সীমাহীন বঞ্চনার বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প শ্রমিকরা

 

বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ এই পোশাক শিল্প। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশই এসেছে পোশাক শিল্প থেকে। গত অর্থবর্ষে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪২.৬১ বিলিয়ন ডলার। আগে মূলত আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইউরোপের দেশগুলিতেই পোশাক রপ্তানি করত বাংলাদেশ।এখন বাজারের সীমানা সম্প্রসারণ ঘটেছে চিলি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, তুরস্ক সহ রাশিয়ার বাজার পর্যন্ত। অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলেও এই শিল্পের শ্রমিকদের জীবনমানের অগ্রগতি ঘটেছে কতটুকু?

জীবনমান উন্নত হওয়ার প্রধান সূচক রোজগার, তা একেবারেই কম। শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মূল মজুরি মাসিক মাত্র ৬৩ ডলার (২০২০-তে আইএলও-র রিপোর্ট), বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। এই নামমাত্র মজুরিতে জীবনের মানোন্নয়ন কি সম্ভব? তাই বাঁচার মতো মজুরির দাবিতে বারেবারেই বিক্ষোভ-আন্দোলনে ফেটে পড়তে দেখা যায় শ্রমিকদের।

অক্সফ্যামের ২০১৯-এর রিপোর্ট বলছে, প্রতি ১০ জন গার্মেন্টস শ্রমিকের মধ্যে ৯ জনই প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার পান না। বিনা পুষ্টিতে হাড়ভাঙা খাটুনি, রোগগ্রস্ত দেহে কোনও রকমে কাজ করে চলাই শ্রমিকদের ভবিতব্য। কাজের পরিবেশ নেই, নেই কোনও রকম নিরাপত্তা। বছরের পর বছর ধরে কয়েক লক্ষ শ্রমিক কাজ করেন বাংলাদেশের নানা পোশাক কারখানায়। ঘিঞ্জি এলাকায়় বহুতলে অন্ধকার পায়রার খোপের মতো ছোট ঘরে দিনরাত মুখ গুঁজে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করেন শ্রমিকরা। এঁদের বেশিরভাগই মহিলা। প্রসূতিদের কাজ থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয় নির্বিচারে। মালিকদের অবহেলায় বেশ কয়েক বছর ধরে কারখানা ধসে কিংবা আগুন লেগে শ্রমিকদের মৃত্যু স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ২০১২ সালে পোশাক কারখানায় আগুনে পুড়ে ও দমবন্ধ হয়ে মারা যান শতাধিক শ্রমিক। তখন কিছুটা হইচই হলেও শ্রমিক-নিরাপত্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কারখানা চালিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। একচেটিয়া বড় বড় পোশাক শিল্পের মালিকরা বাড়তি মুনাফা করার জন্য শ্রমিকদের শ্রমকে পুরোপুরি নিংড়ে নেয়। সেজন্য মহিলা শ্রমিকরা শিশুসন্তান ছেড়ে দু’বেলা কাজ করেও পরিবার প্রতিপালনের জন্য ন্যূনতম রোজগার করতে পারছেন না। বিশ্বের অন্যান্য পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশের মতো চরম মালিকি শোষণে তাদের শ্রম আজ অধিক মুনাফার পণ্য।

শ্রমিকদের লাগাতার আন্দোলনের চাপে ২০১৮ সালে সরকার মজুরি বোর্ড গঠন করে গার্মেন্টস সেক্টরে নতুন মজুরি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। তা কার্যকর হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে। মৌলিক চাহিদা, ক্যালরির পরিমাণ, বাজারমূল্যকে বিবেচনায় রেখে শ্রমিকরা এবং আন্দোলনরত শ্রমিক সংগঠনগুলো গামের্ন্টস সহ সব সেক্টরে নূ্যনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা দাবি করেছিল। কিন্তু এই দাবিতে কান না দিয়ে মালিক মজুরি নির্ধারণ করে মাত্র ৮ হাজার টাকা, যা সুস্থ জীবনযাপনের নিরিখে অত্যন্ত কম। আওয়ামি লিগ সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকায় থেকেছে। অন্যদিকে বেতন-বৃদ্ধির অজুহাতে মালিকরা শ্রমিকদের কাজের চাপ বাড়িয়ে দেয়। শ্রমিক প্রতি উৎপাদন টার্গেট বাড়ানো হয় দ্বিগুণ-তিনগুণ। শ্রমিকদের মজুরি আগেকার ৫ হাজার ৩০০-এর বদলে ৮ হাজার টাকা হলেও বাড়ি ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়তে থাকায় শ্রমিকদের আর্থিক দুর্দশা রয়েই গেল।

