মূল্যবৃদ্ধির আগুনে পুড়ছে সাধারণ মানুষ

শিয়ালদহ-বেলেঘাটা রুটে অটোতে যেতে যেতে শুনলাম এক জন আর এক জনকে বলছেন, আগুন লেগেছে আগুন। তীব্র গরমের তাত, না আশেপাশে কোথাও আগুন লেগেছে? কান পাততে শুনলাম মূল্যবৃদ্ধির আগুনের কথা বলছেন এক ছোট ব্যবসায়ী ও তাঁর সঙ্গী। বৈঠকখানার পাইকারি বাজারে রসুন-পেঁয়াজ-আদা কিনে তিনি পাড়ায় বিক্রি করেন। তা কিনতে গিয়ে পকেট ফাঁকা। পাশের আসনে বসা যাত্রী বললেন, কী খাব বলুন তো! বাজারে গিয়ে চরকিপাক খেলেও একটা সব্জি কিনতে পারছি না। চালের দাম বেড়েই চলেছে। বেড়েছে সব রকম ডালের দাম।

বাস্তবে গরিবের শুধু ডাল-ভাতও জোটা মুশকিল এই আগুন-মূল্যে। বাজারে গেলেই যেন আগুনের ছেঁকা লাগছে। গরমকালের সব্জির পটল-ঢেঁড়সের দাম আকাশছোঁয়া। বেশিরভাগ সব্জির দাম ৬০-৭০ টাকা। তার নিচে সব্জি প্রায় নেই বললেই চলে। মাছ-ডিমেরও দাম চড়া। সন্তানদের পাতে কী দেব– এই ভেবেই বহু পরিবারে বাবা-মায়ের ঘুম উড়ে যাচ্ছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতেও সরকার ও প্রশাসন অদ্ভূত ভাবে নীরব। তাঁরা একেবারে গুরুত্বহীন নানা ঘটনায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেন সংবাদমাধ্যমের সামনে, রাজ্যবাসীর উদ্দেশে উপদেশমূলক বাণী বিতরণ করেন, অথচ এরকম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাঁরা সব নিখোঁজ। মূল্যবৃদ্ধি চড়া হলে প্রতি বছর সরকার ‘টাস্ক ফোর্স’ নামক যে কুমিরছানা বের করে মানুষের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করে, তার হদিশও পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। যদিও সেই টাস্ক ফোর্স কী ‘টাস্ক’ করে তা নিয়ে ভুক্তভোগীরা যথেষ্ট সন্দিহান।

কেন্দ্রীয় সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা আইন রয়েছে। রয়েছে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা। কিছুদিন আগেও গণবন্টন ব্যবস্থায় চাল-গম ছাড়াও চিনি-ডাল সহ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিছুটা কম দামে রেশন দোকান থেকে মানুষ পেত। এখন শুধু চাল, তাও প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। গম সরবরাহ বন্ধ। কারণ হিসাবে গমের উৎপাদন কম দেখানো হচ্ছে, অথচ ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ভারতে গম উৎপাদন হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার (১১২ মিলিয়ন টন) থেকে বেশি। তাহলে এই বিশাল পরিমাণ গম যাচ্ছে কোথায়? আসলে ইউক্রেন নানা দেশে গম রপ্তানি করত। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সেই বাজার দখলে নেমে পড়েছে ভারতের খাদ্যপণ্যের একচেটিয়া ব্যবসায়ীরা। তারা রেকর্ড পরিমাণ গম বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মিশর, তুরস্ক সহ নানা দেশে রপ্তানি করছে। ফলে সাধারণ মানুষের জন্য গম নেই। চালও যে কোনও সময় বন্ধ করে দিতে পারে সরকার, রেশনে দিনের পর দিন চালের পরিমাণ কমায় এই আশঙ্কা করছেন গ্রাহকরা। অথচ চাল উৎপাদনে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয়, চিনের পরে (মার্চ, ২০২৩)। চাল-গম-ডাল-দানাশস্য উৎপাদনে ভারত শীর্ষ দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। ভারতের মতো দেশ যেখানে চাহিদার থেকে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেশি, সেখানে সাধারণ মানুষের হাতে এগুলি পৌঁছচ্ছে না কেন? কারণ সরকারের জনগণের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ববোধের অভাব এবং একচেটিয়া পুঁজিপতিদের প্রতি দায়বদ্ধতা।

