কথা দেবে কোনও বিদেশি শক্তিকে তারা আফগান মাটি ব্যবহার করে অন্য দেশকে আক্রমণ করতে দেবে না, ১৪ মাসের মধ্যে আমেরিকান ও ন্যাটো সামরিক বাহিনীর সম্পূর্ণ অপসারণ, আফগানিস্তানের আভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগুলির মধ্যে আলোচনা শুরু এবং পুরোপুরি যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক রোডম্যাপ তৈরি হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল ২৯ মে ২০২০-র মধ্যে রাষ্ট্রসংঘের সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের তালিকা এবং ২৭ আগস্ট ২০২০-র মধ্যে মার্কিন তালিকা থেকে তালিবানের সন্ত্রাসবাদী নাম কাটা যাবে। এই চুক্তির পরেই মার্কিন চাপে আফগান সরকার ৫ হাজারের বেশি তালিবান বন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এই চুক্তির পর দোহাতে আফগান সরকারের সঙ্গে তালিবানের আলোচনা শুরু হলেও মার্কিন অনিচ্ছায় তা থেমে যায়। কার্যত তখনই মার্কিন সরকারের হাত ধরে তালিবানই হয়ে উঠতে থাকে আফগানিস্তানের প্রধান চালক, সরকারের ভূমিকা নস্যাৎ হয়ে যায়।

তালিবান এখন মার্কিন দোসর

এই চুক্তির একটি অংশ আছে যা গোপন। এর ভিতরে কী কী শর্ত আছে জানা মুশকিল। এমনকি মার্কিন কংগ্রেস ও সেনেটেও চুক্তির পুরো শর্ত জানাতে ট্রাম্প সরকার অস্বীকার করেছে। জো বাইডেনও সেই লাইন মেনে চলছেন। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রস্তাব দিয়েছিলেন তালিবান হবে ‘কাউন্টার টেরোরিজম ফোর্স’ বা ‘সন্ত্রাস বিরোধী শক্তি’। এই প্রস্তাবেই ইঙ্গিত আছে যে, তালিবানকে তাদের দোসর বানাতে চায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। তালিবান এবং আলকায়দার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী হুঙ্কার দিয়ে আফগানিস্তান ধ্বংস করেছে আমেরিকান শাসকরা। সিরিয়া, প্যালেস্টাইন কিংবা লেবাননে মার্কিন চক্রান্তের বিরুদ্ধে যখনই সে সব দেশের নির্বাচিত সরকারের সামরিক বাহিনী আইনসঙ্গত ভাবে নিজের দেশ রক্ষায় রুখে দাঁড়িয়েছে– মার্কিন কর্তারা সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। লিবিয়াতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে পিটিয়ে হত্যা করায় মদত দিয়েছে। এখন তালিবান মার্কিন শর্তে চলতে রাজি হয়ে যেতেই, সঙ্গে সঙ্গে তারা বনে গেল ‘সন্ত্রাস বিরোধী শক্তি’!

এই তথ্যটি মাথায় রেখে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনার দেশে ফেরার প্রেক্ষিতটি বিচার করলে বোঝা যায়, আসল মার্কিন মতলবটি কী? প্রবল চাপে পড়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আপাতত এই পথেই আফগানিস্তানে তার পরোক্ষ উপস্থিতি বজায় রাখতে পারবে। মার্কিন সহযোগী হিসাবে তালিবান, আল-কায়দা, আইএস গোষ্ঠীরা অর্থ, অস্ত্র সবই পাবে। বিনিময়ে আফগানিস্তানের মাটিতে মার্কিন স্বার্থের যোগসূত্র হয়েই তারা থাকবে। মতলব আরও পরিষ্কার হয়, যখন দেখা যায়– চুক্তির নানা ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে বলা আছে, মার্কিন মিলিটারি চলে গেলেও আফগানিস্তানে তাদের গোয়েন্দা বাহিনী সিআইএ-র শক্তিশালী উপস্থিতি তালিবান মেনে নেবে। অবশ্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চাপে পড়ার সুযোগে চিন এবং রাশিয়াও তালিবানকে কাজে লাগিয়ে একই ধরনের মতলব হাসিল করতে চাইছে। এর জেরে এই এলাকায় নতুন করে যুদ্ধ উত্তেজনা সৃষ্টির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফলে শান্তি প্রতিষ্ঠা দূরে থাক, আরও বড় অশান্তির সম্মুখীন হওয়ার জন্যই অপেক্ষা করছে আফগানিস্তান।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত এবং পাকিস্তানের ভূমিকা

