রাষ্ট্র ও বিপ্লব (৯)– ভি আই লেনিন

 

 

এ বছরটি বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ। এই উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তারই অঙ্গ হিসাবে ভি আই লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে। এ বার নবম কিস্তি।

 

সংসদীয় প্রতিষ্ঠান নয় একটি ক্রিয়াশীল সংগঠন চাই

সংসদীয় ব্যবস্থার অবলুপ্তি

মার্ক্স লিখেছিলেন, ‘কমিউনের হওয়ার কথা ছিল একই সঙ্গে আইন প্রণয়নকারী ও সেই আইনকে কার্যকর করার প্রতিষ্ঠান, সংসদীয় প্রতিষ্ঠান নয়।’

‘শাসক শ্রেণির কোন সদস্য তিন বা ছয় বছর অন্তর সংসদে প্রতিনিধিত্ব করবে এবং জনগণের উপর নিপীড়ন চালাবে তা নির্ধারণ করার পরিবর্তে সার্বজনীন ভোটাধিকারের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কমিউন জনগণের স্বার্থে কাজ করত, যেমন ব্যক্তিগত ভোটাধিকার মালিকদের তার ব্যবসার জন্য শ্রমিক, ফোরম্যান ও হিসাবরক্ষক খুঁজে পেতে সাহায্য করে।’

সোসাল শোভিনিজম ও সুবিধাবাদের আধিপত্যের ফলে ১৮৭১ সালে মার্ক্সের করা সংসদীয় ব্যবস্থার এই উল্লেখযোগ্য সমালোচনা এখন মার্ক্সবাদের ‘ভুলে যাওয়া’ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পেশাদার মন্ত্রী ও সাংসদরা, সর্বহারার প্রতি যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং এখনকার দিনের ‘কেজো’ সমাজতন্ত্রীরা সংসদীয় ব্যবস্থার সমস্ত রকম সমালোচনা নৈরাজ্যবাদীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। এবং সংসদীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমস্ত সমালোচনাকেই তারা এই অদ্ভূত যুক্তিতে নৈরাজ্যবাদ বলে প্রত্যাখ্যান করে! এটা অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয় যে, ‘এগিয়ে থাকা’ সংসদীয় ব্যবস্থার দেশগুলির সর্বহারা শ্রেণি শেইডেমান, ডেভিড, লেগিয়েন্স, সেম্বাটস, রেনল্ডস, হেন্ডারসন্স, ভ্যান্ডারভেল্ডস, স্টাউনিংস, ব্র্যান্টিংস, বিসসোলেটিস প্রমুখের মতো ‘সমাজতন্ত্রী’দের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আরও বেশি করে ‘নৈরাজ্যমূলক সিন্ডিকালবাদী’*-দের  (* নৈরাজ্যমূলক সিন্ডিকালবাদী (অ্যানার্কো-সিন্ডিকালিস্ট) মতবাদঃ নৈরাজ্যবাদ ও সিন্ডিকালিস্ট মতবাদের এক খিচুড়ি বিশেষ। এই মতবাদের সমর্থকরা রাজনৈতিক কার্যকলাপের প্রয়োজন স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, ট্রেড ইউনিয়নই হচ্ছে সংগঠনের একমাত্র রূপ, ধর্মঘটই হচ্ছে শ্রমিকদের সংগ্রামের একমাত্র রাস্তা। মার্ক্স-বিরোধী ফরাসি নৈরাজ্যবাদী প্রুধোঁর মতামতের উপর ভিত্তি করে এই মতবাদ গড়ে ওঠে।) প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে পড়ছে। যদিও, এই নৈরাজ্যমূলক সিন্ডিকালবাদীরা আসলে সুবিধাবাদেরই সহোদর।

