স্বাস্থ্য-ব্যবসা বিপদ আরও বাড়িয়েছে


করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করতে গিয়ে একটা প্রশ্ন আজ বিশ্ব জুড়ে প্রকট হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য-ব্যবসাই কি এই বিপদকে আরও বাড়তে দিল? আজ পরিস্থিতি এমন কলকাতার বিলেত ফেরত সোনার টুকরো বাবুদেরও দাঁড়াতে হচ্ছে বেলেঘাটার আইডি হাসপাতালের লাইনে। দুদিন আগেও যে সব জায়গায় ভর্তি দূরে থাক, পা রাখতেই সমাজের উচ্চকোটির মানুষের গা ঘিনঘিন করত, সেই সরকারি হাসপাতালই আজ ভরসা দেশ জুড়ে। দেখা যাচ্ছে অন্য সময় যারা খবরের কাগজের পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দেয় সর্বোন্নত চিকিৎসার, সেই বড় বড় করপোরেট হাসপাতালগুলি এতবড় রোগ মোকাবিলায় হয় পুরোপুরি হাতগুটিয়ে নিয়েছে, না হলে এমন বিশাল অঙ্কের দৈনিক প্যাকেজ ধার্য করেছে যে সহজে কেউ করোনা নিয়ে ওমুখো হবে না। ফলে তাদের করোনা চিকিৎসার হ্যাপা বিশেষ সামলাতে হবে না। কলকাতার ইএম বাইপাসের ধারে এক করপোরেট হাসপাতাল করোনা চিকিৎসায় দৈনিক ৮০ হাজার টাকার প্যাকেজ ধার্য করে আপাতত শীর্ষে আছে।
বাংলার সর্বাধিক প্রচলিত দৈনিক বারবার সম্পাদকীয় লিখেআশঙ্কা প্রকাশ করছে, স্বাস্থ্যকে বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে বেঘোরে মরতে হবে। বলছে, চাই সামাজিক দায়িত্ববোধ, সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিকাঠামো। অথচ এই সব করপোরেট সংবাদমাধ্যমই সেই ১৯৯০-থেকে স্বাস্থ্য শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দায়িত্বকে পুরোপুরি বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করে এসেছে। বলেছে বাজারই আসল দেবতা। ছেড়ে দাও সব বাজারের হাতে। একের পর এক কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা রং-বেরংয়ের রাজ্য সরকারগুলি এই পথেই এগিয়েছে। সরকারি হাসপাতাল সহ সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ইচ্ছাকৃতভাবে পঙ্গু করে মানুষকে ঠেলা হয়েছে করপোরেট হাসপাতালের ঝাঁ-চকচকে লবিতে।
প্রশ্নটা প্রথম মানুষকে ধাক্কা দিয়েছিল ইতালির ক্ষেত্রে। যখন শোনা গেল সেখানকার সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে করোনা আক্রান্ত যে সব রোগীর বাঁচার আশা ক্ষীণ, তাদের চিকিৎসা দেবে না তারা। কারণ ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের চূড়ান্ত ঘাটতি। কিন্তু এক্ষেত্রে চিকিৎসা কে পাবে আর কে পাবে না, তা ঠিক করবে কে? চিকিৎসক, না বাজারি ব্যবস্থার একমাত্র আরাধ্য যা, সেই অর্থবল? পুঁজিবাদের অতি বড় রক্ষক এবং তার হয়ে গলা ফাটানো সাংবাদিকেরও পা কেঁপে গেছে এই বুর্জোয়া ব্যবস্থার স্বাভাবিক উত্তরটা আন্দাজ করে। কারণ বাজারি ব্যবস্থার নিয়ম বলে, অর্থবলই নির্ণায়ক শক্তি।
একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে? তাহলে আমেরিকার উদাহরণটাই বরং দেখা যাক। সম্প্রতি চিন থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হওয়া মিয়ামি প্রদেশের এক শ্রমিক করোনা নিয়ে ভর্তি হওয়ায় হাসপাতাল ধরিয়েছে ৩৯৭০.৭৫ ডলারের বিল (প্রায় ৩ লক্ষ ৩০ হাজারের কিছু বেশি ভারতীয় টাকা), পেনসিলভ্যানিয়ার একজনকে কম্পালসারি কোয়ারান্টাইনে রেখে সরকার বিল ধরিয়েছে ৩৯১৮ ডলারের ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৩ লক্ষ টাকা (টাইমস.কম,০৪.০৩.২০২০)। যেখানে বিরাট অংশের পার্টটাইম শ্রমিকের মাসিক আয় ১১০০ ডলারের আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করে। (দ্য স্ট্রিট.কম) চিকিৎসার এই বিপুল ব্যয় সামলাতে বহু মানুষ ডাক্তারের কাছেই যান না। টাইমসের এক সমীক্ষা দেখিয়েছে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাটা বিমা কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিয়ে সরকার হাত গুটিয়ে নিয়েছে। বিমার নামে যে অঙ্কের টাকা ছোট কোম্পানির কর্মচারীর মজুরির থেকে কেটে নেওয়া হয় তা তাদের পক্ষে এক বিরাট বোঝা। এর উপর নানা অজুহাতে বিমা কোম্পানি চিকিৎসার বিলের পুরোটা দেয় না। ফলে করোনা ছড়াচ্ছে বুঝতে পেরেও গরিব থেকে মধ্যবিত্ত মানুষ ডাক্তারের কাছে যাননি। যার ফলে এখন পুরো পরিস্থিতিটা হাতের বাইরে চলে গেছে। এই সমীক্ষা দেখাচ্ছে গত দুবছরে বিমার প্রিমিয়াম বেড়েছে ১৬২ শতাংশ। ফলে পঞ্চাশ শতাংশ আমেরিকান নাগরিক নিজের বা তার পরিবারের কোনও একজনের বিমা ছেড়ে দিয়েছেন। তারা রোগের থেকেও ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়াটাকে বেশি ঝুঁকির মনে করেন। কারণ কী অঙ্কের বিল আসবে সে বিষয়ে কারও কোনও ধারণা নেই (সূত্র : টাইমস.কম,০৪-০৩-২০২০) ।
