শিলান্যাস : ভাঁওতাই সার

ভোট ঘোষণার বহু আগে থেকেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছিল শিলান্যাসের ধুম৷ সিএম–পিএম সকলেই ছুটছিলেন৷ কোথাও পাথর পুঁতছেন, কোথাও একটা সভা থেকে অনলাইনে কুড়ি–পঁচিশটা প্রকল্প উদ্বোধন করে দিচ্ছেন৷ দৌড়াদৌড়িতে অনেকের খেয়াল থাকছিল না, যে পাথরটা এক মন্ত্রী আজ পুঁতছেন, সেটা তাঁর আগে আরও কয়েকবার কয়েকজনে পুঁতে গিয়েছিলেন৷ এমনও হচ্ছিল, পুরনো প্রকল্প নতুন নামে আবার চালু করা হচ্ছে৷  ভোটের নির্ঘন্ট ঘোষিত হওয়ায় সে কুনাট্য রঙ্গে পর্দা পড়েছে৷ অন্য দিকে, খবরের কাগজের পাতায় পাতায় প্রায় প্রত্যেক দিনই আসছিল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ‘ব্যাপক সাফল্যের খতিয়ান’৷ তামাম জনগণ তাজ্জব, ‘আরিব্বাস এত কাজ হয়েছে আমরা জানতেই পারলাম না’!

এই পাথরপোঁতা অথবা রেডিও–টিভি–কাগজের মাধ্যমে অবিরত কৃতিত্বের ঢাক পেটানোয় সবার চেয়ে বেশি উদগ্র প্রধানমন্ত্রী মোদিজি৷ এর সাথে আছে বিনিয়োগ আনবার নামে তাঁর বিদেশভ্রমণ৷ শুধু তাঁর বিদেশভ্রমণেই কেন্দ্র সরকারের এখনও পর্যন্ত খরচ হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি৷ আর, বিভিন্ন প্রকল্পের প্রচারে সরকারি কোষাগার থেকে বয়ে গেছে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা৷

তারপর, যখন উন্নয়নের একটা নিরপেক্ষ সমীক্ষা হচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে সকলেরই প্রাপ্য বিশাল গোল্লা, কেবলই গোল্লা৷ না হলে, দূর–দূরান্তের গ্রাম–গঞ্জ তো কোন ছার, রাজধানী দিল্লিতেই অনাহারে মরে মানুষ! রাজ্যে রাজ্যে চাষি মরছে, শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে– এসব কি উন্নয়নের লক্ষণ? ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে বেকার বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ৷

তাহলে, এত শিলান্যাস, এত প্রকল্প, যেগুলো ঢাকঢোল পিটিয়ে, কাড়া–নাকাড়া বাজিয়ে ‘উন্নয়নের কর্মসূচি’ বলে দেখান হয়েছিল, সেগুলো কী? কার্যত, সেগুলো একেকটা রংমশাল, ক্ষণিকের তীব্র আলোয় চোখ ঝলসে দিয়ে যা ছাই হয়ে যায়, আদতে কারও কোনও কাজে লাগে না, নেতা–মন্ত্রীরা হাততালি পায় মাত্র৷

২০১৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আসামের লখিমপুরে বিজেপি মন্ত্রী নীতিন গড়করি দুটো জাতীয় সড়কের শিলান্যাস করেছিলেন৷ তিন বছর কেটে গেলেও আজ পর্যন্ত তার কোনও কাজ হয়নি৷ আবার, ওড়িশায় একই তালচের ফার্টিলাইজার প্ল্যান্টের বারবার বন্ধ এবং উদ্বোধন করা হচ্ছে৷ কয়েক মাস আগেও মোদিজি ফের সেটা উদ্বোধন করে জানিয়েছেন, ‘কাজ শুরু হবে তিন বছর পর’৷ এরকম আরও বহু ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়, সে তালিকা বাড়ানো নিষ্প্রয়োজন৷ মানুষ খোলা চোখেই দেখতে পান কী আদতে হচ্ছে, আর কী শুধু রঙীন প্রচারেই আটকে আছে৷

