সাম্যবাদের মূল নীতি (২) — ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস

১৮৪৭ সালে কমিউনিস্ট লিগের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে একটি কর্মসূচি তৈরির সিদ্ধান্ত হয়৷ রচনার দায়িত্ব নেন লিগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস৷ প্রথম খসড়াটির নাম রাখা হয়েছিল, ‘ড্রাফট অফ এ কমিউনিস্ট কনফেশন অফ ফেথ’৷ এই খসড়াটির কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ প্রশ্ণোত্তরে লেখা বর্তমান রচনাটি দ্বিতীয় খসড়া রূপে এঙ্গেলস তৈরি করেন৷ কমিউনিজমের আদর্শকে সহজ ভাষায় বোঝাবার জন্য প্রশ্নোত্তর রূপে লিখলেও, এঙ্গেলস এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না৷ ১৮৪৭–এর ২৩ নভেম্বর মার্কসকে এক চিঠিতে তিনি লেখেন– প্রশ্নোত্তরে লেখাটার উপর একটু ভাবনা–চিন্তা কোরো৷ আমার মনে হয়, এভাবে চলবে না৷ ইতিহাসের ঘটনাবলি কিছু যুক্ত করেই এটা দাঁড় করাতে হবে এবং নামও হওয়া উচিত ‘কমিউনিস্ট ইস্তাহার’৷ ১৮৪৮ সালেই প্রকাশিত হয় মার্কস–এঙ্গেলস রচিত সেই কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো বা ইস্তাহার৷ সুতরাং বর্তমান প্রশ্নোত্তরের লেখাটিকে কমিউনিস্ট ইস্তাহারের খসড়া হিসাবেই দেখতে হবে৷ এঙ্গেলসের ২০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছি৷ এবার দ্বিতীয় কিস্তি৷

প্রশ্ণ : কারিগরদের সাথে সর্বহারার পার্থক্য কোথায়?

উত্তর : সর্বহারার বিপরীতে তথাকথিত যে কারিগর (হস্তশিল্পী) সম্প্রদায়কে গত শতাব্দীতে (অষ্টাদশ) প্রায় সর্বত্র দেখা যেত এবং এখনও স্থানে স্থানে তাদের পাওয়া যায়, তারা বড়জোর সাময়িকভাবে সর্বহারা৷ তাদের লক্ষ্য থাকে নিজস্ব পুঁজি সঞ্চয় করার, যার মাধ্যমে অন্য মজুরদের শোষণ করা যায়৷ এই লক্ষ্য পূরণ তাদের পক্ষে সম্ভব– যেখানে এখনও কারিগরদের গিল্ডের অস্তিত্ব আছে অথবা যেখানে গিল্ডের প্রভাবমুক্ত স্বাধীন পেশায় থাকা কারিগরদের উৎপাদন এখনও কারখানা ভিত্তিতে সংগঠিত হয়নি এবং সে কারণে এখনও হিংস্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হয়নি৷ কিন্তু যে মুহূর্তে কারুশিল্প কারখানা–ডৎপাদন ব্যবস্থার অন্তর্গত হল এবং প্রতিযোগিতা পুরোপুরি মাথা তুলল, আগের পরিস্থিতি ক্রমাগত লুপ্ত হয়ে কারিগররা বেশি বেশি করে সর্বহারায় রূপান্তরিত হতে লাগল৷ এইভাবে কারিগররা হয় নিজেরাই বুর্জোয়ায় পরিণত হয়ে, অথবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তে পরিণত হয়ে নিজেদের মুক্ত করল৷ আর না হলে প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে তারা পরিণত হল সর্বহারায় (আজকের দিনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা ঘটছে)৷ এই অবস্থায় তারা সর্বহারা আন্দোলনে যোগ দিয়ে যথার্থ মুক্তি অর্জন করতে পারে– যা বলতে গেলে বাস্তবে কমিউনিস্ট আন্দোলন৷