যাই হোক, প্লেখানভ, কাউটস্কি প্রমুখ যেমন বিপ্লবী দ্বন্দ্বতত্ত্বকে স্রেফ ফ্যাশনদুরস্ত বুলি, খেলনা ঝুমঝুমির ঝংকারে পরিণত করেছিলেন, মার্ক্সের কাছে বিপ্লবী দ্বন্দ্বতত্ত্ব কখনওই তেমন ছিল না। পরিস্থিতি যখন স্পষ্টতই বৈপ্লবিক নয়, সেই সময়েও বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থার ‘আস্তাবল’-কে কাজে লাগাতে অসমর্থ হওয়ায় নৈরাজ্যবাদের সঙ্গে কেমন করে নির্মম ভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়, মার্ক্স তা জানতেন। একইসঙ্গে মার্ক্স এ-ও জানতেন, যথার্থ বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গিতে সংসদীয় ব্যবস্থার সমালোচনা কী ভাবে করতে হয়।

যে সব দেশে সংসদীয়-নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র চালু আছে, শুধু সেইসব দেশেই নয়, অধিকাংশ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রগুলিতেও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রকৃত মর্মবস্তু হল, শাসক শ্রেণির কোন সদস্য সংসদের মাধ্যমে জনগণকে দমন ও পেষণ করবে, কয়েক বছর অন্তর একবার করে তা ঠিক করে নেওয়া।

কিন্তু যদি আমরা রাষ্ট্রের বিষয়টি বিচার করি, সংসদীয় ব্যবস্থাটিকে যদি রাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান বলে গণ্য করি, তা হলে, সর্বহারা শ্রেণির কর্তব্যের দিক থেকে দেখতে গেলে, সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কী হবে? কী ভাবে এই ব্যবস্থাকে পরিহার করা যাবে?

বার বার যে কথাটি আমাদের বলতে হবে তা হল, কমিউনের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে মার্ক্স যে শিক্ষাগুলি রেখে গেছেন, সেগুলি এমন করে সম্পূর্ণ ভাবে ভুলে যাওয়া হয়েছে যে, নৈরাজ্যবাদী বা প্রতিক্রিয়াশীলদের সমালোচনা বলে মনে করা ছাড়া সংসদীয় ব্যবস্থার অন্য কোনও রকম সমালোচনাকে ‘সোসাল ডেমোক্র্যাট’রা (পড়ুন সমাজতন্ত্রের বর্তমান বিশ্বাসঘাতকরা) সত্যিই বুঝতে পারে না।

প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান ও নির্বাচনের নীতির বিলোপ ঘটিয়ে সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না। এ থেকে বেরিয়ে আসার অর্থ হল, প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কাজ নিয়ে বকবক করার জায়গা থেকে একটা ‘ক্রিয়াশীল’ সংগঠনে রূপান্তরিত করা। ‘কোনও সংসদীয় সংস্থা নয়, কমিউনের হওয়ার ছিল একটি কার্যকরী সংগঠন, যা একই সঙ্গে প্রশাসনিক কাজ ও আইন প্রণয়নের কাজ করবে।’

‘সংসদীয় প্রতিষ্ঠান নয়, একটি ক্রিয়াশীল সংগঠন চাই’– এই কথাটি আজকের দিনের সংসদীয় রাজনীতিবিদ ও সংসদীয় ব্যবস্থার ‘পোষা কুকুর’ সোসাল ডেমোক্র্যাটদের মুখে সরাসরি জোরালো চড় কষিয়েছে! আমেরিকা থেকে সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড, নরওয়ে ইত্যাদি যে সব দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তার যে কোনও একটিকে দেখুন, দেখবেন এইসব দেশে ‘রাষ্ট্রে’র আসল কাজকর্ম বিভিন্ন বিভাগ, দফতর ও আমলাদের দিয়ে পর্দার আড়ালেই সম্পন্ন হয়। সংসদে স্রেফ বাজে বকতে দেওয়া হয় ‘সাধারণ মানুষ’কে বোকা বানানোর বিশেষ উদ্দেশ্যেই। এটা এতই সত্য যে, রাশিয়ার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের যথার্থ সংসদীয় ব্যবস্থা এমনকি গড়ে ওঠার আগেই সংসদীয় ব্যবস্থার এই সমস্ত অন্যায় তৎক্ষণাৎ দেখা দিয়েছে। স্কোবেলেভ, সেরেতেলি, চের্নভ, আভস্কেন্তিয়েভদের় মতো পচা, সংকীর্ণমনা নেতারা সংসদীয় ব্যবস্থার জঘন্য আদব-কায়দায় সোভিয়েতগুলিকে পচিয়ে দিতে, সেগুলিকে ফাঁপা কথার দোকানে পরিণত করতে সফল হয়েছেন। সোভিয়েতগুলিতে মহামান্য ‘সমাজতন্ত্রী’ মন্ত্রীরা বুলি কপচিয়ে আর প্রস্তাব পাস করে সরলবিশ্বাসী কৃষকদের ধোঁকা দিচ্ছে। খোদ সরকারের মধ্যে চলছে অবিরাম কোয়াড্রিল নাচ, যাতে একদিকে সমাজতন্ত্রী-বিপ্লবী (সোসালিস্ট রেভোলিউশনারি) ও মেনশেভিকদের পক্ষে যত বেশি করে মোটা টাকার মান্যগণ্য চাকরির ‘পিঠে’-র কাছাকাছি আসা সম্ভব হয় এবং জনসাধারণের মনোযোগ অন্য দিকে আটকে রাখা যায়। এরই ফাঁকে ‘রাষ্ট্রে’র আসল কাজকর্ম বিভিন্ন অফিস ও বিভাগগুলিতে সারা হয়ে যায়!