খাদ্যদ্রব্যের ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধির কারণ কী? নেতা-মন্ত্রীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খাদ্যশস্য এবং সব্জির দাম বাড়ার জন্য আবহাওয়াকে দোষারোপ করে দায়মুক্ত হন! আবহাওয়া সাময়িক মূল্যবৃদ্ধির কারণ হতে পারে, কিন্তু লাগাতার চড়া দামের কারণ কী? আসলে এখন খাদ্যদ্রব্যের বাজারটি পুরোপুরি বৃহৎ পুঁজিপতিদের কব্জায়। সরকার তথা রাষ্ট্রের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। উল্টে কর্পোরেট কোম্পানিগুলির লুটের জন্য খাদ্যপণ্যের বাজারকে তুলে দিয়েছে সরকার। আদানি থেকে শুরু করে নানা বহুজাতিক কোম্পানি দখল করে রেখেছে এই বাজার। বিগত কৃষি আন্দোলনের সময়েই ধরা পড়েছিল, কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি জনবিরোধী কৃষি আইন আনছে এ কথা যেন আগে থেকে জেনেই আদানি, আইটিসি-র মতো গোষ্ঠীগুলি বড় বড় অত্যাধুনিক গুদাম, হিমঘর নানা রাজ্যে বানিয়ে ফেলেছে। যাতে কৃষি ফসলের বেশিটাই তারা মজুত করতে পারে। আন্দোলনের চাপে কৃষি আইন বাতিল হলেও নানা পথে তাদের হাতেই ফসলের অধিকাংশটা যাতে যায় তার তদারকি করছে কেন্দ্র এবং নানা রাজ্যের সরকার। প্যাকেটজাত ব্র্যান্ডেড খাদ্যদ্রব্য চড়া দাম দিলে অনায়াসেই পাওয়া যাচ্ছে। শপিং মলে এগুলির বিক্রি চলছে রমরমিয়ে। এভাবে জিনিসপত্রের লাগামছাড়া দামবৃদ্ধি করে মুনাফা লুটছে তারা। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনের কথা না ভেবে খাদ্যদ্রব্য বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল মুনাফা করছে বেসরকারি কোম্পানিগুলি এবং সরকার তার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছে।

সরকার ইতিমধ্যেই খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের ৭৯২টি বেসরকারি প্রকল্পকে অনুমোদন দিয়েছে এবং তাদের ৫ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা দিয়ে উৎসাহিত করেছে (২০২১-এর জুলাইয়েসংসদে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দপ্তরের মন্ত্রী প্রহলাদ সিং প্যাটেলের বয়ান)। বহুজাতিক কোম্পানিগুলির মুনাফার দিকে লক্ষ্য রেখে চুক্তি-চাষকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রির ক্ষেত্রেও মুনাফাখোর কালোবাজারি-ফড়ে-মজুতদারদের রমরমা। এরা এখন একচেটিয়া পুঁজিপতিদের এজেন্ট হিসাবে কাজ করছে। চাষির বিক্রি করা ফসলের বেশিরভাগটা কিনে নেয় এরা, তারপর মজুত দ্রব্য অফ-সিজনে কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করে। সমস্ত সঞ্চয় খরচ করে বা চড়া সুদে ঋণ নিয়ে চাষ করেও কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পায় না, তাদের অভাবি বিক্রিতে বাধ্য করা হয়। ঋণ শোধ করতে না পেরে কৃষক আত্মহত্যা করে। অতি-উৎপাদন বা স্বল্প-উৎপাদন দুটোরই সুযোগ নেয় এই চক্র। ক্ষমতাশালী দলগুলি এদের মদত দেয়। চাষি আত্মহত্যার পথে যেতে বাধ্য হয়, অন্য দিকে চড়া দামে খাদ্যদ্রব্য কিনতে বাধ্য হয় সাধারণ মানুষ। বছরের পর বছর মূল্যবৃদ্ধির সাথে পাঞ্জা কষতে হয়, খাবারে কাটছাঁট করতে হয় তাদের। এভাবেই বহুজাতিক পুঁজিপতি-মজুতদার-শাসক দলের অশুভ চক্র মূল্যবৃদ্ধিকে অনিবার্য করে তুলেছে।

সরকার যদি মানুষের প্রতি এতটুকু দায়বদ্ধতা অনুভব করত তা হলে খাদ্য সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবসা ক্রমাগত একচেটিয়া মালিকদের হাতে না ছেড়ে এগুলি উৎপাদন থেকে বন্টন এবং বিক্রি সবটাই রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যের আওতায় আনত। একমাত্র এই পথেই সম্ভব ছিল মূল্যবৃদ্ধির আগুন থেকে মানুষকে বাঁচানো। তাই এই দাবিকে জোরদার করাই আজ সময়ের ডাক।