আইন তো হচ্ছে, নারী সুরক্ষা কই

১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবে অসমসাহসী লড়াই করেছিল মহিলারা৷ দেখিয়ে দিয়েছিল তারা পুরুষের থেকে কোনও অংশে কম নয়৷১৮৫৭–র শিল্পবিপ্লবের ফলে আমেরিকায় গড়ে ওঠা কাপড়ের কারখানায় কাজ করত প্রচুর মহিলা শ্রমিক৷ নামমাত্র মজুরি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অমানুষিক পরিশ্রমের প্রতিবাদে তাঁরা গড়ে তুলেছিল প্রথম মহিলা শ্রমিক ইউনিয়ন৷ বারে বারে তাঁদের জমে ওঠা ক্ষোভ প্রতিবাদ মিছিলে আগুন হয়ে জ্বলে উঠেছে নিউইয়র্কের রাজপথ৷

১৯১০–এ ডেনমার্কে সমানাধিকারের দাবিতে নারীদের সংগ্রামের স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণার প্রস্তাব নেওয়া হল দ্বিতীয় সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে৷ ১৯১১–র মার্চে মহিলাদের ভোটাধিকার, সমমজুরির দাবিতে লক্ষ মানুষের ঢল নামল অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড–এর রাস্তায়৷

১৯১৭–র ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ায় পেড্রোগ্রাদ শহরে ঝড় তুলল কাপড় কারখানার মহিলা শ্রমিকদের বিক্ষোভ৷ যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন, জার শাসনের অবসানের দাবিতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়লেন পুরুষ ও মহিলা শ্রমিক৷ আমাদের দেশে প্রীতিলতা, কনকলতা, মাতঙ্গিনী হাজরা প্রমুখ কী অভূতপূর্ব, কী অগ্নিদৃপ্ত ভূমিকা পালন করে গেছেন স্বাধীনতার জন্য৷  

সামন্ততন্ত্রের জোয়াল ভেঙে শিল্পবিপ্লব–এর হাত ধরে পুঁজিবাদের গডে ওঠা, বিকশিত, সংহত হওয়ার দিনগুলোতে এভাবেই নারীর সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লডাইয়ে নেমেছিলেন মহিলারা৷ দীর্ঘকাল ধরে সমাজের বুকে চেপে বসা বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই৷ পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়ার অধিকার আদায়ের লড়াই৷ সংসারের ঘেরাটোপে নিছক ‘মেয়ে’ হয়ে না থেকে শিক্ষা–রাজনীতি–অর্থনীতি-সংস্কতির জগতে পা রাখার অদম্য ইচ্ছে, প্রাণশক্তি সেদিন অগণিত মেয়েকে সামিল করেছিল শোষণবিরোধী আন্দোলনের ময়দানে৷

কর্মক্ষেত্রে প্রায় সর্বত্র আজ মেয়েরা যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন৷ মেয়েদের ভোটাধিকার, শিক্ষার অধিকার, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা খাতায় কলমে হলেও স্বীকৃত৷ অথচ সাধারণ মানুষের রোজকার জীবনের অভিজ্ঞতা, সংবাদপত্রের হেডলাইন, বিভিন্ন সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে তথাকথিত ‘আধুনিক’ পৃথিবীতেও মেয়েরা নিদারুণ বৈষম্য, অবহেলার শিকার৷ সমাজ–সভ্যতার অগ্রগতির যাবতীয় গৌরবকে ম্লান করে মহিলাদের ওপর যৌন নিপীড়ন ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত, পৃথিবীজুড়ে৷ এই যৌন নির্যাতনের নিরিখেই সম্প্রতি ভারত উঠে এসেছে শীর্ষস্থানে৷ প্রধানমন্ত্রী থেকে বিভিন্ন শাসক দলের নেতা মন্ত্রীরা সবাই যখন বক্তৃতায় উন্নয়নের ফুলকি ছোটাচ্ছেন, গ্রাম–শহরের পথঘাট থেকে বলিউডের সিনেমা পর্যন্ত সর্বত্র ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ এর ফানুস উড়ছে সেই সময় থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন–এর একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা জানাচ্ছে, ভারত মহিলাদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ৷ সাত বছর আগেও এরকম একটি সমীক্ষায় ভারতের স্থান প্রথম দিকেই ছিল, কিন্তু এবারে আফগানিস্তান, সিরিয়া, সোমালিয়া, সৌদি আরব এমনকী ট্রাম্প সাহেবের আমেরিকাকেও টপকে ভারত এক্কেবারে প্রথম৷ ২০১২ তে রাজধানী দিল্লির বুকে নির্ভয়ার নারকীয় ধর্ষণ–হত্যার পর গোটা দেশজুড়ে ফেটে পড়া জনরোষের চাপে বাধ্য হয়ে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারকে মহিলাদের সুরক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছিল৷ সেই ভয়াবহ ঘটনার জেরে ধর্ষণসংক্রান্ত আইনকানুনেও কিছু পরিবর্তন এসেছে বা আসবে৷ কিন্তু মহিলাদের সুস্থ–সুরক্ষিত জীবন নিশ্চিত হওয়া দূরে থাক, পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে প্রতিদিন৷