শাসক দল ‘সোসালিস্ট রেভোলিউশনারি’ পার্টির মুখপত্র ‘দিয়েলো নারোদা’ (‘জনগণের লক্ষ্য’) সম্প্রতি তার প্রধান সম্পাদকীয়তে স্বীকার করেছে– ‘সবাই’ যেখানে রাজনৈতিক ব্যাভিচারে লিপ্ত, সেই রকম ‘ভাল সমাজে’র লোকেরা অতুলনীয় অকপটতায় স্বীকার করেছে যে, এমনকি যে সব মন্ত্রিদপ্তর ‘সমাজতন্ত্রীদের’ (কথাটা মাফ করবেন) হাতে, এমনকি সেখানেও গোটা আমলাতান্ত্রিক যন্ত্রটা মূলত আগের মতোই রয়ে গেছে, আগের মতোই কাজ করছে এবং বৈপ্লবিক কর্মসূচি অবাধে বানচাল করে দিচ্ছে! এমনকি এই স্বীকৃতি না থাকলেও সোসালিস্ট রেভোলিউশনারি ও মেনশেভিকদের সরকারে অংশ নেওয়ার প্রকৃত ইতিহাসই কি এ কথা প্রমাণ করে না? এর মধ্যে একমাত্র লক্ষণীয় বিষয় হল, ক্যাডেটদের সঙ্গে একযোগে মন্ত্রিত্ব করার সময় সর্বশ্রী চের্নোভ, রুসানভ, জেঞ্জিনভরা এবং দিয়েলো নারোদার অন্য সম্পাদকরা এতটাই লজ্জা হারিয়েছেন যে প্রকাশ্যে, যেন একটা তুচ্ছ ব্যাপার– এই ভাব করে, লজ্জায় একটুও লাল না হয়ে এ কথা বলতে তাঁদের সঙ্কোচ নেই যে, ‘ওঁদের’ মন্ত্রিদপ্তরগুলিতে সবকিছুই আগের মতো!! গ্রামের সরলমতি লোকদের ঠকানোর জন্য বিপ্লবী-গণতন্ত্রের বুলি আওড়ান এবং পুঁজিপতিদের ‘খুশি করার জন্য’ আমলাতন্ত্র ও নিয়ম-কানুনের কঠোরতা বজায় রাখা– এই হল ‘সৎ’ কোয়ালিশনের মর্মবস্তু।