পাকিস্তানের পুঁজিবাদী শাসকরা তালিবানের এই উত্থানে প্রবল উল্লসিত। এর থেকে তারা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ফয়দা তোলার আশা করছে। কারণ তারাই এতদিন ধরে তালিবানকে মদত দিয়েছে। এখন তা কাজে লাগবে। বিশেষত পুঁজিবাদী চিনের শাসকরা তালিবানের পাশে দাঁড়াবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় পাকিস্তান নানা দিক থেকের সুবিধার আশা করছে।

কাতারের রাজধানী দোহাতে ভারতীয় দূতাবাসে ৩১ আগস্ট তালিবানের মুখপাত্র স্ট্যাকিজাইয়ের সাথে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্য বৈঠক করেছেন। এর আগে ভারতীয় বিদেশ সচিব হর্ষ শ্রিংলা বলেছিলেন, ভারতীয় বহুজাতিকদের বিনিয়োগগুলি রক্ষা করার জন্য তালিবান কর্তৃপক্ষের সাথে সরকার কথা বলবে (টাইমস অফ ইন্ডিয়া ২১.০৮.২১)। একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সেবাদাস হিসাবে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার আফগানিস্তানে ভারতীয় একচেটিয়া মালিকদের ৩ বিলিয়ন ডলার (২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি) বিনিয়োগ রক্ষা করতেই ব্যস্ত। অথচ, আফগানিস্তানে থাকা ভারতীয় নাগরিকদের প্রতি তাঁরা চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তালিবানের কাবুল জয় সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই দিল্লির নির্দেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত তাঁর সব ভারতীয় অফিসারদের নিয়ে আফগানিস্তান ত্যাগ করেছেন। ভারতে ফিরতে চাওয়া ভারতীয় নাগরিক ও আফগান আশ্রয়প্রার্থীদের অন্য দেশের সেনাবাহিনী, কিংবা তালিবানদের দয়া ভিক্ষা করে বিমানে উঠতে হয়েছে। দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনে সরকার যতই অপদার্থতা দেখাক না কেন, একচেটিয়া মালিকদের সেবায় ঘাটতি দিলে তাদের চলে না। ভারত সরকার যখনই বুঝে গেছে মার্কিন কর্তাদের সাথে বোঝাপড়া করেই তালিবান আফগানিস্তানে এগিয়েছে, তৎক্ষণাৎ তারা একাধিকবার তালিবানের সাথে বৈঠক সেরে নিয়েছে।

বিজেপি-আরএসএস সদা ব্যস্ত থাকে তালিবান এবং আইএস-কে ইসলামের সাথে এক করে দেখাতে। আসন্ন উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করতে তারা নিঃশব্দে তালিবান আতঙ্ক ছড়ানোর প্রচার শুরুও করে দিয়েছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী সহ কোনও বিজেপি মন্ত্রী একটি বারের জন্যও প্রকাশ্যে তালিবানের নাম করে একটি নিন্দাসূচক বাক্যও খরচ করেননি। শুধু বিজেপিই বা কেন– সিপিএম সিপিআইয়ের মতো মেকি মার্কসবাদী দলগুলিও তাদের যৌথ বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করেছে, আগেকার তালিবানের থেকে এবারের তালিবানের চরিত্র পৃথক হবে এবং তারা গণতান্ত্রিক শাসনের পথেই এগোবে। পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত না হলে এমন কথা কেউ বলতে পারে?