বর্তমানে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে জীবনযাত্রার খরচ, শ্রমিক ও তার পরিবারের চাহিদা, উৎপাদনের খরচ, উৎপাদনশীলতা, পণ্যের দাম, নিয়োগকারীদের সক্ষমতা, দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা ও মুদ্রাস্ফীতি-মূল্যবৃদ্ধি সহ সবকিছু বিবেচনা করলে সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকার কম হলে বেঁচে থাকা অসম্ভব। এই শিল্পে ক্রমাগত মুনাফা বৃদ্ধি সত্ত্বেও বাঁচার মতো মজুরি দিতে নারাজ মালিকরা। শ্রমিক হিসাবে প্রাপ্য অধিকার ও ২৫ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে শ্রমিক আন্দোলনে আবারও উত্তাল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। মিছিল, লাগাতার ধর্না, ধর্মঘটের পথে যেতে বাধ্য হয় তারা। যদিও শ্রমিকদের বুঝতে হবে, মজুরি বৃদ্ধির দাবি পূরণ হলেই তার জীবনের সমস্যার সমাধান হবে না। আর দক্ষতা বৃদ্ধি ও উৎপাদন বৃদ্ধি হলেও মালিকরা তাদের জীবনের সমস্যা মেটাবে না। কারণ পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের শ্রম বাবদ প্রাপ্য ন্যায্য মজুরি ফাঁকি দিয়ে অর্থাৎ তাদের শ্রম শোষণ করেই মুনাফার পাহাড় বাড়িয়ে চলে। ফলে এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ ছাড়া শোষণের নাগপাশ থেকে শ্রমিকের মুক্তি সম্ভব নয়।

ভারতের কংগ্রেস-বিজেপির মতো বাংলাদেশের পূর্বতন বিএনপি কিংবা বর্তমানের আওয়ামি লিগ সরকার মালিকদের ম্যানেজার হিসাবে কাজ করে চলেছে, ফলে শ্রমিক স্বার্থ মার খাচ্ছে বছরের পর বছর। সরকারের মালিক তোষণ এতটাই যে, করোনা কালে শ্রমিকদের যখন চরম দুরবস্থা, তখন গার্মেন্টস মালিকরা মাত্র ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে ৯ হাজার কোটি টাকা উপহার সহ নামমাত্র সুদে ৩০ হাজার কোটি টাকার শিল্প ঋণের সুবিধা পেয়েছে আওয়ামি লিগ সরকারের কাছ থেকে। এর সবটাই আসলে পাবলিক মানি। এ ছাড়াও সরকার মালিকদের স্বার্থে রপ্তানিতে উৎস-কর কমিয়ে ০.২৫ (নামমাত্র) করেছে। বিশ্বের অন্যান্য পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশের মতো এ দেশের পুঁজিপতি শ্রেণিকে তোষণ করে চলা সরকার কীভাবে শ্রমিকদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে মালিকদের তহবিল ভরাচ্ছে তার অন্যতম উদাহরণ পোশাক-শিল্প। ভারতে বিজেপি সরকার গত পাঁচ বছরে শিল্পপতিদের ১০.৫৭ লক্ষ কোটির ঋণ মুছেছে, সংসদের রিপোর্টে জানা গেছে। আর ৯ বছরে শিল্পপতিদের ১৪.৫ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মুছে দিয়ে মকুব করেছে, তাদের উৎসাহ-ট্যাক্স জোগান দিচ্ছে বিজেপি সরকার, তেমনই বাংলাদেশের শিল্পপতিদের প্রতি দাক্ষিণ্য দেখাচ্ছে সে দেশের সরকার। বিএনপি বা আওয়ামি লিগ কোনও সরকার যে শ্রমিকদের স্বার্থ দেখবে না, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন শ্রমিকরা। আন্দোলন ছাড়া সমস্যা সুরাহার আর কোনও পথ নেই বুঝে শ্রমিকরা জীবন বাজি রেখে আন্দোলনের রাস্তাতেই নেমেছেন।