বুর্জোয়া সমাজের দুর্নীতিগ্রস্ত ও পচা সংসদীয় ব্যবস্থার জায়গায় কমিউন এমন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে যেখানে মত ও আলোচনার স্বাধীনতা প্রতারণায় পর্যবসিত হয় না। কারণ, সেখানে সংসদের সদস্যদের নিজেদেরই কাজ করতে হয়, নিজেদের তৈরি করা আইন নিজেদেরই প্রয়োগ করতে হয়, বাস্তব জীবনে সেই আইনের ফলাফল নিজেদেরই পরীক্ষা করে দেখতে হয় এবং তাঁদের যাঁরা নির্বাচিত করেছেন, তাঁদের কাছে সরাসরি জবাবদিহি করতে হয়। প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থার অস্তিত্ব থাকে, কিন্তু সেখানে একটি বিশেষ ব্যবস্থা হিসাবে, আইন প্রণেতা ও আইন যাঁরা কার্যকর করবেন, তাঁদের মধ্যে শ্রম বিভাগ হিসাবে, প্রতিনিধিদের বিশেষ সুবিধা ও অধিকারের ব্যবস্থা হিসাবে সংসদীয় ব্যবস্থা থাকে না। প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান ছাড়া আমরা গণতন্ত্রেরর কথা, এমনকি সর্বহারা গণতন্ত্রের কথাও ভাবতে পারি না। কিন্তু সংসদীয় ব্যবস্থা ছাড়া আমরা তা কল্পনা করতে পারি এবং আমাদের অবশ্যই তা করতে হবে যদি বুর্জোয়া সমাজের সমালোচনা আমাদের কাছে ফাঁকা কথা না হয়, যদি বুর্জোয়া শ্রেণির শাসন উচ্ছেদ করার আকাঙক্ষাটা মেনশেভিক ও সোসালিস্ট-রেভোলিউশারিদের মতো, শাইডেমান ও লেগিন্সের মতো, সেম্বাটস ও ভ্যান্ডারভেল্ডসের মতো শ্রমিকদের ভোট পাওয়ার ‘নির্বাচনী’ বুলি না হয়ে আমাদের কাছে প্রকৃত ও আন্তরিক আকাঙক্ষা হয়।

এটা লক্ষ করা খুবই শিক্ষণীয় হবে যে, কমিউন ও সর্বহারা গণতন্তে্রর জন্য যে সব কর্মকর্তা প্রয়োজন, তাদের কাজকর্মের কথা বলার সময়, মার্ক্স তাদের সঙ্গে সাধারণ পুঁজিবাদী সংস্থায় নিয়োগকর্তাদের নিয়োগ করা শ্রমিক, ফোরম্যান ও কেরানিদের তুলনা করেছেন।

একটি ‘নতুন’ সমাজ তিনি গঠন করেছেন বা আবিষ্কার করেছেন, মার্ক্সের মধ্যে এ সংক্রান্ত ভাববিলাসের কোনও চিহ্নমাত্র ছিল না। না, পুরনো সমাজ থেকে নতুন সমাজের জন্ম, পুরনো সমাজ থেকে নতুন সমাজে রূপান্তরের ধরনগুলি তিনি প্রাকৃতিক-ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসাবে পর্যালোচনা করেছিলেন। তিনি সর্বহারা শ্রেণির গণসংগ্রামের বাস্তব অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে তা থেকে ব্যবহারিক শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করেছেন। মহান বিপ্লবী চিন্তাবিদরা যেমন নিপীড়িত শ্রেণিগুলির অসাধারণ সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিতে ভীত হননি, ঠিক তেমনই মার্ক্সও কমিউনের অভিজ্ঞতা থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়েছেন এবং কখনই নিপীড়িত শ্রেণিকে পণ্ডিতি চালে উপদেশ দেননি (যেমন প্লেখানভ বলেছিলেনঃ ‘ওদের অস্ত্র ধারণ করা উচিত হয়নি’ বা সেরেতেলি বলেছিলেনঃ ‘প্রতিটি শ্রেণির নিজের সীমার মধ্যে থাকা উচিত’।

এক ধাক্কায়, সব জায়গায় সম্পূর্ণভাবে আমলাতন্ত্রকে ধ্বংস করার কথা চিন্তা করা যায় না। এমন চিন্তা একটা কল্পনাবিলাস। কিন্তু এখনই পুরনো আমলাতন্ত্রের যন্ত্রটিকে ধ্বংস করা এবং তৎক্ষণাৎ একটি নতুন যন্ত্র, যেটার দ্বারা সমস্ত আমলাতন্ত্রকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করে ফেলা যাবে, তার নির্মাণ শুরু করা– এই চিন্তা কল্পনাবিলাস নয়। এ হল কমিউনের অভিজ্ঞতা। এ হল বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণির প্রত্যক্ষ ও আশু কর্তব্য।