(এই প্রশ্নটির উত্তরের জায়গাটি এঙ্গেলস খসড়ায় ফাঁকা রেখেছিলেন৷ কিন্তু এই রচনার ঠিক আগে লেখা ‘ড্রাফট অফ এ কমিউনিস্ট কনফেশন অফ ফেথ’–এ ১২ নম্বর প্রশ্ন এবং উত্তরটি ছিল হুবহু এক৷ সেটিই এখানে দেওয়া হল৷ সূত্র : কার্ল মার্কস –ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস কালেক্টেড ওয়ার্কস, ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স নিউইয়র্ক, ১৯৭৬)

প্রশ্ন : প্রাক–শিল্পবিপ্লব ক্ষুদ্র উৎপাদন শ্রমিকদের (ম্যানুফ্যাক্টরি শ্রমিক) সঙ্গে সর্বহারাদের তফাৎ কোথায়?

উত্তর : সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকের ম্যানুফ্যাক্টরি শ্রমিকদের হাতে কিছু উৎপাদনের হাতিয়ার যেমন, নিজস্ব তাঁত, পারিবারিক সুতা কাটার যন্ত্র, অবসর সময়ে চাষবাস করা চলে এমন ছোট একখণ্ড জমি– এসব ছিল এবং এখনও কোথাও কোথাও তা আছে৷ সর্বহারার এসব কিছুই নেই৷

ম্যানুফ্যাক্টরি শ্রমিকেরা মূলত গ্রামাঞ্চলে বাস করত এবং জমিদার বা নিয়োগকারীদের সঙ্গে খানিকটা পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল৷ সর্বহারা মূলত শহরবাসী এবং নিয়োগকারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক নিখাদ আর্থিক৷

বৃহৎ শিল্প ম্যানুফ্যাক্টরি শ্রমিককে তারএই পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক থেকে ছিন্ন করল শুধু নয়, তার সামান্য যা নিজস্ব সম্পত্তি ছিল, এর ফলে তাও সে হারাল এবং এভাবেই পরিণত হল সর্বহারায়৷

প্রশ্ন : শিল্প–বিপ্লব এবং বুর্জোয়া আর সর্বহারার মধ্যে সমাজ বিভক্ত হয়ে যাওয়ার তাৎক্ষণিক ফলাফল কী হয়েছিল?

উত্তর : প্রথমত, যন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদনের ফলে শিল্পজাত দ্রব্য সমানে সস্তা হয়ে যেতে থাকল৷ ফলে, কায়িক শ্রমের ভিত্তিতে চলা ক্ষুদ্র উৎপাদন শিল্পের (ম্যানুফ্যাক্টরি) পুরনো প্রণালীটা পৃথিবীর সমস্ত দেশে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল৷ যে সকল অর্ধসভ্য (সেমি বারবারিয়ান) দেশ তখনও পর্যন্ত এই ঐতিহাসিক অগ্রগতির ধারা থেকে কিছুটা হলেও বিচ্ছিন্নছিল এবং তাদের ডৎপাদন পদ্ধতি তখনও পুরনো উৎপাদন প্রণালীতে চলত, তাদের বিচ্ছিন্নতার গণ্ডি থেকে বলপূর্বক উচ্ছেদ করা হল৷ ব্রিটিশের অপেক্ষাকৃত সস্তা পণ্যদ্রব্য কেনার মাধ্যমে নিজেদের ক্ষুদ্র উৎপাদন–শ্রমিকদের্ ধ্বংস হয়ে যেতে দিতে হল তাদের৷ হাজার হাজার বছরেও যে সব দেশে প্রগতির চিহ্ণ দেখা যায়নি–যেমন, ভারতবর্ষ–সেখানেও আগাগোড়া বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেল, এমনকি, চীনও বিপ্লবের পথে হাঁটা শুরু করল৷

আজ এমন এক পরিস্থিতি এসেছে যে, ইংল্যান্ডে উদ্ভাবিত একটা যন্ত্র বছরখানেকের মধ্যে চীনের লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে কর্মহীন করে দেয়৷