সারা বিশ্বেই করপোরেট স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা করোনা অতিমারির চিকিৎসা থেকে প্রায় পুরোপুরি হাত গুটিয়ে আছে। তারা অপেক্ষায় কখন পরিস্থিতি একটু হালকা হবে, তখন তারা আবার এই রোগ নিয়ে ব্যবসায় নামবে। অথচ নয়া উদারিকরণের নীতিতে প্রায় সব পুঁজিবাদী দেশেই সরকার স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে পুঁজির লাভের জন্য খুলে দিয়েছে। যে ইংল্যান্ডে দীর্ঘ ঐতিহ্য অনুসারে সরকারি নিয়ন্ত্রণেই চলত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সেখানেও সরকারি ব্যবস্থা ৫ বছরে বেড়েছে মাত্র ০.০৩ শতাংশ আর বেসরকারি বিনিয়োগ প্রতি বছর বাড়ছে ৪.৫ শতাংশ হারে (ওএনএস.গভ.ইউকে)। এর বিষময় ফল হল বিশেষ রোগের চিকিৎসায় প্রযুক্তি বা বিশেষ ধরনের কিছু উন্নত চিকিৎসা হয়ত হচ্ছে। যেগুলি অধিক লাভজনক, সেদিকেই ব্যবসায়ীদের নজর বেশি। অবহেলিত হচ্ছে জনস্বাস্থ্য, সাধারণ স্বাস্থ্য পরিষেবা, যেটা স্বাস্থে্যর মূল ভিত্তি। করোনা যেহেতু গোষ্ঠীগত সংক্রমণের আকার নিচ্ছে এর প্রতিরোধের সাথে জনস্বাস্থে্যর পরিকাঠামো যুক্ত। এ ক্ষেত্রে লাভের সুযোগ কম। ফলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেনের মতো দেশেও করপোরেট হাসপাতালগুলি বাস্তবে কিছুই করছে না। অথচ সরকারি জনস্বাস্থ্য পরিষেবা ইতিমধ্যেই আগের থেকে দুর্বল। ফলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে সহজেই।
করোনা ভাইরাসজনিত অতিমারি আজ যেন মুখোশ খুলে দিয়েছে মুনাফাভিত্তিক বাজার অর্থনীতির। নিষ্ঠুর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাছে মানুষের দাম ততক্ষণই যতক্ষণ সে মুনাফা জোগায়। সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদ বাজার সংকট থেকে বাঁচতে আঁকড়ে ধরেছে স্বাস্থ্য বেচার বাজারকে। কিন্তু আজ যখন করোনার মতো অতিমারির ধাক্কায় সে বাজার ভেঙে পড়ার জোগাড়, তখন পুঁজি মালিকরা সেখানে টাকা ঢালতে যাবে না। তারা বসে আছে নতুন সুযোগের ধান্দায়। বর্বর নয়া উদারনীতিবাদের হাত ধরে আজ বাজার অর্থনীতি যে তীব্র আর্থ-সামাজিক সংকটের সৃষ্টি করেছে তার কারণেই পরিস্থিতি এত জটিল হয়ে পড়েছে।
একসময় বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য এক সর্বজনীন মৌলিক অধিকারে পরিণত হয়েছিল। এই দেশগুলির জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর সাফল্য সারা পৃথিবীতে যে আলোড়ন তুলেছিল তার ফলে প্রায় সমস্ত পুঁজিবাদী দেশের শাসকরা বাধ্য হয়েছিলস্বাস্থে্যর অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে সর্বজনীন টিকাকরণ থেকে শুরু করে মূল স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বিনামূল্যে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। আজ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনুপস্থিতিতে এই মৌলিক অধিকারটাই তারা কেড়ে নিচ্ছে। স্বাস্থ্য আজ ব্যবসার বড় ক্ষেত্র। করোনা ভাইরাসজনিত অতিমারি সামনে এনে দিল এই বাজার অর্থনীতির সর্বনাশা চরিত্রকে। তাই আজ আবার বৃহৎ সংবাদপত্র গোষ্ঠীকেও বাজারের জয়গান ছেড়ে সমাজের দায়িত্বের কথা, রাষ্ট্রেরর দায়িত্বের কথা স্মরণ করাতে হচ্ছে। ধনলোভী পুঁজিবাদ যে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করা দূরের কথা, তার বিপন্নতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা এই করোনা ভাইরাসজনিত অতিমারির সময়ে মানব সভ্যতাকে আবার বুঝতে হচ্ছে। কিন্তু বড়ই চড়া মূল্যে।