স্টারলাইট কারখানার ভয়াবহ দূষণ নীরবে কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ

গত দু’দশক ধরে চলা তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনের তামা উৎপাদক স্টারলাইট কোম্পানি মানুষের জীবনের প্রতি চূড়ান্ত ঔদাসীন্য দেখিয়েছে৷ বহুজাতিক বেদান্ত গোষ্ঠীর মালিকানাধীন এই কারখানা কর্তৃপক্ষ বছর বছর মুনাফার অঙ্ক বাড়িয়েছে, কিন্তু পরিবেশ দপ্তরের অবশ্যপালনীয় বিধির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করেনি, রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল ডি এম কে–র মদতে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে৷

কারখানার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির হাজার হাজার মানুষ পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে ধর্না–বিক্ষোভ–অবস্থান করেছে৷ বারবার তামিলনাড়ুর ডিএমকে সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছে, দূষণ রোধে সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করুক কারখানা কর্তৃপক্ষকে৷ কিন্তু না সরকার, না কারখানা কর্তৃপক্ষ কারও সাড়া মেলেনি৷

ভয়াবহ দূষণে গ্রামে গ্রামে ক্যান্সারের মতো মারণব্যাধি ও অন্যান্য রোগ ছড়িয়ে পড়েছে, বহু মানুষের মৃত্যু ঘটেছে৷ চিমনির উচ্চতা অনেক কম থাকায় জল ও বায়ু দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে৷ তুতিকোরিনের নিকটবর্তী সিলভারপুরম গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে৷ বহু পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম সদস্যের মৃত্যুতে অসহায় পরিজনেরা আর্থিক লড়াই চালাবার পাশাপাশি বিষাক্ত কারখানা বন্ধ করার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে গেছে৷ ভেতরে ভেতরে ক্ষোভের বারুদ জমা ছিল৷ তাতে অগ্নিনিক্ষেপ হল কারখানা প্রসারণের সিদ্ধান্তে৷ জনপদ পরিবেষ্টিত এই তামা কারখানার পরিসর আরও বাড়ালে জনজীবনের পক্ষে তা মারাত্মক ক্ষতিকারক হবে বুঝতে পেরে মার্চ মাস থেকে লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন গ্রামবাসীরা৷ প্রতিবাদের ‘১০০ দিনে’ ২২ মে মহিলা–পুরুষ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ শিশুদের নিয়ে জেলাশাসকের উদ্দেশে পূর্বঘোষিত মিছিলে সামিল হন৷ সরকারের পুলিস কাঁদানে গ্যাস, লাঠি ও গুলি চালিয়ে ১৩ জন আন্দোলনকারীকে হত্যা করে৷ এর মধ্যে রয়েছে ১৭ বছরের এক ছাত্রী, যার পরিবারের সকলেই এই আন্দোলনে ছিলেন৷

তামিলনাড়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গ্যাস লিক, বৃষ্টির জলের সাথে বিষাক্ত বর্জ্যপদার্থ বার করে দেওয়া, ভূ–পৃষ্ঠের জল দূষিত করা ইত্যাদি অভিযোগ আগেই তুলেছিল৷ কিন্তু বারেবারেই কোনও অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে অনায়াসে ক্লিনচিট জোগাড় করে নিচ্ছিল বেদান্ত গোষ্ঠী৷ বহুজাতিক এই কোম্পানির হাত এত লম্বা যে, ২০১৩ সালে গ্রামবাসীদের শুনানি শুনে সুপ্রিম কোর্ট লিখিতভাবে যা যা নির্দেশ দিয়েছিল, তার কিছুই তারা করেনি৷ শুধু তাই নয়, কারখানার দূষিত পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে ১৫ জন শ্রমিক মারা গিয়েছেন জানা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ লাভের অঙ্ক আরও বাড়িয়ে তোলা ছাড়া আর কিছু নিয়ে মাথা ঘামায়নি৷ অবশেষে ১৩ জন আন্দোলনকারীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মাদ্রাজ হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, কারখানা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হবে৷

আন্দোলনের এই জয় গ্রামবাসীদের, আন্দোলনকারীদের– যারা লাগাতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে, শ্রমিকদের প্রাণের বিনিময়ে প্রাণঘাতী এই কারখানা বন্ধ করাতে পারল৷ তুতিকোরিনের আন্দোলনের জয় প্রমাণ করল, মানুষ এককাট্টা হলে আন্দোলনের জয় অনিবার্য৷ বিরুদ্ধশক্তি, রাষ্ট্রযন্ত্র যত অস্ত্র প্রয়োগ করুক, যত হত্যাকাণ্ড চালাক, যত রক্তপাত ঘটাক, সংঘবদ্ধ আন্দোলনের শক্তিকে তা প্রতিহত করতে পারে না৷ বহুজাতিক সালেম গোষ্ঠী এ রাজ্যের নন্দীগ্রামে কৃষকদের জমি জবরদখল করার চেষ্টা করেছিল, রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিল সিপিএম সরকারের পুলিশ ও ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী, চলে গিয়েছিল বহু প্রাণ, কিন্তু মানুষ ছিনিয়ে এনেছিল নিজেদের জমি–ভিটের অধিকার৷ সেই আন্দোলনের পথে রাজ্যে রাজ্যে গরিব–সাধারণ মানুষ নানা অধিকারের দাবিতে লড়াই সংগঠিত করেছেন, বহু জায়গায় জয় ছিনিয়ে এনেছেন৷ তামিলনাড়ুর কুড়ানকুলামে মারাত্মক পরিবেশ দূষণকারী পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষ লাগাতার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন৷ মৎস্যজীবী সহ নানা পেশার মানুষেরা জনজীবনের এই ভয়ঙ্কর ক্ষতির বিরুদ্ধে লড়াই সংগঠিত করেছিলেন৷ তুতিকোরিনে স্টারলাইট কারখানা বন্ধের দাবিতে গ্রামবাসীদের আন্দোলন, গণপ্রতিরোধের তালিকায় নতুন এক উজ্জ্বল সংযোজন৷

(৭০ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৭জুন, ২০১৮)