পুঁজিবাদ ‘রাষ্ট্রে’র প্রশাসনিক কাজকর্মকে সহজ করে তুলেছে। এই সরলীকরণের ফলে, সর্বহারা শ্রেণির পক্ষে ‘কর্তাগিরি’কে পাশে সরিয়ে রেখে সমস্ত বিষয়টা সর্বহারার সংগঠনে পর্যবসিত করা সম্ভব হবে (শাসক শ্রেণি হিসাবে), যে সংগঠন গোটা সমাজের হয়ে ‘মজুর, ফোরম্যান ও কেরানি’দের নিয়োগ করবে।

আমরা ভাববিলাসী নই। এখনই সমস্ত প্রশাসন, সমস্ত অধীনতা ছাড়াই আমরা কাজ চালাবো– এমন স্বপ্নবিলাসকে আমরা প্রশ্রয় দিই না। সর্বহারার একনায়কত্বের কর্তব্য সম্পর্কে উপলব্ধির অভাব হল এই ধরনের নৈরাজ্যবাদী কল্পনার ভিত্তি। মার্ক্সবাদের সঙ্গে এর কোনও রকম সম্পর্ক নেই এবং বাস্তবে এই ধারণা, যতদিন না জনসাধারণের পরিবর্তন ঘটে, ততদিন পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব স্থগিত রাখার কথা বলে। না, এখন মানুষ যেমন আছে, যে মানুষ অধীনতা, নিয়ন্ত্রণ এবং ‘ফোরম্যান ও কেরানি’ ছাড়া কাজ চালাতে পারে না, তেমন মানুষকে নিয়েই আমরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব চাই।

কিন্তু আজ্ঞাপালন করতে হবে সমস্ত শোষিত ও মেহনতি মানুষের সশস্ত্র অগ্রগামী বাহিনী অর্থাৎ সর্বহারা শ্রেণির। রাষ্ট্রের আমলাদের ‘কর্তাগিরি’ হঠিয়ে তার বদলে ‘ফোরম্যান ও কেরানি’দের সরল কাজের পদ্ধতি চালু করার সূচনা এখনই, রাতারাতি করা যায় এবং তা করতে হবে। এই কাজ সাধারণ নগরবাসীর সাধ্যের মধ্যেই রয়েছে এবং তারা ‘শ্রমিকের মজুরি’তে খুব ভালো ভাবেই তা করতে পারে।

পুঁজিবাদ ইতিমধ্যেই যা সৃষ্টি করেছে, আমরা মজুররা, নিজেরাই তার সাহায্যে বৃহদায়তন উৎপাদন সংগঠিত করতে পারব। শ্রমিক হিসাবে নিজেদের অভিজ্ঞতার উপর ভরসা রেখে সশস্ত্র শ্রমিকের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সমর্থন নিয়ে আমাদের কায়েম করতে হবে লৌহদৃঢ় শৃঙ্খলা। আমরা রাষ্ট্রীয় আমলাদের ভূমিকাকে কমিয়ে আনব। তাঁরা সামান্য বেতনের ‘ফোরম্যান ও কেরানি’ হিসাবে আমাদের নির্দেশমতো দায়িত্ব পালন করবে (অবশ্যই এদের সঙ্গে থাকবেন নানা রকম, ধরন ও স্তরের যন্ত্রবিদরা)। এদের প্রয়োজন মতো ফিরিয়ে আনা যাবে। এই হল সর্বহারা শ্রেণি হিসাবে ‘আমাদের’ কাজ।

