ভোট আসতেই শ্রমিক–দরদির ভেক ধরলেন প্রধানমন্ত্রী

দিল্লি থেকে ভিডিও কনফারেন্স মারফত বিহারের একটি এলাকায় গরিব কল্যাণ রোজগার অভিযানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হাসি হাসি মুখে পরিযায়ী শ্রমিকদের জিজ্ঞেস করেছেন, কেন ফিরতে হল? কী ভাবে ফিরলেন? শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখে বসার বন্দোবস্ত ছিল? শেষে প্রশ্ন করেছেন, কী? রাগ করেছেন আমার উপর?

এই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর আজ দেশবাসীর জানা৷ অথচ জানা নেই কি কেবল প্রধানমন্ত্রীর? ভিন রাজ্য থেকে শ্রমিকদের কেন ফিরতে হল প্রধানমন্ত্রী জানেন না? সত্যিই কি এ তাঁর অজ্ঞতা? দেশের কোনও মানুষ তা মনে করেন না৷ বাস্তবে এ তাঁর ভান৷ কিন্তু কেন প্রধানমন্ত্রীকে আজ দরিদ্র, কাজ হারানো অসহায় শ্রমিকদের কাছে এমন দৃষ্টিকটু ভান করতে হচ্ছে? কারণ, সামনে বিহারের নির্বাচন৷ প্রধানমন্ত্রীর খুব ভাল করেই জানা আছে, করোনা মোকাবিলার নামে তাঁর অতর্কিত লকডাউন ঘোষণা দেশের কোটি কোটি অন্য সব সাধারণ মানুষের মতো কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনেও কী নিদারুণ দুঃখ–কষ্ট নামিয়ে এনেছিল৷ অন্যদের থেকে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়তি কষ্ট ছিল সরকারি অসহযোগিতার কারণে প্রাণ হাতে নিয়ে তাঁদের বাড়ি ফেরার অভিযান৷

দেশের বাইরে থাকা সমাজের উঁচুতলার মানুষদের জন্য যে সরকার এমনকি বিনা খরচে বিমানের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, দেশের মধ্যে সমস্ত পরিবহণ বন্ধ করে দিয়ে সেই সরকারই ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে৷ সেই দৃশ্য দেশবাসীর স্মৃতিতে এখনও খুবই টাটকা– হাজারে হাজারে লাখে লাখে শ্রমিক স্ত্রী–সন্তান নিয়ে দেশের রাজপথগুলি দিয়ে হেঁটে চলেছে৷ মা সন্তানকে কোলে নিয়ে হাঁটছেন তো, বাবা হাঁটছেন কাঁধে চাপিয়ে৷ কোথাও বৃদ্ধ অক্ষম বাবা–মাকে ডুলি তৈরি করে বয়ে নিয়ে চলেছেন সন্তানেরা৷ সরকার সেদিন শ্রমিকদের এই ভয়ঙ্কর উপায়হীন দুরবস্থার কথা মুহূর্তের জন্যও ভাবেনি৷ উপরন্তু কেন তাঁরা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে শারীরিক দূরত্ব না রেখে রাস্তায় বেরিয়েছেন, তার কৈফিয়ত দাবি করে নামিয়ে এনেছিল নির্মম পুলিশি অত্যাচার৷ সেই নির্মমতার কথা ভাবলে আজও শ্রমিকরা ভয়ে শিউরে ওঠেন৷ পুলিশি অত্যাচার এড়াতে শ্রমিকরা কী ভাবে রাজপথ এড়িয়ে এমনকি দুর্গম বন–জঙ্গলের মধ্যে দিয়েও হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন, ভিন রাজ্যের লঙ্কা খেতে কাজ করতে যাওয়া বারো বছরের বালিকা জামলো মকদমের মর্মান্তিক মৃত্যু তা সারা দেশের মানুষের সামনে নিয়ে এসেছিল৷ এ ভাবে হাঁটতে গিয়ে খাদ্যের অভাবে পানীয়ের অভাবে, দীর্ঘ পথ চলার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে শতাধিক শ্রমিক কী ভাবে ছটফট করতে করতে রাস্তায় পড়ে মারা গেছেন, সন্তানসম্ভবা মা পথেই সন্তানের জন্ম দিয়ে আবার হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন, সংবাদমাধ্যমে তার অজস্র ছবি উঠে এসেছে৷

