রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণি কোনও পক্ষই অবলম্বন করতে পারে না

২৪ এপ্রিল সমাবেশে গৃহীত যুদ্ধবিরোধী প্রস্তাব

আজকের এই সভা লক্ষ করছে যে, ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ান ফেডারেশন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে একতরফা যুদ্ধ ঘোষণা করে সরাসরি সামরিক আক্রমণ চালায়। ইউক্রেনের মাটিতে এ যুদ্ধ হলেও যুদ্ধের মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি মার্কিন-ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ ও রুশ সাম্রাজ্যবাদ। পূর্ব ইউরোপ সহ ইউক্রেনে নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধ জোট ন্যাটোর সাহায্যে দীর্ঘদিন ধরেই প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। অন্য দিকে পুঁজিবাদী রাশিয়া ইউক্রেন সহ পূর্ব ইউরোপকে তার নিজস্ব প্রভাবাধীন অঞ্চল বলে মনে করে। এ নিয়েই আদতে সংঘাত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে রাশিয়ার। বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির মহান শিক্ষক কমরেড লেনিন দেখান, পুঁজিবাদ বিকশিত হতে হতে সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উপনীত হয়েছে। কোনও একটি বিশেষ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কথা তিনি বলেননি, পুঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়াটিকে তিনি দেখিয়েছেন, যার সর্বোচ্চ পরিণতি হল সাম্রাজ্যবাদ।

বিশ্ব-ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর সাম্রাজ্যবাদী নয়া ঔপনিবেশিক শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবেই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির নিজস্ব প্রভাবাধীন অঞ্চল সৃষ্টির প্রক্রিয়া দেখা দেয়। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদের একটি রূপ হল প্রভাবাধীন অঞ্চল তৈরি। সোভিয়েট ইউনিয়নের অবলুপ্তির পর সোভিয়েট ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রগুলি যেমন স্বাধীনতা ঘোষণা করে, আবার তার আগেই পূর্ব ইউরোপের পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাশিয়ায় পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে তা সংহত হয় এবং রাশিয়ার একচেটিয়া পুঁজিবাদ যথেষ্ট শক্তি অর্জন করে। সোভিয়েট সমাজতন্ত্রের আমলে শিল্পের শক্ত ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল রাশিয়ায়। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন প্রতিরোধকল্পে রাশিয়ার সামরিক শক্তিও সমাজতান্ত্রিক শাসনেই যথেষ্ট সংহতি লাভ করেছিল। বাইরের সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়া রাশিয়ার এই সামরিক শক্তিকে যথেষ্ট সমীহ করতে বাধ্য হয়। বিশ্ব-পুঁজিবাদী শিবিরে পুঁজিবাদী রাশিয়া ক্রমেই একটি বৃহৎ শক্তি হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দেখা দেয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নেতৃত্বে পরিচালিত সাম্রাজবাদী গোষ্ঠীর সামনে রাশিয়ার শক্তিকে খর্ব করার পরিকল্পনা চ্যালেঞ্জ হিসাবে আসে। এই লক্ষ্য থেকেই মার্কিন-ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ রাশিয়ার সীমানায় অবস্থিত রাষ্ট্রগুলিকে নিজস্ব প্রভাবাধীন জোটে অন্তর্ভুক্ত করবার তাগিদে তাদের ন্যাটোর সদস্য করতে শুরু করে। রুশ সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। রাশিয়াও পাল্টা হুমকি দেয় যে, তার সীমানায় ন্যাটোর অনুপ্রবেশ সে বরদাস্ত করবে না। এই দ্বন্দ্বে ইউক্রেন গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। স্বাধীন ইউক্রেনও একটি শক্তিশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসাবে মাথা তোলে এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সখ্যতা বাড়াতে থাকে। ইউক্রেনকে রাশিয়া তার প্রভাবাধীন অঞ্চল বলে মনে করে। মার্কিন-ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের হস্তক্ষেপ রাশিয়া মানতে রাজি হয় না। এরই পরিণতিতে রাশিয়া ইউক্রেনের মাধ্যমে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে শিক্ষা দিতে সরাসরি ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। ফলে এ যুদ্ধ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিচারে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ছাড়া কিছু নয়। যেখানে প্রাণ যাচ্ছে রাশিয়া এবং ইউক্রেন দুই দেশেরই শ্রমজীবী জনতার।

ফলে বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণি তথা ভারতের শ্রমিক শ্রেণি এই যুদ্ধে কোনও পক্ষই অবলম্বন করতে পারে না। তাই আমরা ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণির দল হিসাবে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে তীব্র নিন্দা করেছি, একই সাথে ন্যাটোর যুদ্ধচক্রান্তের বিরুদ্ধেও প্রবল ভাবে সোচ্চার হতে বিশ্বের শান্তিকামী জনগণকে আহ্বান জানিয়েছি। আজ এসইউসিআই (সি) দলের প্রতিষ্ঠা দিবসের এই মঞ্চ থেকেও আমরা জনগণের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য। আজকের গুরুতর পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলনকে তীব্র করার জন্য জনগণের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৯ এপ্রিল ২০২২