সর্বহারা বিপ্লব সম্পন্ন করার পরে এই কাজ আমরা শুরু করতে পারি এবং অবশ্যই তা করতে হবে। বৃহদায়তন উৎপাদনের ভিত্তিতে এই ধরনের কাজ শুরু করলে সমস্ত আমলাতন্ত্র আপনা থেকে ‘ক্রমশ ক্ষয় পেতে পেতে লোপ পেতে’ শুরু করবে। নিয়ে যাবে ধীরে ধীরে শৃঙ্খলা, উদ্ধৃতি চিহ্ন ছাড়াই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দিকে। এই শৃঙ্খলা মজুরি দাসত্বের সঙ্গে সম্পর্কহীন। এই ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ও হিসাব রাখার কাজটা ক্রমে এমন সহজ হয়ে যাবে যে প্রত্যেকেই পালা করে এই কাজ করতে থাকবে, তারপর তা সবার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে এবং পরিশেষে জনগণের একটি বিশেষ অংশের ‘বিশেষ’ কাজ হিসাবে এর আর কোনও অস্তিত্ব থাকবে না।

গত শতকের সত্তরের দশকে জার্মানির একজন রসিক সোসাল ডেমোক্র্যাট ডাক বিভাগের কাজকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির নমুনা হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। কথাটি খুবই সত্য। বর্তমানে ডাক বিভাগের কাজ হল ব্যবসা। এই ব্যবসাকে সংগঠিত করা হয় রাষ্ট্রীয়-পুঁজিবাদী একচেটিয়া পদ্ধতিতে। সাম্রাজ্যবাদ সমস্ত ট্রাস্টকে ক্রমান্বয়ে একই ধরনের সংগঠনে রূপান্তরিত করছে যেখানে একই ধরনের বুর্জোয়া আমলাতন্ত্র কাজের চাপে পিষ্ট ও অনাহারক্লিষ্ট ‘সাধারণ’ শ্রমজীবী মানুষের ঘাড়ের উপর চেপে বসে আছে। কিন্তু সামাজিক কাজ পরিচালনার পদ্ধতি ইতিমধ্যেই আমাদের আয়ত্তে এসে গেছে। শুধু আমাদের পুঁজিপতিদের উৎখাত করতে হবে, সশস্ত্র শ্রমিকদের দ্বারা লৌহদৃঢ় হস্তে এই শোষকদের প্রতিরোধ চূর্ণ করতে হবে, আধুনিক রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক যন্ত্রকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে– তাহলেই আমরা পেয়ে যাব ‘পরগাছা’মুক্ত সুসজ্জিত দক্ষ একটি ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থাটি ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকরা নিজেরাই খুব ভালো ভাবে চালাতে পারবে। তারা প্রযুক্তিবিদ, ফোরম্যান ও কেরানিদের নিয়োগ করবে এবং তাদের ‘সকলকে’, বস্তুত সাধারণভাবে ‘সমস্ত’ ‘রাষ্ট্রীয়’ কর্মচারীদের সাধারণ শ্রমিকের সমান মজুরি দেবে। এই হল সমস্ত ট্রাস্টের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট, বাস্তব কর্তব্য যা এখনই পালন করা সম্ভব, যা শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ থেকে মুক্ত করবে এবং (বিশেষ করে রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে) কমিউন ইতিমধ্যেই যা করতে শুরু করেছিল তা বিবেচনায় রেখে কাজ করবে।

আমাদের আশু লক্ষ্য হল সশস্ত্র সর্বহারার নিয়ন্ত্রণে ও নেতৃত্বে সমগ্র জাতীয় অর্থনীতিকে এমনভাবে ডাক বিভাগের মতো করে সংগঠিত করা যাতে প্রযুক্তিবিদ, ফোরম্যান, কেরানি সহ সমস্ত কর্মচারীরা ‘শ্রমিকের মজুরি’র চেয়ে বেশি বেতন না পায়। এই রকম অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এমন একটি রাষ্ট্রই আমাদের প্রয়োজন। এমন রাষ্ট্রই প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থাকে রক্ষা করে সংসদীয় ব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটাবে। এতেই বুর্জোয়াদের হাতে এইসব প্রতিষ্ঠানের যে বিকৃতি ঘটে, তা থেকে শ্রমিক শ্রেণি মুক্ত হবে। (চলবে)