এই সব মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতি শ্রমিকদের এবং দেশের মানুষের মনে যে অটুট রয়েছে তা প্রধানমন্ত্রী ভালোই জানেন৷ সামনে ভোট এসে যাওয়ায় তাঁদের এই স্মৃতিকেই আজ ভয় পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী৷ ভয় পাচ্ছেন রাজ্যে রাজ্যে শাসক দলের নেতারা৷ এই স্মৃতিকে ভোলাতেই প্রধানমন্ত্রীর এই না জানার ভান৷ শ্রমিকদের সীমাহীন কষ্ট আর নির্মম পুলিশি অত্যাচারের সামনেও যে প্রধানমন্ত্রী টুঁ–শব্দ করেননি, তাঁরা খাদ্যের জন্য, একটু আশ্রয়ের জন্য, প্রাপ্য মজুরিটুকুর বন্দোবস্ত করার জন্য বারবার কাতর আবেদন করলেও যে প্রধানমন্ত্রী তাতে এতটুকু পাত্তা দেননি, ভোটের আগে সেই তিনি আজ শ্রমিকদের সামনে ছুটে এসেছেন রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের ঝুলি নিয়ে৷ ঘোষণা করেছেন গরিব কল্যাণ রোজগার অভিযান৷ শুধু তাই নয়, লকডাউনের মধ্যে শ্রমিকরা যখন খাদ্যের অভাবে, জীবিকার অভাবে বাঁচার জন্য এক অসম লড়াই লড়ছেন, তখন এই প্রধানমন্ত্রীই একের পর এক শ্রমিকদের অর্জিত অধিকারগুলি কেড়ে নিয়েছেন, তাঁদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন কালা আইনের বোঝা৷ আট ঘণ্ঢা শ্রমের অধিকার কেড়ে নিয়ে মালিকদের হাতে তুলে দিয়েছেন যথেচ্ছ খাটানোর দানবীয় অধিকার৷ সেই প্রধানমন্ত্রী আজ ভোটের আগে শ্রমিকদের বোঝাচ্ছেন তিনি শ্রমিকদের কত মর্যাদা দেন৷ বলেছেন, কেন্দ্র ও বিহার দুই সরকারই নাকি শুরু থেকেই পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য চিন্তিত ছিল৷ কতখানি নির্লজ্জ হলে প্রকাশ্যে এমন মিথ্যাচার করা যায় পরিযায়ী শ্রমিকদের নজিরবিহীন দুরবস্থার জন্য যে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারই দায়ী তা দেশে আজ কারও জানতে বাকি নেই৷ একই ভাবে বিহারে ভোটের সামনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী সেখানকার যে জোট–শরিক নীতীশ কুমারকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, বিহারের সেই নীতীশ সরকারও এ রাজ্যে মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল সরকারের মতোই শুরু থেকেই পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার বিরোধিতা করেছিল৷ দেশের মানুষের তা–ও কি অজানা? ভোটের আগে আজ সেই সব নেতারাই কোনও রকম চক্ষুলজ্জার বালাই না রেখে শ্রমিকদের মন ভেজাতে শ্রমিক–দরদির ছদ্মবেশে তাঁদের সামনে হাজির হয়েছেন৷

বাস্তবে এই হল ভোটবাজ দলগুলির, তাদের নেতাদের স্বরূপ৷ মানুষের প্রতি কোনও দরদই এঁদের নেই৷ তাঁদের দুদর্শা এঁদের হৃদয়কে এতটুকুও আলোড়িত করে না৷ আসলে মানুষকে এঁরা মানুষ মনে করেন না৷ মানুষ শুধু এঁদের কাছে একেক জন ভোটার মাত্র৷ তাঁরা মনে করেন পুঁজিবাদী শোষণে, শাসকদের নিষ্পেষনে তাঁদের জীবন যতই জর্জরিত হোক, ভোটের আগে কিছু খুদ–কুঁড়ো ছুঁড়ে দিলেই সেই ক্ষতে মলম দেওয়া হয়ে যায়৷ মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়া যায় অতীতের সব দুঃস্বপ্নের স্মৃতি৷ মানুষকে এঁরা নির্বোধ ভাবেন৷ বাস্তবে মানুষ নির্বোধ তো ননই, বরং শাসকদের চেয়ে সমস্ত দিক থেকেই বেশি সংবেদনশীল৷ তাঁরা শাসক বুর্জোয়া নেতাদের প্রতারণা স্পষ্টই ধরতে পারেন৷ কিন্তু সংগঠিত না হওয়ার জন্য এই প্রতারণার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার রাস্তাটা তাঁরা দেখতে পান না৷ বারে বারেই তাঁরা শাসক দলগুলির দ্বারা প্রতারিত হন৷ কিন্তু আর পড়ে পড়ে মার খাওয়া নয়৷ শ্রমিকদেরই এগিয়ে এসে আজ সঠিক নেতৃত্বে সচেতন সংঘশক্তি গড়ে তুলতে হবে এবং এর দ্বারাই একমাত্র শ্রমিক শ্রেণি তথা দেশের সাধারণ মানুষ শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া এই স্থায়ী দুঃশাসনের হাত থেকে রেহাই পেতে পারেন৷