সরকারি প্রকল্পগুলোও তথৈবচ৷ এর মধ্যে ইদানীং সবচেয়ে বড় ধাপ্পা হিসাবে সামনে এসে গেছে, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা৷ ২০১১ সালের সরকারি তথ্যে দেখানো হয়েছিল, দেশে গৃহহীন মনুষের সংখ্যা ১৮ লক্ষ৷ বাস্তবে সকলেই জানে, সংখ্যাটা দশগুণেরও বেশি এবং বৃদ্ধির হারও অতি দ্রুত৷ কেন না, প্রথমত, সরকার সবসময়ই নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে তথ্যের হেরফের ঘটায়৷ দ্বিতীয়ত, সরকারি সংজ্ঞায়, যার গৃহ নেই, সে–ই গৃহহীন৷ অথচ, বহু লোকের গৃহ একটা থাকলেও, তা এতটাই বসবাস করার অনুপোযুক্ত যে, কোনও ভাবে দু–তিন জনের বেশি সেখানে থাকা যায় না৷ তাই প্রায় সমস্ত শহরেই দেখা যায়, আস্তানা একটা থাকা সত্ত্বেও পরিবারের পুরুষরা শীতে–বর্ষাতেও রাস্তায়–ফুটপাথে রাত কাটায়৷

এসব জানা সত্ত্বেও, যে ভাবেই হোক ভোটে জেতার জন্য সব সরকারিদলই বলছে, তারা রাস্তা করেছে, স্কুল–কলেজ–হাসপাতাল করেছে, বিনিয়োগের পুঁজি এনেছে, চাষির জন্য এই করেছে, শ্রমিকের জন্য এই করেছে, মহিলাদের জন্য, শিশুদের জন্য, প্রবীণদের জন্য এই–এই করেছে৷ আরও কত কী যে তারা করেছে, তার ইয়ত্তা নেই৷ যত তাদের কৃতিত্বের ফিরিস্তি বাড়ছে, তত গোটা দেশে, স্বাভাবিক গুণমানযুক্ত খাদ্য থেকে, প্রাথমিক শিক্ষা থেকে, ন্যূনতম চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত মানুষের সংখ্যাও হু–হু করে বাড়ছে৷ যে বিরোধীরা গদি দখল করতে চাইছে, তারাও যখন ক্ষমতায় ছিল, এই কাজই করেছে৷

রং যা–ই হোক, সরকারগুলোর কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, স্রেফ কসমেটিক সার্জারি৷ অর্থাৎ কিছু রাস্তা সারাই, পার্ক রং, হাসপাতালের গেট তৈরি, বড় লাইটের তলায় একটা ছোট লাইট দেওয়া ইত্যাদি৷ আর জাত–পাত–ধর্ম–বর্ণের নামে যত রকমের নষ্টামি৷ এহেন সরকারি দলগুলোর মূল লক্ষ্যই হয়ে গেছে ক্ষমতায় থেকে একদিকে লোকাল কন্ট্রাক্টার–প্রোমোটার্ ‘পাইয়ে দেওয়া’র ব্যবস্থা করে ভোট নিয়ন্ত্রণের বাহিনী বৃদ্ধি করা, অন্য দিকে, বৃহৎ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের কিছুটা বাজারের সুযোগ করে দেওয়া৷

দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় মানুষ দেখছে, ভোটে যে–ই জিতুক, এমন খবর কখনও শোনা যায় না যে, অমুক জায়গায় একটা কারখানা হয়েছে, কিছু মানুষ কাজ পেয়েছে৷ কিংবা, অমুক জায়গায় একটা সুক্ল হয়েছে, দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়ার সুযোগ পাচ্ছে৷ অথবা, অমুক গ্রামে একটা হাসপাতাল হয়েছে, দরিদ্র রোগীদের আর বিনা চিকৎসায় মরতে হচ্ছে না বা দূর–দূরান্ত থেকে কলকাতার হাসপাতালে ছুটে আসতে হচ্ছে না৷ বরং, দেখা যাচ্ছে, একটা দুটো কারখানা যদি বা হয়, তো দশটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ সরকারি স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, হাসপাতালগুলোর দেওয়াল রং ছাড়া অন্য তেমন কিছু হচ্ছে না, রোগী মাটিতে পড়ে থাকছে৷ এই রূঢ় বাস্তবতা চাপা দিতে রাজ্য এবং কেন্দ্র উভয়েই কিছু দান খয়রাতির পথ ধরেছে৷ কিছু চাল, কিছু নগদ টাকা, কিছু সাইকেল, এমনকী কিছু স্মার্টফোন, ল্যাপটপও মাঝেমধ্যে বিতরণ হচ্ছে নানা কায়দায়, নানা কৌশলে৷ এভাবে ভোট কেনা চলছে৷ আর একে–পরকে টেক্কা দিতে সমস্ত হীনকাজ তারা করতে শুরু করেছে৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা)