‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি ইলেক্টোরাল বন্ড’

ভারতের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের মনের একটা কথাকে তুলে ধরেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পরাকলা প্রভাকর। তাঁর আর একটা পরিচয়ও আছে, তিনি কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণের স্বামী। তিনি বলেছেন, নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারি শুধু ভারতের নয়, সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি। তিনি আরও বলেছেন, এই কেলেঙ্কারির অভিঘাত আরও বহুদূর পর্যন্ত যাবে। এর জন্য ভোটাররা এই সরকারকে অত্যন্ত কঠিন শাস্তি দেবে। এবারের নির্বাচন বিজেপি বনাম আমজনতার লড়াই হয়ে উঠবে। (আনন্দবাজার পত্রিকা ২৮.০৩.২৪)।

শ্রী প্রভাকরকে ধন্যবাদ, তিনি একটা সত্যকে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন। এই মারাত্মক কেলেঙ্কারির হোতাদের কঠিন শাস্তি দেওয়াটাই জনগণের কর্তব্য। আশা, বিজেপির পাতা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ফাঁদে পা না দিয়ে জনগণ সে কর্তব্য অবশ্যই পালন করবেন। নরেন্দ্র মোদির মতো ধুরন্ধর রাজনীতিবিদও যে এই আশঙ্কাতেই ভুগছেন, তা স্পষ্ট হল পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে বিজেপি মনোনীত প্রার্থীর সাথে তাঁর পরিকল্পিত ফোনালাপের প্রকাশ্য বয়ান দেখে। মোদিজি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এবার ভোটে জিতলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ইডি-সিবিআইয়ের বাজেয়াপ্ত করা তিন হাজার কোটি টাকা এ রাজ্যের গরিব মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢুকিয়ে দেবেন।

ভোটের বাজারে মোদিজির নাট্য-দক্ষতা সর্বজনবিদিত। কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁর স্ক্রিপ্ট একটু কাঁচা থেকে গেছে। কারণ, সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠছে, টাকা ফেরত দিতে গেলে ইডি, সিবিআই, আয়কর দফতরের তদন্ত শেষ করতে হবে তো! পশ্চিমবঙ্গে চিটফান্ড কেলেঙ্কারির বয়স দশ পেরিয়ে গেলেও বিচারই ঠিক করে শুরু হয়নি। চাকরি দুর্নীতি নিয়ে প্রচার হচ্ছে অনেক, কিন্তু তদন্ত এগোচ্ছে শামুকের চেয়েও ধীরে। মোদিজি গরিবের টাকা ফেরত ও দোষিদের শাস্তি চাইলে, তাঁর এজেন্সিগুলিকে তদন্ত দ্রুত শেষ করতে বাধ্য করতেন। এজেন্সিগুলি কেন্দ্রীয় শাসকদের রাজনৈতিক লাভের দিকে লক্ষ রেখে মামলা টেনে চলার নির্দেশপ্রাপ্ত কি না, প্রশ্ন সেটাও! সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও ইডির সমালোচনা করে বলেছে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করার চেয়ে মামলাকে দীর্ঘায়িত করে বিনা বিচারে আটকের দিকেই ইডির আগ্রহ বেশি। আর শুধু পশ্চিমবঙ্গের কেন, অন্যান্য রাজ্যের উদ্ধার হওয়া টাকাগুলো কোথায় যাবে? এ ছাড়া কোভিডের সময় ‘পিএম কেয়ারস ফান্ড’ নামে বেসরকারি তহবিলে সরকারি-বেসরকারি দুই পক্ষের থেকেই হাজার হাজার কোটি টাকা ঢুকেছিল। তার হদিশ কোথায়? ওই টাকাগুলোও জনগণকে ফিরিয়ে দিন মোদিজি!

আরও প্রশ্ন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে যত টাকা বিজেপি পকেটে ভরেছে তা ফেরত দেওয়ার কথা তিনি বললেন না কেন? মোদিজি গদিতে বসার প্রথম দিকে বলতেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’। তারপর ক্রমাগত স্লোগান তাঁর মুখ থেকে হারিয়ে গেছে। রাফাল বিমান কেলেঙ্কারি কোনও রকমে চাপা দিয়েছেন। মোদিজির বিশেষ বন্ধু আদানি সাহেবের শেয়ার কেলেঙ্কারিও কার্পেটের তলায় চাপা পড়েছে। কেন্দ্রীয় হিসাব রক্ষক সিএজি তাদের রিপোর্টে নানা গরমিলের কথা তুললেও বিরোধী পক্ষের চূড়ান্ত নড়বড়ে দশার সুযোগে তাও ফাইলের স্তূপে লুকিয়ে ফেলা গেছে। কিন্তু এই বিরাট আকারের বন্ড কেলেঙ্কারিকে চাপা দেবেন কী দিয়ে?

