শিথিল হচ্ছে শ্রম আইন, মহামারিতে ক্ষতির দায়ভার চাপছে শ্রমিকের ঘাড়ে

১১ মে, বেঙ্গালোরে শ্রম আইন পরিবর্তনের প্রতিবাদে বেঙ্গালোরে লেবার কমিশনের দপ্তরে এআইইউটিইউসি সহ অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়নের ডাকে বিক্ষোভ

করোনা সংক্রমণ জনিত লকডাউন-এর আবহে অর্থনৈতিক মন্দারদোহাই দিয়ে উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের বিজেপি সরকার শিল্পসংস্থাগুলিকে শ্রম আইন মানার ক্ষেত্রে ঢালাও ছাড় দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। অজুহাত হল, এতে লগ্নি বাড়বে, শিল্পমালিক এবং ব্যবসায়ীরা টাকা ঢালতে উৎসাহিত হলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। উত্তরপ্রদেশের মতোই বিজেপি শাসিত গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, ত্রিপুরা, মহারাষ্ট্র সরকারও বিজেপি নির্দেশিত এই পথই অনুসরণ করছে। তারা শ্রমিকদের আট ঘণ্টার বদলে বারো ঘন্টার শ্রম দিবসের কথাঘোষণা করেছে। রাজ্যগুলির সংশোধিত শ্রম আইন অনুযায়ী নূ্যনতম মজুরি এবং দুর্ঘটনা ঘটলে কিছু ক্ষতিপূরণ প্রভৃতি কয়েকটি বিষয় ছাড়া শিল্পসংস্থাগুলির শ্রম আইন মানার কোনও দায় থাকছে না। উত্তরপ্রদেশ সরকার আগামী তিন বছরের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, শ্রমিকদের দাবিদাওয়া পেশ ও মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। নতুন লগ্নিকে উৎসাহিত করার জন্য ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’ নীতির ভিত্তিতে মেয়াদী নিয়োগের কথাও (Fixed Term Employment) বলা হয়েছে। এই শ্রম আইন সংশোধনের ফলেদেশের শ্রমিক শ্রেণির চাকরি ও জীবিকার নিশ্চয়তা, সামাজিক সুরক্ষা ও ভবিষ্যৎ সব শেষ হয়ে যাবে। পুঁজিপতি শ্রেণির অধিকতর মুনাফাকে নিশ্চিত করতে শ্রমিক শ্রেণির বঞ্চনা এবং লাগামহীন অমানবিক শোষণের রাস্তা খুলেদেওয়া হচ্ছে এই শ্রম আইন সংশোধনের মধ্য দিয়ে। ইতিপূর্বেও কেন্দের মোদী সরকার পুঁজিবাদের সেবাদাস হিসেবে তাদের সম্পদ করে ছাড়, কর্পোরেট ট্যাক্সে ছাড়, নানা স্টিমুলাস প্যাকেজ, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ মকুব ইত্যাদি পুঁজিপতি তোষণ নীতি ঘোষণা করেছে।