সরকারি তথ্যই বলছে, ২০০৭ থেকে ২০১৬–র মধ্যে মহিলাদের ওপর নির্যাতনের সংখ্যা বেড়েছে ৮৩ শতাংশ, প্রতি ঘন্টায় চারটি করে ধর্ষণের ঘটনাসহ চল্লিশটি যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে এখানে৷ নথিভুক্ত হওয়া এই পরিসংখ্যানের বাইরেও চাপা পড়ে আছে বহু মর্মান্তিক অত্যাচার৷ নারীপাচার–যৌনদাসত্ব-কন্যাভ্রূণ হত্যা–বাল্যবিবাহের মতো অপরাধের নিরিখেও সমীক্ষকদের বিচারে সব থেকে এগিয়ে ‘আচ্ছে দিন’–এর ‘ডিজিটাল’ ভারত৷ এই লজ্জাজনক সত্য সামনে এসে যাওয়ায় যথারীতি সমীক্ষাটি ভুল প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন বিজেপি নেতারা এবং তাদের তাঁবেদার কিছু সংবাদমাধ্যম৷ যেন যৌন হিংসায় ভারত প্রথম না হয়ে দ্বিতীয় বা তৃতীয় হলে আমূল পাল্টে যেত দেশের কোটি কোটি মহিলার বিপন্ন জীবন৷ সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিন উঠে আসছে পৈশাচিকতার নতুন নতুন নাম– কাঠুয়া, উন্নাও, মালদা, হরিয়ানা, সুরাট, নদীয়া৷ সরকারি দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রকাশ্য রাস্তায় ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল করছেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পর্যন্ত অভিযুক্ত হচ্ছেন ধর্ষণের অভিযোগে৷ সরকারি দলের আশ্রয়পুষ্ট গুন্ডাবাহিনী একের পর এক জঘন্য অপরাধ করেও নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ অশীতিপর বৃদ্ধা থেকে শিশুকন্যা– রেহাই মিলছে না কারও৷ বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতেও ভয় পাচ্ছেন বাবা–মা, ভাল করে অক্ষর চেনার আগেই শিশুকে ‘গুড টাচ–ব্যাড টাচ’–এর তফাত চেনানোর নিদান দিতে হচ্ছে মনস্তত্ববিদদের৷

