সরকারি নীতি ও দায়বদ্ধতার অভাবেই মেট্রো রেল আজ পাতাল আতঙ্ক

  কলকাতা মেট্রো রেলে যাত্রী পরিষেবার মান যে কত তলানিতে পৌঁছেছে, সম্প্রতি দরজায় হাত আটকে সজল কাঞ্জিলালের মর্মান্তিক মৃত্যু তা আবারও সামনে এনে দিল৷ ১৩ জুলাই দরজায় হাত আটকে মারা যান সজলবাবু৷ তখনই প্রশ্ন উঠেছে কেন দরজার সেন্সর কাজ করলো না? কোনও হেল্পলাইন ফোন নাম্বার কাজ করলো না কেন? ট্রেনের রেকগুলির যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা অবহেলিত কেন? সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে যে ওই ব্যক্তি বাইরে ঝুলছেন অথচ তা মেট্রোর কোনও কর্মচারীর নজরে এল না কেন? তাহলে নজরদারি কোথায়?

প্রতিদিন গড়ে সাত লাখ যাত্রী যাতায়াত করেন কলকাতা মেট্রোয়৷ প্রায়শঃই তারা কোনও না কোনও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন৷ কখনও মাঝপথে খারাপ হয়ে যাচ্ছে রেক৷ কখনও আলো, পাখা, এসি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ কখনও ট্রেনের জল উঠে আসছে লাইনে, ধরা পড়ছে ফাটল, গেট খোলা রেখেই চলতে শুরু করছে ট্রেন৷ কখনো ‘বার্নিং ট্রেনের’ মতো আগুন লাগা কামরা নিয়ে সুড়ঙ্গ পথে দৌড়াচ্ছে মেট্রো৷ ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে কামরা, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে কামরার ভেতর থেকে যাত্রীরা ঝাঁপ দিচ্ছেন বাইরে৷ আর অফিস টাইমে লাগাতার ট্রেন বাতিল এবং সময়ে ট্রেন না চলার অভিযোগ তো রয়েইছে৷ এই সমস্ত সমস্যা নিয়ে মেট্রো কর্তৃপক্ষ এবং কেন্দ্রীয় সরকার কার্যত উদাসীন৷ কোনও ঘটনা ঘটলে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করে বড়জোর কিছু কর্মীকে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অথবা বিবৃতি দিয়ে দায় সারছেন তাঁরা৷ গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বুঝিয়ে দিচ্ছে কলকাতা মেট্রোয় কখন কী ঘটবে, কার জীবনে বিপদ নেমে আসবে কেউ জানে না তাই কলকাতার মেট্রো রেল আজ পাতাল আতঙ্কে পরিণত হয়েছে৷ কিন্তু কেন এমন হল?

রেক সমস্যা

নোয়াপাড়া থেকে কবি সুভাষ পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ২৮ কিলোমিটার৷ কলকাতা মেট্রোতে এখন ১৬টি এসি আর ১৪টি নন এসি রেক আছে৷ এরমধ্যে বেশ কয়েকটি সেই জন্মলগ্ন থেকে যাত্রী পরিবহন করে করে ক্লান্ত৷ রেক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার থেকে জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করে এলেও প্রায়শই তারা বিকল হয়৷ এসি রেক নিয়ে রয়েছে নানা সমস্যা৷ সেগুলি খারাপ হলে চটজলদি ঠিক করার মতো মেকানিক পাওয়া যায় না৷ তাই প্রতিদিন গড়ে ২০–২২টি রেক পাওয়া যায়৷ লক্ষ লক্ষ যাত্রীর চাপ সামাল দেওয়ার জন্য যেখানে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো দরকার সেখানে এখন দৈনিক ৩০০টির জায়গায় ২৮৪টি ট্রেন চালানো হচ্ছে৷