বৃহদায়তন শিল্প এইভাবে পৃথিবীর সমস্ত জাতিকে একটা সম্পর্কের মধ্যে টেনে এনেছে৷ ছোট ছোট সমস্ত স্থানীয় বাজারকে জুড়ে দিয়েছে বিশ্ব–বাজারে, সভ্যতা আর প্রগতির পথ সুগম করেছে সর্বত্র৷ উন্নত দেশগুলির ঘটনা প্রবাহের দ্বারা যাতে দুনিয়ারসমস্ত দেশ প্রভাবিত হয় সেই ব্যবস্থা করেছে৷

তাই আজ ইংল্যান্ড কিংবা ফ্রান্সের শ্রমিকরা মুক্তি অর্জন করলে তা নিশ্চিতভাবে বিশ্বের সমস্ত দেশের শ্রমিককে বিপ্লবের রাস্তা দেখাবে৷ আজ হোক আর কাল বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এই সমস্ত দেশের শ্রমিক মুক্তি অর্জনে সফল হবেই৷

দ্বিতীয়ত, যেখানেই ক্ষুদ্র শিল্পকে হটিয়ে তার জায়গায় বৃহদায়তন শিল্প এসেছে, সেখানেই শিল্প বিপ্লব বুর্জোয়াদের উন্নতির শিখরে নিয়ে গেছে৷ তাদের সম্পদ ও ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ জায়গায় নিয়ে গেছে, তাদের প্রধান শ্রেণি হিসাবে গড়ে তুলেছে৷ তার ফল হয়েছে, যেখানেই এই ঘটনা ঘটেছে সেখানে বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করেছে এবং উচ্ছেদ করেছে পূর্বতন সমস্ত শাসক শ্রেণি–অভিজাতকূলকে, গিল্ডের মনিবদের এবং এই দু’য়ের প্রতিভূ নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রকে৷

সম্পত্তির উত্তরাধিকারকে বংশানুক্রমেকুক্ষিগত করে রাখার অধিকারকে বাতিল করে এবং ভূমি–সম্পত্তিকে ক্রয়–বিক্রয়ের যোগ্য করে দিয়ে, উচ্চবর্গীয়দের সমস্ত বিশেষ অধিকার লোপ করে বুর্জোয়ারা অভিজাত এবং উচ্চবর্গীয়দের ক্ষমতা চূর্ণ করেছিল৷ গিল্ডগুলিকে এবং হস্তশিল্পীদের বিশেষ অধিকারকে লোপ করে বুর্জোয়ারা গিল্ড মালিকদের ক্ষমতা চূর্ণ করেছিল৷ তাদের জায়গায় তারা এনেছিল অবাধ প্রতিযোগিতা, অর্থাৎ এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা যেখানে যে কোনও ব্যক্তির অধিকার রয়েছে তার পছন্দমতো শিল্পের যে কোনও শাখায় প্রবেশ করার৷ এ কাজে আবশ্যক পুঁজির অভাব ছাড়া অন্য কোনও কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না৷

অবাধ প্রতিযোগিতার প্রবর্তন সর্ব সমক্ষে ঘোষণা করে দিল– এখন থেকে সমাজের সভ্যদের মধ্যে একটিমাত্র বৈষম্যই বিরাজ করবে, তা হল, তাদের হাতে সঞ্চিত পুঁজির পরিমাণের বৈষম্য৷ পুঁজিই হয়ে উঠল ক্ষমতার নির্ণায়ক শক্তি, তাই পুঁজির মালিকবুর্জোয়াশ্রেণিই হয়ে উঠল সমাজের সর্বপ্রধান শ্রেণি৷ বৃহৎ শিল্পের সূচনার সময়ে অবাধ প্রতিযোগিতা ছিল প্রয়োজনীয় শর্ত, কারণ একমাত্র এই সামাজিক অবস্থার মধ্যেই বৃহদায়তন শিল্প বিস্তার লাভ করতে পারে৷

