মহান নভেম্বর বিপ্লবের গৌরবময় ঐতিহ্য স্মরণ করতে লাখো শোষিতের হাত মিলবে শহিদ মিনারে

চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে সাগর দত্ত বিস্ময়ের সাথে বলল, ‘তুমি যা বললে তা সব সত্যি নাকি?’

সাগর দত্ত৷  যুবক৷ শহরে টোটো চালায়৷ তারই টোটো ভাড়া করে মাইক বেঁধে সারাদিন প্রচার চলছে– নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ পূর্তিতে ১৭ নভেম্বর শহিদ মিনারের সমাবেশে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে৷

সাগর প্রশ্ন করে, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর ছাত্রকর্মী শুভকে– ‘সত্যি নাকি?  ওই যে বললে, এমন একটা দেশ ছিল যেখানে বেকারি ছিল না, দারিদ্র ছিল না৷  ভিখারি ছিল না, অশিক্ষা ছিল না, অসহায় পতিতার চোখের জল ছিল না৷’  শুভ হেসে বলে, ‘সত্যি না তো কি মিথ্যে এত লোককে প্রতিদিন বলছি৷  হ্যান্ডবিল দিচ্ছি৷’ সাগর কাঁচুমাচু মুখে বলে, ‘জানি না তো কিছু, রাজনীতিতে সবাই শুধু মিথ্যে বলে৷ ভেবেছিলাম চাকরি পাব৷ তারপর জমি বিক্রি করে টোটো কিনলাম৷  তাও বলছে চালাতে দেবে না৷  বিশ্বাস করতে বড়ো ভয় করে৷  তবে তোমাদের সাথে হঠাৎ আলাপ হয়ে ভাল লাগছে৷  ভরসা পাচ্ছি শুনতে শুনতে৷’ সাগর হাসে৷ সেই হাসি মেশে মানুষের সাগরে৷  লাল পতাকায় মোড়া টোটো ছুটে চলে৷

রেলস্টেশন৷ পথসভা চলছে৷ ভ্রাম্যমান অটোতে মাইক৷ হঠাৎ এগিয়ে আসে সোলেমান সেখ৷  রেল ওয়াগনের মাল খালাস করে৷  হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডবিল নিল৷

‘একটা নয়, আরও কিছু কাগজ দেন৷’ ‘অত কী হবে?’– সংশয়ী দাতা৷ সোলেমান বলে, ‘গাঁয়ের মানুষকে দেব৷ কতদিন আপনাদের খুঁজছি জানেন৷’ একটু থেমে বলে, ‘বছর বছর ভোট দিই–একবার এ জেতে, একবার ও৷ মানুষ মরে৷ জিনিসের দাম বাড়ে৷ বন্যায় ঘর ভাঙে’৷ মনে পড়ে লেনিনের বিখ্যাত কথা৷ বুর্জোয়া পার্লামেন্টে মানুষ ভোটে নির্বাচিত করে আগামী পাঁচ বছর যে তার পিঠে চাবুক মারবে, তাকে৷  এস ইউ সি আই (সি) কর্মীরা সোলেমানকে জিজ্ঞাসা করে, ‘যাবে তো ভাই কলকাতার সমাবেশে?’– ‘যাব বলেই তো কাগজ নিলাম৷’

ময়দানে সমাবেশের প্রচার ঘিরে উঠে আসছে এমনই কত কথোপকথন৷ ‘তোমাদের এম পি আছে? এম এল এ’? নিঃসংকোচে দ্বিধাহীন উত্তর এলো, ‘না’৷ ‘একজনও এমএলএ–এমপি নেই, তোমরা শহিদ মিনারে সভা ডেকেছো? মাঠ ভরবে? কর্মীটি উত্তর দিলেন, ‘আমাদের এমএলএ–এমপি নেই, কিন্তু পার্টি আছে৷ শ্রমিক শ্রেণির পার্টি, শোষিত মানুষের পার্টি, যা না হলে বিপ্লব হবে না৷ আশপাশে অনেক দলকেই তো দেখছি, এখনও এমএলএ–এমপি আছে কয়েকজন, কিন্তু পার্টিগুলোই উঠে গেল প্রায়৷’ চায়ের দোকানের জটলায় তখন কৌতুকের হাসি৷ সকলকে লিফলেট দিয়ে কর্মীটি বললেন, ১৭ তারিখে আসুন শহিদ মিনারে, দেখবেন মানুষ কোথা থেকে আসে, কীসের টানে আসে৷ দেখতে পাবেন এসইউসি আজ কত বড়৷’