আজ সারাদেশের মানুষ বিশেষত শ্রমিক-কৃষক সহ সমস্ত স্তরের খেটে খাওয়া মানুষ যে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছেন, তার উপর এই আক্রমণ তাঁদের দুর্দশার শেষ সীমায় ঠেলে দেবে। কিন্তু যে অজুহাতে বিজেপি সরকারগুলি এই সর্বনাশা পদক্ষেপ শ্রমিক জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে, সেই লগ্নি কি আদৌ আসবে? শ্রমিকদের ছিটেফোঁটা কিছু অধিকার বজায় রাখার ভয়েই কি লগ্নি আটকে আছে? ভাল করে তা বিচার করা দরকার। তাহলেই বিজেপি সরকারের জনবিরোধী চরিত্র আরও খোলাখুলি বোঝা যাবে। পুঁজিপতিরা লগ্নি করে কখন? বাজারে মাল বিক্রির সম্ভাবনা দেখলেই তারা একমাত্র লগ্নিতে উৎসাহিত হয়। আজ ভারতের বাজারের সবচেয়ে বড় সমস্যা কী? দেশের অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না থাকাটাই মূল সমস্যা। এ কথা শুধু আমরা বলছি তাই নয়, বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের মান্যগণ্য প্রতিষ্ঠান আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক পর্যন্ত একাধিকবার বলেছে, অভ্যন্তরীণ চাহিদার ঘাটতিই ভারতের বাজার সঙ্কটের প্রধান কারণ। দেশের ৯০ শতাংশ শ্রমিক কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। তাদের কাজের নিশ্চয়তা থেকে বেতন কোনও কিছুরই স্থিরতা বলে কিছু নেই। দেশের অধিকাংশ এই জনগোষ্ঠীকে কার্যত বাজারের বাইরে ধরেই চলে ভারতের ভোগ্যপণ্যের চাহিদার হিসাব। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর বদলে বিজেপি সরকারের নীতি তাদের আরও নিঃস্ব করে দেবে। তাতে সংকট কমা দূরে থাক আরও বাড়বে। এর বিরুদ্ধে এ আই ইউ টি ইউ সি সহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলি তীব্র প্রতিবাদ করেছে এবং লকডাউন পর্বের শেষে দেশব্যাপী তীব্র শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেছে। শুধু শ্রমিক সংগঠনগুলিই নয়, এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন আইনজীবীরাও। তাঁরা বলছেন যে, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশ– এই তিন রাজ্য দেশের শ্রম আইনকে ১০০ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। এটা কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, কেন না এটা মানুষের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।

এই সঙ্কটের কথাকে অস্বীকার করতে পারছে না কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমও। তাই তারা লিখছে, ‘শ্রম আইন শিথিল করে লগ্নি টানার চেষ্টা হয়তো উনিশ শতকের শ্রমিক-শোষণের দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। দেখা দেবে নৈরাজ্য। কিন্তু লগ্নি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি বা কর্মী উন্নয়নের চিঁড়ে ওই জলেভেজা শক্ত’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২-০৫-‘২০)। ভারতে কি সত্যিই শ্রমিকরা এত বেশি পায় যে তাতে মালিকদের লাভ কমে যাচ্ছে? পরিসংখ্যান তা বলে না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও রিপোর্ট দেখাচ্ছে, ভারতে সংগঠিত ক্ষেত্রে পণ্য তৈরির সময় যে মূল্য যোগ করে মানুষের জীবন্ত শ্রম, ১৯৮০-‘৮১ সালে তার ২৮.৫ শতাংশ পেত শ্রমিক, ২০১২-১৩ সালে তা ১১ শতাংশের নিচে নেমে যায়। ২০১৪তে ৯ শতাংশেরও নিচে চলে গেছে শ্রমের ভাগ। উৎপাদিত মূল্যের নিরিখে শ্রমিকের প্রাপ্য ক্রমাগত কমে চলেছে (আইএলও এশিয়া প্যাসিফিক রিসার্চ পেপার সিরিজ ২০১৭ এবং অর্জুন জয়দেব ও অময় নারায়ণের গবেষণাপত্র ২০১৮, আজিম প্রেমজি ইউনিভারসিটি)। অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকের প্রাপ্য আরও নগণ্য। তাহলে বিজেপি সরকার লগ্নি টানার অজুহাতে যে শ্রমিকের উপর আক্রমণ আরও তীব্র করছে তার কারণ কী?

বিজেপি সরকার তার প্রভু একচেটিয়া মালিকদের লাগামহীন শোষণের রাস্তা করে দিতে দেশের আইনে আজও যতটুকু অধিকার শ্রমিকের জন্য টিকে আছে তার তোয়াক্কাও করেনি। করোনা মহামারির কারণে অর্থনৈতিক সংকট তাদের কাছে সব আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানোর হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে। এদেশের বড় বড় একচেটিয়া মালিকরা আজ চাইছে চীনের বাজার থেকে হাতগোটানো কিছু মার্কিন-ইউরোপীয় বহুজাতিকের সাথে হাত মিলিয়ে ভারত সহ এশিয়া-আফ্রিকার বিস্তীর্ণ বাজারে থাবা বসাতে। এ জন্য শ্রমিকদের শ্রমশক্তির চরম শোষণ ছাড়া তাদের সর্বোচ্চ মুনাফা সম্ভব নয়। ফলে শ্রমিকদের পক্ষথেকে ন্যূনতম প্রতিরোধ দূরে থাক তাদের মাথা তোলার ক্ষমতাকে অঙ্কুরেই শেষ করে দিতে চাইছে একচেটিয়া প্রভুরা। একই সাথে দেশের ছোট ছোট পুঁজিকেও পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়ে গোটা বাজারকে একচেটিয়ার গ্রাসের আওতায় আনতে উঠে পড়ে লেগেছে তারা। বিজেপি সরকার এদের সেবাদাস হিসাবে শ্রমিক সহ খেটে-খাওয়া মানুষের ওপর এই আক্রমণ হানছে।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ক্ষমতায় বসার পর থেকেই পুঁজিপতিদের সর্বোচ্চ মুনাফার স্বার্থে দেশের শ্রমিক শ্রেণির দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত অধিকারগুলি এক এক করে কেড়ে নিতে উদ্যত হয়েছে। ৪৪টি শ্রম আইনকে এক করে ৪টি লেবার কোডে পরিণত করেছে। ইতিমধ্যেই মজুরি সংক্রান্ত কোড বিজেপি তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে পাশ করিয়ে নিয়েছে। এর ফলে এতকাল যেভাবে শ্রমিকের পরিবারের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, সন্তান প্রতিপালন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বৃদ্ধ বয়সের জন্য সঞ্চয় ইত্যাদি হিসাব করে মজুরি নির্ধারণ করার ব্যবস্থা কাগজে-কলমে হলেও ছিল, তার বদলে রাজ্য সরকারগুলি নিজেদের ইচ্ছামতো শর্তে মজুরি নির্ধারণ করতে পারবে। ন্যূনতম মজুরি সরকার নির্ধারণ করেছে দৈনিক ১৭৮ টাকা, মাসে ৪৬২৮ টাকা (২৬ দিন ধরে)। এই সামান্য টাকায় পরিবার প্রতিপালন দূরের কথা, একটা মানুষেরই পেটভরে দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়া চলে না। একজন শ্রমিক এবং তাঁর পরিবারের একটু সম্মানজনক ভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম ২১ হাজার টাকা মজুরির দাবি উঠছে। এই মজুরি দেওয়া তো দূরের কথা, কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমিকদের ইএসআই, প্রভিডেন্ট ফান্ডের মতো সামাজিক সুরক্ষাকেও দুর্বল করে দিচ্ছে। শিল্প বিরোধ আইন, শিল্প সম্পর্ক আইন, ট্রেড ইউনিয়ন আইনগুলিকে একত্র করে যে কোড চালু করছে সরকার, তাতে কার্যত ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। মালিকদের হাতে যথেচ্ছ ছাঁটাই, লে-অফ, লকআউটের অধিকার তুলে দিচ্ছে সরকার। একই সাথে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে কাজের সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্ত অধিকারগুলি খর্ব করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের এই শ্রমিক মারা পদক্ষেপের সাথে মিলে যাচ্ছে বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলির শ্রমিক বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি। করোনা মহামারিজনিত অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সুযোগে বিজেপি দেশের শ্রমিক এবং খেটে খাওয়া মানুষের বিরুদ্ধে মারাত্মক আক্রমণ নামিয়ে আনল।

এ আই ইউ টি ইউ সি-র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর দাশগুপ্ত দেশের সমস্ত শ্রমজীবী মানুষকে এর বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে জীবন ও জীবিকা রক্ষার সংগ্রামে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।