অভিজাতবর্গ আর গিল্ড মালিকদের সামাজিক ক্ষমতা চূর্ণ করার সঙ্গে সঙ্গে বুর্জোয়ারা চূর্ণ করল তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাও৷ সমাজে সর্বপ্রধান শ্রেণি হয়ে ওঠার সাথে সাথে বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সর্বপ্রধান শ্রেণি হিসাবে নিজেদের ঘোষণা করল৷ তারা এ কাজ করল প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে৷ এই শাসনব্যবস্থার মূল অবলম্বন হল– বুর্জোয়া সাম্যের ধারণার ভিত্তিতে আইন ও অবাধ প্রতিযোগিতার আইনি স্বীকৃতি৷ ইডরোপের দেশগুলিতে এই শাসনব্যবস্থা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ এই সব নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের দেশে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পুঁজির মালিকেরাই, অর্থাৎ কেবলমাত্র  বুর্জোয়ারাই ভোটদানের অধিকারী৷ এই বুর্জোয়া ভোটাররাই ডেপুটিদের নির্বাচন করে, এবং এই বুর্জোয়া ডেপুটিরা কর দিতে অস্বীকার করার অধিকার প্রয়োগ করে নির্বাচন করে একটি বুর্জোয়া সরকার৷

তৃতীয়ত, শিল্প বিপ্লব যেমন বুর্জোয়াদের সৃষ্টি করেছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সৃষ্টি করেছে সর্বহারাদের৷ যে–মাত্রায় বুর্জোয়াদের সম্পদবৃদ্ধি ঘটেছে, সেই মাত্রায় সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে সর্বহারাদের৷ যেহেতু একমাত্র পুঁজিই সর্বহারাকে কাজে নিয়োগ করতে পারে, আবার পুঁজি কেবল তখনই বাড়তে পারে যখন সে নিযুক্ত করে শ্রম, তাই সর্বহারার বৃদ্ধি ঘটে ঠিক পুঁজির বৃদ্ধির সঙ্গে সমান তালে৷ একই সঙ্গে শিল্প–বিপ্লব বুর্জোয়া এবং সর্বহারা উভয়কেই জড়ো করে বড় বড় শহরে, যেখানে শিল্প চালানো সবচেয়ে লাভজনক৷ একই জায়গায় এই বিপুল জনসমষ্টির একত্রিত হওয়ার ঘটনা সর্বহারাদের তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলে৷ এই ব্যবস্থা যত অগ্রসর হয়, তত বেশি করে উদ্ভব হয় শ্রম–সাশ্রয়কারী যন্ত্রের, যা ক্রমাগত উচ্ছেদ করে কায়িক শ্রমকে, ততই তা মজুরিকে নামিয়ে নিয়ে যায় একেবারে নূ্যনতম জায়গায়, যা সর্বহারাদের জীবনকে ক্রমাগত অসহনীয় করে তোলে৷ একদিকে সর্বহারাদের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এবং অন্যদিকে তাদের উত্তরোত্তর শক্তিবৃদ্ধি সর্বহারা সমাজ–বিপ্লবের পথ প্রস্তুত করে তোলে৷

প্রশ্ন : শিল্প–বিপ্লবের অন্যান্য ফলাফল কী?

