নববর্ষের সকাল। প্রবল তাপ প্রবাহ চলছে কদিন ধরে। সকাল নটার গরমেই দম বন্ধ হয়ে আসছে রান্নাঘরের আঁচে, দেওয়াল ভেদ করে যেন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে গরম হাওয়া। তাও বচ্ছরকার দিনে ছেলের আবদার রাখতে ভোর ভোর রান্নাঘরে ঢুকেছেন বনানী মিত্র। ফুলকো লুচি, আলুরদম আর মিষ্টি প্লেটে সাজিয়ে দিয়েছেন ছেলে আর ছেলের বাবাকে। বছর দেড়েকের ছোট ছেলেটা টলমল পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘর জুড়ে, মাঝে মাঝে এসে মাথা ঘষছে মায়ের কোলে, দুষ্টুমি ভরা চোখে তাকাচ্ছে দাদার দিকে।

বনানী মিত্র উত্তর কলকাতার একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। দুই ছেলের বড় জন একটি নামকরা মিশনারি স্কুলে ক্লাস সিক্সে উঠল এবার। হাত বাড়িয়ে খবরের কাগজটা টেনে নিলেন বনানী। সময় নিয়ে, মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়াটা তার পুরোনো অভ্যেস। স্কুল, সংসার, দুই ছেলের ঝক্কি সামলে সে অভ্যেসে ঘুণ ধরেছে বহুদিন। তাও আজ ছুটির দিনের অবসরে একটু আরাম করে কাগজ পড়তে ইচ্ছে করল। মুখ্যমন্ত্রীর পাতাজোড়া শুভেচ্ছা, সরষে ইলিশ আর সোনার গয়নায় ছাড়, নতুন বছরে নতুন ফ্ল্যাটের হাতছানি। বিজ্ঞাপনের ভিড় ঠেলে সম্পাদকীয় পাতায় এসে চোখ আটকে গেল।

একটি সরকারি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের প্রতি তিনজন শিশুর মধ্যে একজন অপুষ্ট। দিনভর না খেয়ে থাকে এমন শিশুর সংখ্যা উনষাট লক্ষ। খাদ্যাভাব তো আছেই, আছে খাইয়ে দেওয়ার বা দেখভাল করার লোকের অভাবও। মায়েরাও ভুগছেন অপুষ্টি, রক্তাল্পতায় যার পরিণামে জন্মাচ্ছে রুগ্ন, কম ওজনের শিশু। সমীক্ষার তথ্য বলছে, ছ’মাস থেকে তেইশ মাস বয়সের শিশুদের প্রায় কুড়ি শতাংশই সারাদিন না খেয়ে থাকে। ইতিহাসের শিক্ষিকা বনানী, দেশের দারিদ্র অনাহার অপুষ্টির কথা আজ প্রথম শুনছেন না। বাবা ছিলেন পুরোনো দিনের আদর্শবাদী লোক, বামপন্থায় বিশ্বাসী। নিজে কোনও দিন সক্রিয় রাজনীতি না করলেও সমাজবাস্তব বলে যে একটা জিনিস আছে, গরিব দেশের বেশিরভাগ লোকই যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও দিনের শেষে ঠিকমতো পেটভরা খাবার পায় না– এ কথা ছোটবেলা থেকেই শুনে, জেনে এসেছেন তিনি। গোড়ার দিকে ক্লাসরুমেও গল্পের আদলে, ইতিহাস পড়ানোর ফাঁক-ফোকরে এ কথাগুলো শোনাতে চাইতেন তিনি। আজ অনেকটাই দূরে চলে গেছে সেসব ইচ্ছে, অভ্যাস। নাকি গতানুগতিকতার আবর্তে নিজেই দূর করে দিয়েছেন সে সব ভাবনাকে? কই, সমাজ আর দেশকাল তো বদলায়নি কোথাও, বরং আরও তলানিতে নামছে রোজ।

এই খবরেই আছে, ২০১৬ থেকে ২০২১ এই পাঁচ বছরে দেশে ক্ষুধার্ত শিশুর সংখ্যা বেড়েছে ক্রমাগত। অথচ ছাত্রীদের সুনাগরিক হওয়ার নিয়মকানুন শেখানোর ফাঁকে হোম লোন ইন্টারেস্ট-সেভিংস-এর চক্করে, ছেলের কোচিং ক্লাসের ব্যাগ গুছিয়ে দিতে দিতে গত একবছরে একবারও কি তিনি ভেবেছেন এই ক্ষুধার্ত মুখগুলোর কথা? হঠাৎ বুকটা কেমন হু হু করে ওঠে ছোট ছেলের মুখটা ভেবে, চোখ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে অজান্তেই। নাঃ, আজ পয়লা বৈশাখের দিন কী সব ভেবে মনখারাপ করছেন তিনি? জোর করে পাতা উল্টে দিলেন বনানী মিত্র, ভেতরের পাতায় যদি থাকে কোনও মন ভালো করা খবর। স্বস্তি মিলল না সেখানেও। মিড ডে মিলে যেটুকু বরাদ্দ বেড়েছিল গত চার মাস, এপ্রিলেই তার মেয়াদ ফুরোচ্ছে। শিক্ষা দফতর বলছে, আগের বছরের বেঁচে যাওয়া টাকা থেকে এটুকু বাড়ানো সম্ভব হচ্ছিল, আবার ফিরে যেতে হবে সেই পুরনো মেনুতে। অর্থাৎ সপ্তাহে একদিন মাংসের ঝোল পেয়ে রোদ্দুর খেলা করছিল যে মুখগুলোয়, সেখানে আবার মেঘ জমবে। মিড ডে মিলের আপেল মুঠোয় নিয়ে কারটা বড় কারটা ছোট, সেসব মেপে দেখার খুনসুটিও শেষ। চাল-ডাল-আলু প্যাকেটে দিলে তাও একরকম, রান্না করা খাবার মুখে তুলতে পারবে না অনেকেই, যেদিন ডিম পাবে ঝোল ফেলে সেটা খাবে হয়তো। স্কুলের মিড ডে মিল রোজ টেস্ট করতে হয় কোনও না কোনও শিক্ষিকাকে। প্রায়ই সে দায়িত্ব বর্তায় বনানীর ওপরে। গন্ধ হয়ে যাওয়া আলুমাখা আর বিস্বাদ সয়াবিনের ঝোল নিয়ে একবার অভিযোগ করেছিলেন প্রধান শিক্ষকের কাছে, লাভ হয়নি। উল্টে তিনি বলেছিলেন, আপনি টেস্ট করে সই করে দেবেন, অত ভেবে লাভ নেই। আমার আপনার হাতে কিছু নেই বুঝলেন?

কার হাতে আছে তা হলে? নামমাত্র বেতনে, যৎসামান্য উপকরণে যারা মিড ডে মিল রাঁধেন বছরভর, তারাই বা কার কাছে অভিযোগ জানাবেন? তারপর থেকে বনানী মিত্র যন্ত্রের মতো মিড-ডে মিলের খাতায় সই করেন। যে সময় পাঁচ টাকায় একটা গোটা ডিমও মেলে না, আলু-পেঁয়াজ-চাল-ডালের দাম চড়চড় করে বেড়ে মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে চলে যায়, সেই সময়ই একটি পঁচাত্তর বছরের স্বাধীন দেশের সরকার স্কুল পড়ুয়াদের দুপুরের খাবারে মাথাপিছু বরাদ্দ করেছে প্রাথমিকে ৪.৯৭ টাকা এবং উচ্চ প্রাথমিকে ৭.৪৫ টাকা। করোনার সময় যে দিন প্রথম ছাপার অক্ষরে এই সংখ্যাদুটো পড়েছিলেন, কেমন যেন বিশ্বাস হয়নি। ছেলের স্কুলের টিফিন বক্সে রোজ যে রুটি তরকারি, পাঁউরুটি-কলা, চাউমিন সাজিয়ে দেন তার দাম কত হতে পারে, ভেবে কূল পাননি। তারপর হয়তো সময়ের পলি জমে আড়াল হয়ে গেছে ভাবার ইচ্ছেটুকুও। অনেকের মতোই তাঁরও গা সওয়া হয়ে গেছে মিড ডে মিল নিয়ে স্তরে স্তরে অব্যবস্থা, বঞ্চনা আর দুর্নীতি, কেন্দ্র-রাজ্য তরজা, স্কুলছুট কমানোর নামে নিম্নমানের খাবার দেওয়ার এই সরকারি প্রহসন। অথচ এই নববর্ষের সকালের কাগজটা সব গোলমাল করে দিচ্ছে বারবার। নতুন জামার গন্ধ, সন্ধের হালখাতা, ছেলের আব্দারের খাবার সব আড়াল করে বারবার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেসেই নিষ্পাপ কচিমুখগুলো, এদেশে জন্মে যারা দিনভর খিদেপেটে থাকে। স্কুলের পথে ট্রেনের জানলা দিয়ে বনানী যাদের প্রায় রোজই দেখেন। ময়লা মুখ-ধেবড়ে যাওয়া কাজল-সর্দি গড়ানো নাক নিয়ে যারা কখনও থেবড়ে বসে থাকে, কখনও একগাল হেসে হাত নাড়ে, কখনও মায়ের চড় খেয়ে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদে, সুজলা-সুফলা ভারতবর্ষের সেই ভবিষ্যত নাগরিকরা যেন লাইন দিয়ে হাত পেতেছে আজ নববর্ষের সকালে–কই, আমাদেরও লুচি দাও। নতুন জামা বুঝি আমরা পরব না? পেটভরে খাব না বুঝি?

উনষাট লক্ষ অভুক্ত মুখের আদল বারবার মিলেমিশে যাচ্ছে প্রাণপ্রিয় দুই আত্মজর মুখের সাথে। নিজেকে বড় অসহায়, অক্ষম মনে হয়। শিক্ষিকা হিসাবে, মানুষ হিসাবে, হতাশ হওয়া ছাড়া কি আর কিছুই করার ছিল না তার? রাস্তায় বেরোলেন বনানী মিত্র। বাজারের মোড়ে একদল ছেলে-মেয়ে। কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্র সব। রাজ্য জুড়ে সরকারি স্কুল তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে সই সংগ্রহ করছে ওরা, মাইকে বলছে একজন। ওরা বলছে, আন্দোলন ছাড়া শিক্ষার সর্বনাশ আটকানোর কোনও পথ নেই। প্রায়ই ওদের দেখেন এখানে। দাঁড়িয়ে শোনেনও দু-তিন মিনিট। তারপর এ সব রাজনীতির ঝামেলায় না ঢোকাই ভালো ভেবে অন্য দিকে হাঁটা দেন। মনটা খচখচ করে কয়েক মিনিট। আজকের দিনটা অন্য রকম। বনানী মিত্র থামলেন। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলেন নীল কুর্তি পরা মেয়েটির দিকে। বললেন–কই দাও, কোথায় সই করতে হবে।