বিশ্ব জেনে গেছে পুঁজিপতিদের থেকে গোপনে টাকা নিয়ে তাদের সেবায় আত্মনিয়োগ করার শর্তেই ইলেক্টোরাল বন্ড চালু করেছিল বিজেপি। আর পুঁজিপতিরা তো বিজেপি সহ সমস্ত বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া দলকে টাকা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েই আছে। কারণ এই সমস্ত দলগুলোই পুঁজিপতি শ্রেণির পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করে থাকে। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকা দল পায় সবচেয়ে বেশি। রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা দল, বিরোধী হিসাবে আগামী দিনে সরকারে যাওয়ার লাইনে দাঁড়ানো দলগুলো তুলনামূলক কম পায়। কিন্তু পুঁজিপতিরা এদের কাউকেই একেবারে নিরাশ করে না। এ জন্যই বিজেপি নির্বাচনী বন্ড থেকে ৬,৯৮৬ কোটি টাকা পেলেও তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ১,৩৯৭ কোটি টাকা, কংগ্রেস পেয়েছে ১,৩৩৪ কোটি টাকা। অভিযোগ, বিজেপির বিপুল প্রাপ্তির পিছনে আছে বিশেষ বিশেষ পুঁজিপতিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার বিনিময়-মূল্য।

নির্বাচনী বন্ডকে কার্যত তোলা আদায়ের শিল্পে পরিণত করতে পেরেছে বিজেপি। ইডি, সিবিআই, আয়কর দফতরের তদন্তের আওতায় থাকা ৪১টা কোম্পানি বিজেপির তহবিলে ইলেক্টোরাল বন্ড মারফত ২,৪৭১ কোটি টাকা ঢেলেছে। কোম্পানিগুলো ১,৬৯৮ কোটি টাকা বিজেপিকে দিয়েছে তাদের দফতরে ইডি, সিবিআই বা আয়করের তল্লাশির অল্প কিছুদিনের মধ্যে। ফিউচার গেমিং লটারি সংস্থা আয়কর এবং ইডি তল্লাশির তিন মাসের মধ্যে বিজেপির তহবিলে ৬০ কোটি টাকা দিয়েছে। দিল্লির অবগারি দুর্নীতি মামলায় নাম জড়ানো অরবিন্দ ফার্মার মালিক গ্রেপ্তারের তিন মাসের মধ্যে ৫ কোটি টাকা এবং মোট ৩৪.৫ কোটি টাকা ঢালায় সেই মালিক এখন ‘অভিযুক্ত’ থেকে ‘রাজসাক্ষী’-তে পরিণত হয়েছেন। তাঁর আরও এক কোম্পানি ১০ কোটি টাকা বিজেপিকে দিয়ে শুদ্ধ হয়েছে। কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গান্ধীর জামাই রবার্ট বঢরা এবং ডিএলএফ কোম্পানির জমি কেলেঙ্কারি নিয়ে জলঘোলা হওয়ার পর ডিএলএফ-এর তিনটি শাখা মিলে ১৭০ কোটি টাকা বিজেপিকে দেওয়ার পর হরিয়ানার বিজেপি সরকার হাইকোর্টে জানিয়েছে এই জমি নিয়ে কোনও দুর্নীতি হয়নি। এ ছাড়াও আছে শেল কোম্পানি বা ভুয়ো কোম্পানির মাধ্যমে টাকা ঢালা। বড় বড় ধনকুবেররা কোটি কোটি টাকা ঢেলেছে বেনামে অন্য কোম্পানির নামে। আম্বানিদের শেল বা খোলস কোম্পানি হিসাবে কাজ করেছে ‘কুইক সাপ্লাই চেন’। এরা ৩৭৫ কোটি টাকা ঢেলেছে বিজেপির তহবিলে। এই রকম কিছু কোম্পানি নিজেদের ঘোষিত মুনাফার ৬ গুণের বেশি টাকা নির্বাচনী বন্ডে ঢেলেছে। এরা কালো টাকা সাদা করার মেশিন হিসাবে কাজ না করলে এমনটা নিশ্চয়ই ঘটতে পারত না! টাকার মালিক হওয়া এবং নির্বাচনে লড়া এতটাই মিলে মিশে গেছে যে, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীও বলেছেন, দক্ষিণ ভারত থেকে লোকসভা ভোটে লড়তে গেলে যে বিপুল পরিমাণ টাকা ঢালতে হয় তা তাঁর পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। আজকের বুর্জোয়া গণতন্তে্র নির্ণায়ক শক্তি যে টাকা– তা আরও একবার উঠে এল।

স্বাভাবিকভাবেই, পুঁজিপতিদের থেকে পাওয়া এই বিপুল পরিমাণ টাকা ঢেলে নির্বাচনে যে পার্টি জিতবে তারা জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে পুঁজিপতিদের স্বার্থই দেখবে তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বাস্তবে গত দশ বছরের শাসন কালে বিজেপি পুঁজিপতিদের পায়ে অঞ্জলি দিতে জনগণের স্বার্থকেই বলি দিয়েছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যকে পর্যন্ত পুঁজিপতিদের মুনাফার পণ্য করে তুলেছে বিজেপি।

জনগণের করের টাকায় গড়ে ওঠা সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সম্পদও আজ একচেটিয়া পুঁজির কুক্ষিগত। স্বাভাবিকভাবেই বর্তমানে পুঁজিপতি শ্রেণির সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেবক এই বিজেপিকে পরাস্ত করা আজ জনগণের নিজের স্বার্থেই জরুরি। সেই প্রয়োজনকে সামনে রেখে স্বাভাবিকভাবেই এবারের নির্বাচন বিজেপি বনাম ভারতের জনগণের লড়াই।