উত্তর : স্টিম ইঞ্জিন এবং অন্যান্য যন্ত্রের সাহায্যে বৃহদায়তন শিল্পতিদ্রুত এবং স্বল্প খরচে উৎপাদনকে সীমাহীনভাবে বাড়িয়ে চলার উপায় আয়ত্ত করল৷ উৎপাদনের স্বচ্ছন্দতার কল্যাণে অবাধ প্রতিযোগিতা, যা বৃহদায়তন শিল্পের অবশ্যম্ভাবী ফল, তা অচিরেই চরম মাত্রায় তীব্র হয়ে উঠল৷ বহুসংখ্যক পুঁজিপতি লেগে গেল শিল্পে, অল্প সময়ের মধ্যেই উৎপাদন হতে থাকল প্রয়োজনের তুলনায় বেশি৷ উৎপাদিত পণ্যের বিক্রির উপায় থাকল না৷ ফলে দেখা দিল তথাকথিত এক বাণিজ্যিক সংকট৷ কল–কারখানা বন্ধ করে দিতে হল৷ সেগুলির মালিকেরা হল দেউলিয়া, শ্রমিকদের অন্ন ঘুচল৷ সর্বত্র ঘনিয়ে এল শোচনীয় দুর্দশা৷ কিছুকাল পরে উদ্বৃত্ত উৎপাদন বিক্রি হল৷ কল কারখানাগুলি আবার চলতে শুরু করল, মজুরি বাড়ল, আগের চেয়ে ব্যবসা–বাণিজ্যে এল তেজিভাব৷ কিন্তু বেশি দিন গেল না৷ আবার পণ্য উৎপন্ন হতে থাকল বড় বেশি, আরও একটা নতুন সংকট ছড়িয়ে পড়ল এবং আগেরটার পথেই তা এগোতে থাকল৷ এইভাবে, এই শতাব্দীর (ঊনবিংশ) শুরু থেকে শিল্প পর্যায়ক্রমে কখনও বাড়বাড়ন্ত কখনও সংকটের আবর্তের মধ্যে ওঠা–পড়া করেছে অবিরাম৷ প্রায় প্রতি  পাঁচ থেকে সাত বছর অন্তর নতুন সংকটের প্রাদুর্ভাব ঘটে, যা সব সময় বয়ে নিয়ে এসেছে শ্রমিকদের আরও অবর্ণনীয় দুর্গতি এবং একই সাথে নিয়ে এসেছে সর্বব্যাপক বৈপ্লবিক আলোড়ন, আর প্রচলিত পুরো ব্যবস্থার জন্য চূড়ান্ত বিপদ৷

প্রশ্ন : পর্যায়ক্রমে ফিরে আসা এইসব বাণিজ্যিক সংকটের পরিণতি কী?

উত্তর :  প্রথমত, বৃহদায়তন শিল্প তার বিকাশের প্রারম্ভিক পর্বে নিজেই অবাধ প্রতিযোগিতার জন্ম দিলেও এই শিল্পের বৃদ্ধি এখন অবাধ প্রতিযোগিতার পরিধি ছাপিয়ে গেছে৷ একদিকে প্রতিযোগিতা অন্যদিকে ব্যক্তিমালিকানায় শিল্পোৎপাদন বৃহদায়তন শিল্পের পায়ে বেড়ির মতো জড়িয়ে গেছে৷ এই শৃঙ্খলকে শিল্পের অবশ্যই ভাঙা চাই এবং তা সে ভাঙবেই৷ যতদিন বৃহদায়তন শিল্প বর্তমান ভিত্তিতে চলবে, তা চলতে পারে শুধু সাত বছর অন্তর–ন্তর পুনরাবৃত্ত সর্বব্যাপক বিশৃঙ্খল অবস্থার ভিতর দিয়ে৷ এই অবস্থা শুধু সর্বহারাদের চরম দুর্দশার আবর্তে ঠেলে দেয় না, একই সাথে তা ধ্বংস করে বিরাট সংখ্যক বুর্জোয়াকে এবং এর মধ্য দিয়ে তা বারে বারে বিপন্ন করে সমগ্র সভ্যতাকে৷ ফলে সমাজকে হয় বৃহদায়তন শিল্প ত্যাগ করতে হবে, যা একেবারেই অসম্ভব, নইলে সমাজকে অনিবার্যভাবে সংগঠিত করতে হবে সম্পূর্ণ নতুন রূপে– যেখানে শিল্পোৎপাদন পরিচালিত হয় পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তি–মালিকদের দ্বারা নয়, সমাজের প্রত্যেকের কথা বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে সমাজের দ্বারা৷

দ্বিতীয়ত, বৃহদায়তন শিল্প এবং তার উৎপাদনবৃদ্ধির অসীম ক্ষমতা এমন এক সমাজব্যবস্থার উদ্ভব ঘটাতে পারে যেখানে জীবনধারণের উপকরণগুলির উৎপাদনের প্রাচুর্য সমাজের প্রত্যেকটি সদস্যকে পূর্ণতম মাত্রায় তার শক্তি ও সামর্থ্যকে বিকশিত করতে এবং যথার্থ স্বাধীনভাবে তা প্রয়োগ করার সুযোগ দেয়৷ সঠিকভাবে বলতে গেলে, বৃহদায়তন শিল্পের যে বৈশিষ্ট্য আজকের সমাজে যাবতীয় দুর্দশা আর বাণিজ্যিক সংকটের জন্ম দিচ্ছে, ভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতিতে এর সেই বৈশিষ্ট্যই এইসব দুর্দশা এবং বিপর্যয়কর ওঠা–পড়ার অবসান ঘটাবে৷