যে রেকে সজলবাবুর প্রাণহানির ঘটনাটি ঘটে তা নাকি চেন্নাইয়ের অত্যাধুনিক কারখানা ইন্ট্রিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরি থেকে আনা৷ ‘মেধা প্রযুক্তি’ যুক্ত এইরকম তিনটি রেক আসে ২০১৭ জুলাইয়ে৷ গত দু’বছর ধরে ট্রায়াল রানে ডাহা ফেল করা এই রেকগুলিতে ধরা পড়ে নানা ত্রুটি৷ স্বয়ংক্রিয় দরজা কাজ না করা, থার্ড রেলের সঙ্গে ঠিকমতো সংযোগ স্থাপন না হওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটা, বাঁকের জায়গায় দাঁডিয়ে যাওয়া সহ একাধিক ত্রুটি৷ তা সত্ত্বেও এই ত্রুটিপূর্ণ রেকগুলি দিয়েই প্রতিদিন মানুষের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মেট্রো চালানো হচ্ছে কেন? তাহলে কি যাত্রীদের প্রাণের কোনও মূল্য কর্তৃপক্ষের কাছে নেই? প্রতিদিন মেট্রো রেকগুলিকে চালানোর আগে পরীক্ষা করে ফিট সার্টিফিকেট দেওয়া হয়৷ প্রশ্ন উঠছে ওই দিন ত্রুটিপূর্ণ ওই রেকটি ফিট সার্টিফিকেট পেল কী করে?

প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি বদল অবহেলিত

যাত্রীর চাপ সামলে নিরাপদ পরিষেবার জন্য প্রয়োজন আধুনিক রেক, সিগন্যাল ব্যবস্থা সহ অন্যান্য পরিকাঠামোর দ্রুত বদল, না হলে ভবিষ্যতে বরাহনগর, দক্ষিণেশ্বর, বিমানবন্দর রুটে মেট্রো চালু হলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে৷ অথচ কলকাতা মেট্রোকে আই সি এফ এর তৈরি ত্রুটিপূর্ণ রেক ব্যবহার করতে বাধ্য করা হচ্ছে৷ কলকাতা মেট্রোয় এই সংস্থা থেকে যে রেকগুলি এসেছে তার মধ্যে দুটি মেরামতের জন্য ফেরত পাঠানো হয়েছে আর একটিতে গত ১৩ জুলাইয়ের দুর্ঘটনা ঘটে৷ যেখানে উন্নত মানের ডি এম ইউ ট্রেন শ্রীলঙ্কায় রপ্তানি করে সরকার কোটি কোটি টাকা আয় করছে সেখানে কলকাতা মেট্রোয় জনসাধারণের জন্য নিম্নমানের ত্রুটিপূর্ণ রেক কেন? আধুনিক সিগন্যাল প্রযুক্তির যে প্রস্তাব এসেছে তাও আটকে আছে কোন স্বার্থে? বিশেষজ্ঞদের ধারণা, তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নির্ভর ব্যবস্থা চালু হলে একদিকে যেমন ট্রেন সার্ভিসের সময় কমবে, যাত্রীর সংখ্যা বাড়বে তেমনি যাত্রী সুরক্ষা অনেকটা সুনিশ্চিত হবে৷ একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে ২০১৮–র ১ এপ্রিল থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত কলকাতা মেট্রোর আয় বেড়েছে প্রায় ৪.৩২ শতাংশ৷ আয় বৃদ্ধি হলেও পরিষেবার মান কিন্তু বাড়েনি৷

অপর্যাপ্ত কর্মীসংখ্যা

সুষ্ঠু পরিষেবা দেওয়ার জন্য প্রথম প্রয়োজন দক্ষ ও পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মী৷ কিন্তু সেই কর্মী সংখ্যার অভাবে ভুগছে কলকাতা মেট্রো৷ এই মুহূর্তে সুষ্ঠু পরিষেবা দেওয়ার জন্য সব মিলিয়ে মোট ২৫৯ জন ড্রাইভার প্রয়োজন৷ অথচ মেট্রোর হাতে রয়েছে মাত্র ১৯২ জন৷ ঘাটতি ৬৭ জন৷ আরও আশ্চর্যের বিষয় ওই ১৯২ জনের মধ্যে ১০০ জন পূর্ব, দক্ষিণ–পূর্ব রেল থেকে ধার করা৷ অথচ মেট্রো রেল চালানোর পদ্ধতিটাই আলাদা৷ ধার করে নিয়ে আসা ড্রাইভারদের নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে যাত্রীদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে চালানো হচ্ছে মেট্রো রেল৷ দুর্ঘটনার দিন এইরকমই এক ড্রাইভার নাকি ট্রেনটি চালাচ্ছিলেন বলে সংবাদে প্রকাশ৷ শুধু মোটরম্যান নয়, প্রতিটি বিভাগেই বহু পদ শূন্য৷ সিগন্যালিং অ্যান্ড ড্রাফিক বিভাগে প্রায় ৪৬ শতাংশ কর্মী নেই৷ ইলেকড্রিক্যাল বিভাগে ৪৩৫টি পদ শূন্য৷ এইরকম স্টোর, অ্যাকাউন্টস স্মার্ট কার্ড, টিকিট কাউন্টার, টোকেন গেট সহ সব বিভাগেই একই অবস্থা৷ যারা কাজ করছেন তাদের বেশিরভাগ হয় অস্থায়ী না হয় ভাড়া করা৷ শুধু কর্মীরা নন, মেট্রো রেলের কর্তারাও অস্থায়ী৷ তাঁরাও বছর দুয়েক পরপর অন্য জোনে বদলি হয়ে যান৷ বস্তুত এই ভাবেই দিনের পর দিন চলছে কলকাতা মেট্রো৷ যে কোনও দিন আরও বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে৷ কেন মেট্রো রেলের এইসব শূন্য পদে স্থায়ী নিয়োগ হবে না? এতে যেমন বেকার যুবকরা কাজ পাবে তেমনি পরিষেবার মান বাড়বে, কমবে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা৷