শুধু মেয়েদের জন্যই নয়, এই যেন তেন প্রকারে মুনাফা আদায়কারী সমাজ আজ যে কোনও মানুষের সুস্থ জীবনের পথে অন্তরায়, মনুষ্যত্বের বিকাশের পথে অন্তরায়৷ সমাজে মেয়েদের অবস্থান, মর্যাদা, সুরক্ষা, সমানাধিকার কোনও বিচ্ছিন্ন বস্তু নয়৷ সাধারণ মানুষের শিক্ষা–স্বাস্থ্য–নিরাপত্তার সাথে, দেশের রাজনীতি–অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নারীকে যথার্থ মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্নটি৷ যে দেশে ঘরে ঘরে বুভুক্ষু মানুষের আর্তনাদ, সাধারণ মানুষের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু বিপন্ন, পেটের দায়ে শ্রমিক–কৃষকের আত্মহত্যা যেখানে রোজকার বিষয়, নারীদেহের পণ্যায়নের নাম যেখানে বিনোদন, যে দেশে পুলিশ–প্রশাসনের নাকের ডগায় অন্তঃসত্ত্বা সংখ্যালঘু রমণীর পেট চিরে বের করা ভ্রূণকে ঘোরানো হয় ত্রিশূলের ফলায়, প্রতিদিন দেশের প্রান্তে প্রত্যন্তে গো–রক্ষার নামে মিথ্যে অভিযোগে খেটে খাওয়া মানুষকে পিটিয়ে কুপিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার পরেও অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার হয় না, দাভোলকর–পানসারে-কালবুরগি-গৌরী লঙ্কেশদের যুক্তিবাদী কন্ঠকে নিশানা করে রাষ্ট্রের মদতপুষ্ট ধর্মধ্বজীদের বুলেট ছোটে, জাত–পাত–ধর্মভেদের ধুয়া তুলে পিটিয়ে হত্যাকাণ্ড চলে, নারী ধর্ষণ–খুন চলে, শিক্ষা–স্বাস্থ্য–অবাসস্থানের মৌলিক অধিকার যেখানে একের পর এক জনবিরোধী নীতির আক্রমণে লুন্ঠিত, যেখানে সরকারি মদতে যাবতীয় অবৈজ্ঞানিক গাঁজাখুরি গল্পকে ইতিহাসের নামে চালানোর চেষ্টা, সমাজমাধ্যমে ফেক নিউজ ছডিয়ে কিছু বিশেষ সম্প্রদায় বা দেশের বিশেষ কিছু মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণা উস্কে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত, সেই দেশ সেই সমাজ সেই সরকার কোনও দিন মহিলাদের সুরক্ষা দিতে পারে না৷ দেশের কোটি কোটি মানুষের শ্রম নিংড়ে সমস্ত সম্পদের মালিক হয়ে বসেছে যারা তাদের সমর্থন নিয়ে আজ বা কাল যে দলই সরকারি ক্ষমতায় আসুক, মুখে নারীসুরক্ষার জনদরদের যতই বুলি ছড়াক নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই তারা এই অন্যায় শোষণ বৈষম্য টিকিয়ে রাখতে চায়৷ মানুষ গড়ার শিক্ষাকে ধবংস করে, মানুষকে পশু বানানোর বিবেকহীন যন্ত্র বানানোর সমস্ত আয়োজনকে মদত দেয়, নারীকে শুধুই ভোগ্যপণ্য করে রাখতে চায়, ন্যায়সঙ্গত সমস্ত প্রতিবাদের গলা টিপে ধরতে চায়৷ ভুলিয়ে দিতে চায় প্রীতিলতা–মাতঙ্গিনী– বীনা দাস–বেগম রোকেয়ার আলোকময় জীবনকে৷

শোষকের, শাসনব্যবস্থার এই চরিত্রকে চিনতে পারা আজ শোষিত মানুষের সব থেকে বড় প্রয়োজন৷ স্রেফ ভোটের মুখ চেয়ে কোনও মহিলা সংরক্ষণ বিল, কোনও কন্যাশ্রী–রূপশ্রী, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিছক কেতাবী বিষোদগার নারীকে কাঙ্খিত মুক্তি ও মর্যাদা দিতে পারে না৷ ইতিহাসের সুস্পষ্ট নির্দেশ– তা আসতে পারে একমাত্র সমাজের অগণিত নারী–পুরুষের সম্মিলিতভাবে শোষণমুক্তির লডাইয়ের পথেই৷ এই পথেই নারী পূর্ণ মানুষ হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে৷

(৭১ বর্ষ ৪ সংখ্যা ২৪ আগস্ট, ২০১৮)