এর মধ্য  দিয়ে স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে :

১৷ এখন থেকে সমস্ত সামাজিক অকল্যাণের জন্য সেই বিশেষ সমাজব্যবস্থাই দায়ী বলে বুঝতে হবে, যে ব্যবস্থা সমাজের বাস্তব প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়৷

২৷ একটা নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে এই সমস্ত অকল্যাণ নিঃশেষে দূর করা সম্ভব৷

প্রশ্ন : এই নতুন সমাজব্যবস্থাকে কেমন হতে হবে?

উত্তর : এই নতুন সমাজ সর্বপ্রথমে, পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের হাত থেকে শিল্প এবং উৎপাদনের সমস্ত শাখার পরিচালনার ভার কেড়ে নেবে৷ এর বিপরীতে নতুন সমাজব্যবস্থা উৎপাদনের সমস্ত শাখাকে সামগ্রিকভাবে পরিচালনা করবে সামাজিক কর্তৃত্বে৷ অর্থাৎ সমাজের সকল সদস্যের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সামাজিক কল্যাণের জন্য সামগ্রিক পরিকল্পনা অনুসারে তা পরিচালিত হবে৷ এর মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতার অবসান ঘটে আসবে সম্মিলিত প্রয়াস৷ ব্যক্তির দ্বারা শিল্প পরিচালনার অবশ্যম্ভাবী ফল ব্যক্তি মালিকানা৷ যেহেতু ব্যক্তি মালিকদের শিল্প চালাবার ধরনই হল পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা, তাই শিল্পের ব্যক্তিগত পরিচালনা এবং প্রতিযোগিতা থেকে ব্যক্তিগত মালিকানাকে আলাদা করা যায় না৷ কাজেই ব্যক্তিগত মালিকানারও অবসান ঘটাতে হবে৷ তার জায়গা নেবে সর্বসাধারণের দ্বারা উৎপাদনের সমস্ত হাতিয়ারের ব্যবহার এবং সর্বসাধারণের সম্মতির ভিত্তিতে সমস্ত উৎপাদনের বণ্ঢন৷ যাকে বলা হয় দ্রব্যসামগ্রীর যৌথ মলিকানা৷ এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, ব্যক্তি মালিকানার বিলুপ্তিই হল গোটা সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর যা বৃহদায়তন শিল্পের বিকাশের ফলে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনার সংক্ষিপ্ততম এবং তাৎপর্যপূর্ণ  প্রকাশ৷ কমিউনিস্টরা সঠিকভাবেই ব্যক্তি সম্পত্তি বিলুপ্তির দাবিকে তাদের প্রধান দাবি হিসাবে তুলে ধরেছে৷

প্রশ্ন : ব্যক্তিগত সম্পত্তি লোপ কি এর আগে সম্ভব ছিল না?

উত্তর : না৷ সমাজব্যবস্থার প্রত্যেকটা পরিবর্তন, মালিকানা সম্পর্কের প্রত্যেকটা বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন হল নতুন নতুন উৎপাদিকা–শক্তি সৃষ্টি হওয়ার অপরিহার্য ফল৷ এই নতুন উৎপাদিকা–শক্তি পুরনো মালিকানা সম্পর্কের সঙ্গে আর মানানসই থাকে না৷ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবও এই পথেই হয়েছে৷ ব্যক্তিগত সম্পত্তি চিরকাল ছিল না৷ কিন্তু মধ্যযুগের শেষের দিকে চালু হয়েছিল এক নতুন উৎপাদনব্যবস্থা, সেটা হল ম্যানুফ্যাকচার (ছোট কারখানায় উৎপাদন ব্যবস্থা)৷ তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক আর গিল্ডের সম্পত্তির সঙ্গে এই উৎপাদন সম্পর্ক খাপ খাচ্ছিল না৷ এই উৎপাদন পদ্ধতি পুরনো মালিকানা সম্পর্কের পরিধিকে ছাপিয়ে গিয়ে জন্ম দিল নতুন ধরনের মালিকানা– ব্যক্তিগত মালিকানা৷ ম্যানুফ্যাকচার এবং বৃহদায়তন শিল্প গড়ে ওঠার প্রথম পর্যায়ের কালে ব্যক্তিগত মালিকানা ছাড়া কোনও ধরনের মালিকানা সম্ভব ছিল না৷ এই ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা নতুন সমাজব্যবস্থা ছাড়া অন্য সমাজব্যবস্থাও সেদিন সম্ভব ছিল না৷