সবে শীতের আমেজ লাগা পড়ন্ত বিকেলে বাতাস উঠেছে৷ প্রাণখুলে উড়ছে লাল পতাকাটা৷ বাসস্ট্যান্ড৷ প্রচার শুনে এগিয়ে আসে  ইঞ্জিনিয়ারিং–এর ছাত্র সাহাবুদ্দিন৷

‘… সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় সবার হাতে কাজ ছিল৷ সবার ছিল শিক্ষার সুযোগ৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এরা শুধু ক খ গ ঘ শেখায়নি৷ মানুষ করার জন্য শিখিয়েছে…’৷ সাহাবুদ্দিন বলে, ‘দেন তো আমাকে একটা বই– মানব কল্যাণে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র৷ আমিও যাব কলকাতায়৷’ স্বপ্নটা প্রাণ পাচ্ছে একটু একটু করে৷ এই নিদারুণ বিশ্বাসভঙ্গের সময়ে৷

সন্ধ্যায় এল ফোন৷ মানোয়ারা বিবির৷ বিডিও অফিসের চুক্তিভিত্তিক কর্মী৷  বলল, ‘আপনাদের কথা শুনলাম৷ আমরা মেয়েরা যাব কলকাতার মিটিং–এ৷  আমরা মদের জ্বালায় পাগল৷ সরকারই তো মদের দোকান দিচ্ছে৷  সে দেশে (সোভিয়েত রাশিয়ায়) মাতাল ছিল না৷ মেয়েদের ওপর অত্যাচার ছিল না৷  খুব ভরসা পেলাম শুনে৷’ মানুষ বিশ্বাস করতে চাইছে সংগ্রামী লাল পতাকায়৷

আজ থেকে একশো বছর আগে রাশিয়ার মাটিতে এই স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন মহান লেনিন৷ তাঁর সুযোগ্য ছাত্র মহান স্ট্যালিন দেশের ভিতরের ও বাইরের প্রতিক্রিয়াশীলদের আক্রমণকে প্রতিহত করে গড়ে তুলেছিলেন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা৷ ভারতবর্ষে এই আন্দোলন গড়ে তুলছে এ যুগের মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের হাতে গড়া দল এস ইউ সি আই (সি)৷ দল ডাক দিয়েছে ১৭ নভেম্বর শহিদ মিনার ময়দানের সমাবেশে যোগ দিতে৷ সমাবেশের এক শিক্ষক–প্রচারক সাত্যকির হাত থেকে আর এক শিক্ষক ‘মহান নভেম্বর বিপ্লব ও লেনিন’ বইটি নিয়ে বলেন, ‘সত্যিই এমন স্বপ্নের দেশ ছিল যেখানে মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ ছিল না৷ অসহায় মানুষের বেদনার আর্তনাদ ছিল না৷ এ তো বাস্তব৷ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়৷ বিশ্বাস করুন৷’

আহ্বান এসেছে৷  সুন্দরবন থেকে উত্তরে সিকিমের পাহাড়ের চূড়ায়৷ কেরালার দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা মহান লেনিন স্ট্যালিনের ছবিতে৷ কর্ণাটকের হাজার হাজার আশাকর্মীর দৃপ্ত মিছিলে৷ হরিয়ানার কৃষকদের জাঠায়, ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের ক্রান্তি মার্চে– এসেছে আহ্বান৷ ঝাড়গ্রামের আদিবাসীদের পাড়ায় পাড়ায় চলছে মিটিং– এ ভোট নয়৷  রিলায়েন্স কোম্পানির টাকায় সরকারি নেতাদের বারোয়ারি ভাষণ নয়৷  এ সমাজ বদলের ইতিহাসের কথা– আমাদের পচাগলা সমাজটাকে বদলের শপথ নেওয়ার ডাক৷

উলুখড়ের ঝাঁটা বুনতে বুনতে দেবেন সোরেন কালো মুখের ঝরঝরে হাসিতে বলে, ‘আমরাও তো যাব ভেবেছি, তুমাদের বউদি গেছে পাশের গাঁয়ে লোক ডাইক্তে’৷  ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছে৷ বিশ্বাসের ছবি৷ স্বপ্নের ছবি৷ মার্কসবাদ দেখিয়েছে শ্রম ও পুঁজির অনিরসনীয় দ্বন্দ্বে শ্রেণিসংগ্রাম মাথা তুলবেই৷  ভেঙে ফেলবে এই শোষণ শাসনের প্রাচীর৷ হাজার হাজার লাল পতাকায় অসংখ্য শোষিত মানুষের হাত মিলে যাবে ১৭ নভেম্বর শহিদ মিনার ময়দানে৷ জেনে নেবে যথার্থ বিপ্লবী নেতৃত্বে পথ চলার ঠিকানা৷