বিপর্যস্ত বিপর্যয় মোকাবিলার ব্যবস্থা

বিপর্যয় মোকাবিলায় দলের সদস্যসংখ্যা কত জানেন? মাত্র ৫৷ এতে ট্রাফিক, সিকিউরিটি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল ও মেডিকেল বিভাগের নিচুতলার অফিসাররা আছেন৷ প্রায় ২৮ কিমি যাত্রাপথের কোথাও বিপদ ঘটলে এই মাত্র পাঁচজন কী করবেন? এই ৫ জনের তত্ত্বাবধানে যে সমস্ত বিপর্যয় মোকাবিলার কর্মীরা আছেন, তাঁরাও অপ্রশিক্ষিত ও অদক্ষ৷ বিপর্যয় মোকাবিলায় অগ্নি নিরোধক জ্যাকেট, গ্যাস মুখোশ, অক্সিজেন সিলিন্ডার, আগুন নেভানোর যন্ত্র বেশিরভাগ স্টেশনেই নেই৷ এমনকি বেশিরভাগ ট্রেনের কামরার ভেতরেও আপৎকালীন বোতাম বা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র চোখে পড়ে না বলে অভিযোগ৷ বিপর্যয় যতবার ঘটেছে, হেল্পলাইন নাম্বার কাজ করেনি৷ যে কোনও ধরনের নাশকতা মোকাবিলায় স্টেশনে স্টেশনে পুলিশ ও সুরক্ষা কর্মীরা যেভাবে থাকেন তাতে আর যাই হোক বিপদ এলে তারা যে তার মোকাবিলা করতে পারবেন, এমন ভরসা রাখা যাত্রীদের পক্ষে মুশকিল৷

একদা কলকাতার গর্ব পাতাল রেল আজ পাতাল আতঙ্ক৷ এর জন্য দায়ী কে? একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে আর তদন্তের নাম করে কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র কর্মচারীদের দোষী সাব্যস্ত করে দায় সেরেছে৷ কিন্তু মেট্রো রেলের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী তো সরকারি নীতি আর জনগণের প্রতি তার দায়বদ্ধতার অভাব৷ কর্মচারীদের ত্রুটি বা খামতি হয়তো কিছু আছে কিন্তু তা নগণ্য বরং মাথাভারি প্রশাসন সর্বস্তরের কর্মচারীদের ওপর প্রবল কাজের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে আর সেই কাজ সঠিকভাবে করতে না পারলে ‘ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারির’ নামে শাস্তির খাঁড়া কর্মচারীদের ওপর নামিয়ে আনছে৷ সর্বস্তরে ব্যাপক সংখ্যক কর্মীর ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও যতটুকু পরিষেবা সাধারণ মানুষ পান মেট্রো রেলে, তা কর্মচারীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই৷

জনসাধারণকে বুঝতে হবে মেট্রো রেলও মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই চালানো হয়৷ ফলে এখানে যাত্রী পরিষেবা অবহেলিত হয়৷ পাশাপাশি সরকার মেট্রো পরিষেবাকে ধাপে ধাপে বেসরকারিকরণ করতে চলেছে৷ যা ইতিমধ্যে রেলের অন্যত্র শুরু হয়েছে৷ মেট্রো রেলে আরপিএফ বেসরকারিকরণের কথা ভাবা হচ্ছে৷ এই পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে সুষ্ঠু নিরাপদ নিশ্চিত মেট্রো পরিষেবা পেতে গেলে প্রয়োজন যাত্রী কমিটির পক্ষ থেকে পরিষেবা উন্নয়নের দাবিতে জোরদার আন্দোলন৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১ সংখ্যা)