যতদিন পর্যন্ত সকলের চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ উৎপাদনকে ছাপিয়ে গিয়ে সামাজিক পুঁজির বৃদ্ধি এবং উৎপাদিকা শক্তির আরও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্বৃত্ত উৎপাদন সম্ভব না হয়, ততদিন পর্যন্ত সমাজে একটা প্রভুত্বকারী শ্রেণি সর্বদাই থাকে৷ যে শ্রেণি সমাজের উৎপাদিকা–শক্তিসমূহ পরিচালক, আর থাকে একটি দরিদ্র উৎপীড়িত শ্রেণি৷ উৎপাদনব্যবস্থার বিকাশের স্তরের উপর নির্ভর করে শ্রেণি–দুটির গঠন৷ মধ্যযুগ ছিল কৃষির উপর নির্ভরশীল, তখন ছিল ভূস্বামী আর ভূমিদাস৷ মধ্যযুগের শেষ ভাগের শহরগুলিতে আমরা দেখতে পাই দক্ষ কারিগর (গিল্ডসম্যান) ও তার অধীনে নানা শিক্ষানবিশ আর দিন মজুরদের৷ সপ্তদশ শতকে–ম্যানুফ্যাকচারার এবং ম্যানুফ্যাক্টরি শ্রমিক৷ উনিশ শতকে– বড় কারখানার মালিক আর সর্বহারা৷

এটা নিতান্ত স্পষ্ট যে, এর আগে পর্যন্ত সকলের জন্য পর্যাপ্ত উৎপাদন করার মতো বিকাশ উৎপাদিকা শক্তির ঘটেনি, যাতে ব্যক্তিগত মালিকানা উৎপাদিকা শক্তিকে শৃঙ্খলিত করে তাকে  বাধা দেয়৷ কিন্তু বৃহদায়তন শিল্পের সম্প্রসারণের ফলে এখন, প্রথমত, পুঁজি আর উৎপাদিকা শক্তি এমন পরিসরে সৃষ্টি হয়েছে যা এযাবৎ শোনা যায়নি৷ অল্পকালের মধ্যেই উৎপাদিকা শক্তির অসীম বৃদ্ধির উপায়–উপকরণ আজ মজুত৷ দ্বিতীয়ত, এইসব উৎপাদিকা শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়েছে মুষ্টিমেয় বুর্জোয়াদের হাতে, পক্ষান্তরে বিপুল জনরাশি ক্রমাগত বেশি বেশি পরিমাণে পরিণত হচ্ছে সর্বহারায়৷ যে পরিমাণে বুর্জোয়াদের ধনদৌলত বাড়ছে ঠিক সেই পরিমাণেই বিপুল জনরাশির দুর্দশা এবং দুর্বিষহ অবস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ তৃতীয়ত, এই মহাশক্তিশালী উৎপাদিকা শক্তিকে সহজেই বিপুল পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব৷ এর বৃদ্ধি ব্যক্তিগত মালিকানা এবং বুর্জোয়া ব্যবস্থার পরিধিকে এতখানি ছাড়িয়ে গেছে এর ধাক্কায় বারে বারে তীব্র আলোড়নে সমাজব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে৷ তাই এখনই ব্যক্তিগত সম্পত্তি লোপ করার সম্ভাবনা বাস্তব হয়ে উঠেছে শুধু তাই নয়, তা হয়ে উঠেছে একেবারেই অপরিহার্য৷ (চলবে)

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১৮ সংখ্যা)