সরকারি মদতে জ্বালানি তেলের ব্যবসায় বেপরোয়া লুঠ

পেট্রোল-ডিজেল ও ভোজ্য তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৯ জুন, দিল্লির গাজীপুর বর্ডারে এআইকেকেএমএস এর বিক্ষোভ

অতিমারি এবং দীর্ঘ লকডাউনের পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি সরকার পেট্রোল-ডিজেলের ভয়ানক মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে কর্পোরেট হাউসগুলিকে নির্মম ভাবে জনগণের রক্ত শোষণের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। সংগঠিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পরিবেশ না থাকায় জনসাধারণকে বাধ্য করা হচ্ছে অগ্নিমূল্যে পেট্রোল-ডিজেল কিনতে। পেট্রোল-ডিজেলের এই মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলে প্রতিটি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে ব্যাপক হারে।

লিটার পিছু পেট্রোলের দাম হয়েছে বর্তমানে মুম্বাইতে ১০১.৫৭ টাকা, ডিজেল ৯৩.৬৪ টাকা। দামের এই ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত। কারণ হিসেবে চিরকালীন সেই ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছে সরকার। ৭ জুন কেন্দ্রীয় তেলমন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান জানিয়েছেন, ‘ভারতে প্রায় ৮০ শতাংশ জ্বালানিই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম বেড়ে চলেছে। এই যুক্তির বিরুদ্ধে যেন কারওর একটা কথাও বলার নেই! অথচ, এর থেকে জলজ্যান্ত মিথ্যা আর কিছু হয় না।

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে চলার চিত্রটা বাস্তবে কী? মোদি সরকার যখন ক্ষমতায় এল, অর্থাৎ ২০১৪ সালের জুন মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ১০৯.১০ ডলার। সেই সময়ে দেশে খুচরো পেট্রোলের দাম ছিল লিটার পিছু ৭১.৫১ টাকা, এবং ডিজেল ৫৭.২৮ টাকা (দ্য উইক ডট ইন, ২৪ জুন ‘২০)। এখন, অর্থাৎ ২০ মে ‘২১, আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৬৫.০৫ ডলার (আনন্দবাজার, ২৩ মে, ‘২১)। এখন দেশে খুচরো তেলের দাম কত? পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে পেট্রোল ১০১.৫৭ টাকা এবং ডিজেল ৯৩.৬৪ টাকা লিটার প্রতি (বর্তমান, ৮ জুন,’২১)।

তা হলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে, নাকি এখন বিপুল পরিমাণ কমেছে? তা সত্ত্বেও আমাদের দেশে খুচরো তেলের দাম বাড়ছে কেন? এ প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তরটিকে চাপা দেওয়ার জন্য সরকারকে জলজ্যান্ত মিথ্যার আশ্রয় নিতে হচ্ছে। জেনেশুনে এই কর্মটি করছে কেন সরকার? ভেতরের গূঢ় রহস্য হল, প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা কর্পোরেট তেল কোম্পানিগুলি এবং তার সাথে সরকার গোপন বোঝাপড়া করে লুঠ করে চলেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ওএনজিসি ২০২০ সালের প্রথম কোয়ার্টারে নিট মুনাফা করেছে ৭ হাজার ৪৩ কোটি টাকা, অর্থাৎ গত বছরই মুনাফা তুলেছে অন্ততপক্ষে ২৮,১৭২ কোটি টাকা। একই ভাবে ‘২০-‘২১-এ আইওসি মুনাফা করেছে ২১,৭৬২ কোটি টাকা (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ডট কম ২০ মে, ‘২১)। রিলায়েন্সের গত এক বছরে নেট মুনাফা বেড়েছে ১০৮ শতাংশ (পিটিআই,৩০ এপ্রিল, ‘২১)। আদানির বেড়েছে ২৬.২৫ শতাংশ (ঐ,৬ মে, ‘২১)। কত বড় মিথ্যাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে তা বোঝা যাবে গতবছর যখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম শূন্যে নেমে আসে সেই সময় কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রোল-ডিজেলের দাম একটি পয়সাও কমায়নি। স্ট্র্যাটেজিক অয়েল রিজার্ভের নামে ভারত সরকার যে সেই সময় কয়েক কোটি ব্যারেল অশোধিত তেল বিভিন্ন রাজ্যের রিজার্ভারগুলিতে জমিয়ে রেখেছে, সেগুলি এখনও এই বিপুল কর সহ এমন বিপুল দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এর পরেও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার তত্ত্ব দাঁড়ায় কি? এ তো রীতিমতো দেশের নিরন্ন বুভুক্ষু কোটি কোটি মানুষকে আরও শুষে নেওয়া, লুটে নেওয়া। যে সরকার জনগণের ওপর এমন নির্মম লুণ্ঠন চালিয়ে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের পুঁজি বছরে দ্বিগুণ করার ব্যবস্থা করে দেয়, সেটা যে জনগণের সরকার নয়, এর পরেও কি তা বুঝতে অসুবিধা থাকে!

কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী বলেছেন, ৮০ শতাংশ তেল বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। কেন হচ্ছে? দেশের তৈলখনিগুলোকে ব্যবহার না করে এই আমদানি নীতি চলে আসছে সেই ৭০ এর দশকে ইন্দিরা গান্ধীর আমল থেকেই এইভাবে সরকারি ওএনজিসি-কে কার্যত অকেজো করে দিয়ে। বিদেশের বাজারের উপর নির্ভরশীল না হলে দেশীয় উৎপাদন ব্যয় কম হত এবং সাধারণ মানুষ সুরাহা পেতেন। এখনও যতটুকু তেল দেশে উৎপন্ন হয়, মূল্যমানের সমতার কথা বলে কেন তা আন্তর্জাতিক বাজারের সমান দামে বিক্রি করা হচ্ছে? অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে শোষণ করে যেভাবে পারো মুনাফা লুটে নাও।

সংবাদে আরও প্রকাশ, এ বছরই ১২ জুন পর্যন্ত ৪৮ বার তেলের দাম বেড়েছে। কমেছে মাত্র চার বার। গত সাত বছরে নরেন্দ্র মোদির আমলে দেশে পেট্রোলে প্রায় ৮০০ শতাংশ এবং ডিজেলে প্রায় ২৫০ শতাংশ কেন্দ্রীয় শুল্ক বেড়েছে। তথ্য বলছে, কেন্দ্র ও রাজ্য মিলে এখন দেশে তেলের উপর ট্যাক্স আদায় করছে ৬৩ শতাংশ (দ্য হিন্দু ডট কম, ৩১ মে, ‘২১)। একদিকে এই চড়া ট্যাক্স, অন্যদিকে তেল কোম্পানিগুলির বিপুল মুনাফাই এ ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণ। কী বিপুল পরিমাণ অর্থ জনসাধারণের কাছ থেকে কৌশল করে এবং সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে তুলে নেওয়া হচ্ছে তা কল্পনার অতীত।

সর্বদাই সরকার বলে থাকে জ্বালানি তেল এবং রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি দিতে দিতে তারা ফতুর হয়ে যাচ্ছে। তাই ভর্তুকি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করতে হবে। এই কি সেই ফতুর হওয়ার নিদর্শন? কোথায় ভর্তুকি? উল্টে তো সরকার ও তেল কোম্পানিগুলি তেল ব্যবসায় আয় করছে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা! স্ট্র্যাটিজিক অয়েল রিজার্ভ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলিকে বেসরকারি মালিকদের কাছে বেচে দিচ্ছে। তেল ব্যবসায় ১০০ শতাংশ বিদেশি লগ্নির ছাড়পত্র দিয়ে দিচ্ছে। ফলে বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলিকে বিপুল লুটের খোলাখুলি সুযোগ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আম্বানি-আদানিরা বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহদের মাথায় কেন ক্ষমতার মুকুট পরিয়ে দিয়েছে, তা বুঝতে আর অসুবিধা হয় কি?

দেশের কল্যাণ, স্বচ্ছ ভারত, সব কা সাথ সব কা বিকাশ ইত্যাদি বহুশ্রুত মিষ্টি ভাষণের আড়ালে দেশের মানুষকে নিয়ে এ এক মহা মারণ-যজ্ঞ চলছে। বিপুল পরিমাণ তেলের মূল্যবৃদ্ধি সকল জিনিসপত্রের মূল্যমানে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। সাধারণ দেশবাসীর নাগালের ধরাছোঁয়ার বাইরে বাস্তবে। আবার এর প্রভাব পড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে। যার ফলে বিদ্যুতের মাশুল বাড়ছে, এবং বিদ্যুতের সাহায্যে উৎপাদন ও পরিবহন ক্ষেত্রেও ব্যয় বাড়াচ্ছে। তার নিটফল আবার ঘুরপথে এসে ওই জনসাধারণের ঘাড় থেকেই তা আদায় করা হচ্ছে।

এদিকে বাস মালিকরা উসখুস করছে এবং প্রায়শই সরকারের উপর চাপ দিচ্ছে ভাড়া বাড়াতে হবে। অর্থাৎ না বাড়ালে পরিবহণ ব্যবস্থা অচল করে দেবো । ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিকে অজুহাত করে বাস ও ট্যাক্সির ভাড়া আরও অনেকগুণ বাড়ানোর যৌক্তিকতা সরকার হাওয়ায় ভাসিয়ে রেখে ইতিমধ্যেই মালিকপক্ষকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে ফেলেছে। কেবল লকডাউন আলগা হওয়ারই অপেক্ষা। বাস মালিকরা হইচই বাধিয়ে, ধর্মঘট করে, তুলকালাম করে তুলবে, সাধারণ মানুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে হয়রান করবে, যাতে ত্রাহি ত্রাহি রবে সরকার কিছু একটা ভূমিকা নিতে বাধ্য হচ্ছে এই ভাব দেখিয়ে ভাড়া বৃদ্ধির পরিমণ্ডলটি সৃষ্টি করা যায়। এবং সেই কারণে সংবাদে প্রকাশ, ‘পরিবহণ মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, মালিকদের দাবি নিয়ে তিনি কমিটি করে তিন মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত করবেন’ (সংবাদ প্রতিদিন, ৮ জুন, ‘২১)। অর্থাৎ আরেকটি আক্রমণের খড়গ নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে সরকার।

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা