শরৎসাহিত্যের গভীরতাকে যখন আমি দ্বিতীয়বার অনুভব করতে পারলাম — বিষ্ণু প্রভাকর

শরৎচন্দ্রকে বলা হয় নারীর ত্রাতা। এ কথাটার তাৎপর্য বুঝতে পারব যদি নিজেকে শরৎ-যুগে নিয়ে গিয়ে পূর্বধারণামুক্ত দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করি। এসইউসিআই-এর প্রতিষ্ঠাতা শিবদাস ঘোষ শরৎ-সাহিত্য শুধু পড়েছিলেন তা-ই নয়, তিনি তার মর্মবস্তু উপলব্ধি করেছিলেন। শুধু ‘সারা বাংলা শরৎ শতবার্ষিকী কমিটি’ নয়, এই দলটি ‘সারা ভারত শরৎ শতবার্ষিকী কমিটি’ও গড়ে তুলেছিল। এরা গোটা দেশে ঘুরে ঘুরে প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে নানা কর্মসূচি পালন করেছে। এই কমিটির সাথে আমি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলাম। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল) সারা বাংলা কমিটির সভাপতি ছিলেন। সারা ভারত কমিটির সভাপতি ছিলেন প্রখ্যাত গুজরাতি কবি উমাশঙ্কর যোশী। এছাড়া, দু’জন সম্পাদক ছিলেন মানিক মুখোপাধ্যায় আর আমি। এই কমিটিতে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট হিন্দি লেখক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে মহাদেবী বর্মার নাম উল্লেখ করতে চাই। তিনি ছিলেন শরৎচন্দ্রের অন্যতম গুণমুগ্ধ। সম্পাদক হিসেবে আমাকে প্রায় সারা ভারতেই ঘুরতে হয়েছে। যেন তখন আমার পায়ে পাখনা গজিয়েছিল, আর তাতে ভর করে আমি বছর দুয়েক সারা দেশে উড়েই যাচ্ছিলাম। ঘোরা মানে তো শুধু ঘোরা না, বত্তৃতাও করতে হত। আমি প্রায় চোদ্দ বছর নিরন্তর গবেষণা করে শরৎচন্দ্রের জীবনী ‘আওয়ারা মসীহা’ লিখেছিলাম। সেটা ১৯৭২ সালে দিল্লির ‘সাপ্তাহিক হিন্দুস্তান’ এবং ১৯৭৩ সালে কালিকট নগরের সাপ্তাহিক ‘জীবন প্রভাত’-এ বেরনো শুরু হয়েছিল। ওই দুটো বছরে আমি যেখানেই যেতাম লোকজন সাদর অভ্যর্থনা জানাত এবং প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতো। আমি অপার বিস্ময়ে ভাবতাম, বাংলার এক ছোট্ট গ্রামের এক অখ্যাত লেখক কী ভাবে সারা দেশকে অভিভূত করে দিয়েছে, আপন করে নিয়েছে, প্রমাণ করে দিয়েছে যে, দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলার শক্তি আছে সাহিত্য-সংস্কৃতিরই। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও শরৎ-জয়ন্তী আয়োজন করেছিল। প্রদর্শনী হয়েছিল, বাংলার বিশিষ্ট লেখক, সমালোচক, ইতিহাসবিদ বক্তব্য রেখেছিলেন। ডক্টর সুকুমার সেন, যিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখেছেন, শরৎচন্দ্রকে উচ্চস্থান দেননি। কিন্তু আমার বত্তৃতার পর উনি খুব সহজভাবে হাসিমুখে বললেন, ‘সত্যিই কি এদেশের মানুষ শরৎচন্দ্রকে এত ভালোবাসে?’ আমি বলেছিলাম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সারা দেশে যে এত আয়োজন অনুষ্ঠান হচ্ছে সেগুলোই তার প্রমাণ নয়?’

কমিটির কাজে নানা জায়গায় গিয়ে শরৎবাবু সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য পেয়েছি। যেমন, ১৯২৫ সাল নাগাদ ওনার কিছু লেখা গুজরাতি ভাষায় প্রথম অনুবাদ করেছিলেন মহাদেব দেশাই, স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে। সেগুলো ছিল বিরাজ বৌ, রামের সুমতি, বিন্দুর ছেলে এবং মেজদিদি। এসইউসিআই-এর সংস্পর্শে না এলে শরৎচন্দ্রকে পুনরায় গভীরভাবে বুঝতে পারতাম না। ওনার আত্মীয়দের সাথেও পরিচিত হতে পেরেছি। ওনার এক ভাইঝির সঙ্গে ভাগলপুরের বাঙালিটোলায় ফের দেখা হল। তাঁর অশেষ শ্রদ্ধায় আমি মুগ্ধ। ওখানে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন বিরাট আয়োজন করেছিল। মনে হচ্ছিল পুরো শহরটা যেন শরৎময় হয়ে উঠেছে।

(উত্তরপ্রদেশের ‘অমর উজালা’ দৈনিকে প্রকাশিত ২২ জানুয়ারি ২০২২)

বিষ্ণু প্রভাকর (১৯১২-২০০৯) হিন্দি ভাষার প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও প্রবন্ধকার। হরিয়ানার সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার সহ বহু পুরস্কারে ভূষিত। তিনি শরৎ জন্মশতবর্ষে সর্বভারতীয় উদযাপন কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। শরৎ-জীবনীকার হিসাবে তিনি বিশেষ প্রসিদ্ধিলাভ করেন। তাঁর লেখা ওই জীবনী গ্রন্থটি ‘ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ’ হিসাবে বাংলায় প্রকাশিত হয়।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ২৪ সংখ্যা ২৮ জানুয়ারি ২০২২