এ কথা ঠিক মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারবারিরা একে অপরের পরিপূরক। হিন্দু-মুসলমান সব মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিই আজকের দিনে পুঁজিপতি শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা পায়। তাই আফগানিস্তানে তালিবানের রমরমা হলে, পাকিস্তানের সাহায্যে ভারতে তালিবান কিংবা আইএস কিছু সন্ত্রাসবাদী হামলা চালালে, আফগানিস্তানের মাটিতে মেয়েদের নতুন করে পরাধীন করা শুরু হলে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফয়দা তুলতে ভারতে সুবিধাই হবে।

পুঁজিবাদ-সাম্রাজবাদই আজ সন্ত্রাসবাদের জন্মদাতা

আজকের দিনে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবার, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের লস্কর-ই-তইবা, তালিবান, বাংলাদেশের জামাত ই-ইসলামি, মধ্য এশিয়ার আইএস, মায়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মভিত্তিক উগ্র গোষ্ঠী, মার্কিন মুলুকের শ্বেতাঙ্গবাদী জঙ্গি গোষ্ঠী, ইউরোপের নব্য নাৎসিবাদী ইত্যাদি যে নামই করা যাক না কেন দেখা যাবে তারা অর্থ থেকে প্রচার সব কিছুর জন্য নির্ভর করে বুর্জোয়াদের টাকার থলির উপরেই। পুঁজিবাদের চরম শোষণের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান জনবিক্ষোভকে বিপথগামী করার জন্যই শাসক শ্রেণি এই অন্ধকারের শক্তিগুলিকে গড়ে তোলে ও নানাভাবে মদত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। এর মাধ্যমে তারা শোষিত মানুষের ঐক্যকে ভাঙে। এক দেশের সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী দেশে পাল্টা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী তৈরিতে তারাই মদত দেয়। এর ফলে সাধারণ মানুষের প্রাণ যায়, মানুষের মধ্যে জমে থাকা ন্যায্য ক্ষোভ-বিক্ষোভ ভুল পথে ধাবিত হয়ে প্রকৃত অর্থে প্রতিবাদী মানুষেরই সর্বনাশ করে শুধু তাই নয়, এর মধ্য দিয়ে সভ্যতার অগ্রগতি, সমাজপরিবর্তনের ধারাও সাময়িকভাবে হলেও ব্যাহত হয়।

আফগানিস্তানের জনগণ আত্মত্যাগ বীরত্ব কিছু কম দেখাচ্ছেন না, অতীতেও তাঁরা বহু মূল্য দিয়ছেন। যদিও, একই সাথে আফগানিস্তান জুড়ে সাধারণ মানুষ তালিবান বিরোধী বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। তালিবান বাহিনী গুলি চালিয়ে অনেককে হত্যা করলেও বিক্ষোভ চলছে। মহিলারা কাবুল সহ নানা জায়গায় নিজেদের সম্মান এবং অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নামছেন। পঞ্জশিরে পর্বত ঘোরা উপত্যকায় তালিবান বিরোধী যোদ্ধারা প্রতিরোধ করছেন।

আফগান জনগণের এই দুর্দিনে তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়ে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ১৮ আগস্ট এক বিবৃতিতে বলেন– ‘… আমাদের আশা, আফগানিস্তানের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে সংগঠিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে এবং এই প্রতিক্রিয়াশীল তালিবান জমানাকে রুখে দিয়ে তারা সে দেশে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। বিশ্বের সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে আমাদের আবেদন, এই সঙ্কটের সময় আফগান জনগণের পাশে দাঁড়ান।’

(আগামী সংখ্যায় রেভোলিউশনারি আফগান উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন (আরএডব্লিউএ) নেত্রীর সাক্ষাৎকার)