বিবেকানন্দ ও দীনদয়াল একাসনে!

বিজেপি একজন মহাপুরুষ সৃষ্টি করেছে৷ তাঁকে বিবেকানন্দ–লোকমান্য তিলক প্রমুখের পাশে বসিয়ে দিয়েছে এবং জোর গলায় প্রচার করছে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় এঁদের সমকক্ষ৷ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তাঁর জন্মশতবর্ষ উদযাপন করেছে৷ নানা সরকারি প্রকল্পের নামকরণ তাঁর নামে করা হচ্ছে৷ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে সমস্ত স্কুলে তাঁর জীবনী পড়ানো হচ্ছে৷ রাষ্ট্রপতি সেন্ট্রাল হলে তাঁর ভাষণে মহাত্মা গান্ধীর সাথে দীনদয়াল উপাধ্যায়কে একাসনে বসিয়ে দিয়েছেন৷ সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে বিজেপি ও আরএসএস বেশ কোমর বেঁধেই আসরে নেমে পড়েছে৷ প্রশ্ন হল, দেশ–জাতি–সমাজ–সভ্যতার জন্য দীনদয়ালজির অবদান কী? দেশ যখন সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত তখন তাঁর ভূমিকা কী ছিল? দেশের মানুষের চিন্তা–ভাবনা–সংস্কৃতি-মূল্যবোধ বিকাশে তাঁর অবদান কী? নবজাগরণের যে আলো রামমোহন–বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দ-নেতাজি প্রমুখ মহান মনীষীরা এ দেশের বুকে জ্বেলেছিলেন তাকে আরও উজ্জ্বল, আরও দীপ্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা কী? যদি এই সব ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা দেশের নবজাগরণের ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান সন্তানদের অনুসারী হয়, তবে দেশের কাছে জাতির কাছে তাঁর মূল্য অনেক৷ কিন্তু যদি দেখা যায়, চিন্তা ও কর্মের মধ্য দিয়ে নবজাগরণ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান সন্তানদের শিক্ষার বিপরীতে হেঁটেছেন তিনি, তা হলে বিজেপির কাছে তাঁর যতই মূল্য থাকুক, দেশ–জাতি ও সভ্যতা তাঁকে মূল্য দেবে কেন?

দীনদয়ালজির সংক্ষিপ্ত পরিচয়

পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ের জন্ম ১৯১৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন যুক্তপ্রদেশের মথুরা জেলার চন্দ্রভান গ্রামে৷ ১৯৩৭ সালে তিনি বিএ পাশ করেন৷ ওই বছরই তিনি আরএসএস–এ যোগ দেন এবং এমএ পড়ার জন্য আগ্রায় যান৷ আরএসএস–এর কাজকর্মের সূত্রে এখানেই তাঁর সাথে পরিচয় হয় নানাজি দেশমুখের৷ আরএসএস–এর পূর্ণাঙ্গ সময়ের কর্মী হিসাবে তিনি ১৯৪২ সালে সংগঠনে যোগ দেন৷ জেলা সংগঠক হিসাবে তিনি উত্তরপ্রদেশের লখিমপুরে কাজ শুরু করেন৷

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট তিনি ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন৷ তারপর প্রকাশ করেন সপ্তাহিক পত্রিকা ‘পাঞ্চজন্য’ এবং শেষে ‘দৈনিক স্বদেশ’৷ ১৯৫১ সালের ২১ অক্টোবর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর নেতৃত্বে জন্ম নেয় ‘ভারতীয় জনসংঘ’৷ পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় এই দলের উত্তরপ্রদেশ শাখার সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং তারপর সর্বভারতীয় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৫৩ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলে সংগঠনের দায়িত্ব এসে পড়ে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ের কাঁধে৷ ১৫ বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন৷ ১৯৬৮ সালে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷

দীনদয়াল উপাধ্যায় ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম

সংক্ষিপ্ত এই জীবনচিত্রে দেখা যাচ্ছে, ১৯৩৭ সালে পূর্ণ যুবক বয়সেই পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় আরএসএস–এ যোগ দিয়েছিলেন এবং ১৯৪২ সালে তিনি আরএসএস–এর সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে কাজ শুরু করেছিলেন৷ সময়টা ছিল ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবজনক অধ্যায়৷ ১৯৪২–এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে তখন অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিচ্ছেন৷ স্বাধীনতা আন্দোলনে একে একে শহিদের মৃত্যু বরণ করছেন ভগৎ সিং, রাজগুরু, শুকদেব, চন্দ্রশেখর আজাদ, প্রীতিলতা, সূর্য সেন প্রমুখ৷ লক্ষ লক্ষ মানুষকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরে দেওয়া হয়েছে৷ বিভিন্ন জায়গায় নারীদের উপর নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে পুলিশ, স্বাধীনতাকামী জনগণ উত্তরপ্রদেশের বালিয়া ও বাংলার তমলুকে ‘স্বাধীন সরকার’ প্রতিষ্ঠা করেছে৷ দেশের পূর্ব প্রান্তে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে শুরু হয়েছে আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম৷ উদাত্ত কণ্ঠে নেতাজি আহ্বান জানাচ্ছেন ‘গিভ মি ব্লাড, আই প্রমিস ইউ ফ্রিডম’৷ ১৯৪৬ সালে শুরু হয়েছে বোম্বের নৌ বিদ্রোহ৷ ব্রিটিশের গোলামখানা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে হাজার হাজার নৌ–সেনা৷ ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে তারা উড়িয়ে দিয়েছে স্বাধীন ভারতের পতাকা৷ গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক এইভাবে অসংখ্য বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল৷

ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এই দিনগুলোতে তরুণ দীনদয়াল কী ভূমিকা পালন করেছিলেন? তিনি কি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন? না, তেমন কোনও ভূমিকা পালন করতে তাঁকে দেখা যায়নি৷ দেখা যায়নি কারণ, দীনদয়ালজি ও তাঁর সংগঠন আরএসএস মনে করত ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা উচিত নয়৷ এই কারণে তাঁরা ১৯৪০–’৪১–এর ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার এবং বোম্বাইয়ের নৌ বিদ্রোহকে ঘিরে ১৯৪৫–’৪৬–এর আন্দোলন সব কিছু থেকেই সচেতন ভাবে দূরে থেকেছেন৷ চেষ্টা করেছেন দেশের তরুণদের এই সংগ্রাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে৷

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কী চোখে দেখতেন আরএসএস নেতারা? এ প্রসঙ্গে আরএসএস–এর চিন্তানায়ক গোলওয়ালকরের বক্তব্য ছিল, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেকগুলিই কার্যত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল৷ ব্রিটিশ বিরোধিতাকে ভাবা হত দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমার্থক৷ এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবর্গ ও সাধারণ মানুষের উপর বিনাশকারী প্রভাব ফেলেছিল৷’’ (চিন্তাচয়ন ১ম খণ্ড, পৃঃ ১২৫)৷ অর্থাৎ আরএসএস–এর মতে পরাধীন ভারতে ‘ব্রিটিশ বিরোধিতা’কে দেশপ্রেম বলা ভুল হয়েছিল এবং এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গির ফলে সাধারণ মানুষের উপর বিনাশকারী প্রভাব পড়েছিল৷ কিন্তু শুধু এটুকু বলেই আরএসএস থেমে যায়নি, ‘নিয়মনীতি মেনেই সংঘ আইনের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে কাজকর্ম করেছে এবং বিশেষভাবে, ১৯৪২–এর আগস্ট মাসে যে গোলমাল হয়েছিল তাতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছে৷’ (দ্য ব্রাদারহুড ইন স্যাফ্রন ঃ দি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ অ্যান্ড হিন্দু রিভাইভালিজম)৷

১৯৪৩ সালের ২৯ এপ্রিল গোলওয়ালকর আরএসএস–এর সদস্যদের উদ্দেশে একটা নির্দেশাবলি জারি করেন৷ তাতে বলা হয়, ‘‘আমরা কুচকাওয়াজ ও ইউনিফর্ম সম্বন্ধে সরকারের আগের নির্দেশ মতো আমাদের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছি …যাতে আমাদের কার্যকলাপ আইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে৷ সময় বদলাতে পারে এই অপেক্ষায় না থেকে এখন আমরা স্থির করেছি যে ওই অংশটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হবে৷’’ অর্থাৎ  ব্রিটিশ বিরোধিতা নয়, ব্রিটিশের সাথে সহযোগিতা– এই ছিল আরএসএস–এর ভূমিকা৷

দীনদয়ালজি ছিলেন আরএসএস–এর একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রচারক৷ তিনি তো আরএসএস–এর এই চিন্তা, এই মতবাদই প্রচার করেছিলেন তিনি প্রচার করেছিলেন, ব্রিটিশের বিরোধিতা নয়, ব্রিটিশের সাথে সহযোগিতা করা দরকার এবং এটাই ভারতবাসীর একমাত্র কর্তব্য৷ এই কাজ তিনি এত দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে করেছিলেন যে দ্রুত সংগঠনে তাঁর পদোন্নতি হয়েছিল৷ ১৯৪২ সালে একজন সাধারণ প্রচারক থেকে ১৯৪৭ সালে তিনি সংঘের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতায় পরিণত হয়েছিলেন৷ ফলে দীনদয়ালজি শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেননি তাই নয়, আরএসএস–এর ঐতিহ্য অনুযায়ী, আরএসএস–এর অন্যান্য নেতাদের মতোই তিনিও ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিলেন৷

সব থেকে বড় কথা হল, এই জন্য তাঁর কোনও আত্মগ্লানি ছিল না৷ ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ না দেওয়াকে যুক্তিসঙ্গত প্রতিপন্ন করতে গিয়ে দীনদয়ালজি বলছেন, ‘এই ভ্রান্ত ধারণাই আমাদের মনকে  আচ্ছন্ন করে আছে যে, বিদেশি শাসককে উচ্ছেদ করার মধ্যেই আমাদের স্বাধীনতা নিহিত৷ বিদেশি শাসনের বিরোধিতা মানে এই নয় যে, আমরা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক৷ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে ব্রিটিশ বিরোধিতার উপরই বড় বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল৷ ভাবা হত যারাই ব্রিটিশের বিরোধিতা করছে তারাই দেশপ্রেমিক৷ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অসন্তোষ সৃষ্টির জন্য নিয়মিত প্রচার চালানো হত৷ বলা হত দেশের সমস্ত দুঃখ–দারিদ্র–যন্ত্রণার জন্য ব্রিটিশরাই দায়ী’৷ (সি পি ভিশিকার, পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় : ইডিওলজি অ্যান্ড পারসেপশন : কনসেপ্ট অফ দ্য স্টেট)৷

এই ছিল দীনদয়ালজির সত্যকার মানসিকতা৷ ‘বিদেশি শাসনের উচ্ছেদের মধ্যে আমাদের স্বাধীনতা নিহিত নয়’, ‘বিদেশি শাসনের বিরোধিতা মানে দেশপ্রেম নয়’, ‘দেশের দুঃখ–দুর্দশা যন্ত্রণার জন্য ব্রিটিশ শাসনই দায়ী’, এ কথা বলা ভুল– এই ছিল দীনদয়ালজির মত৷ এই মতই তিনি দেশের মধ্যে প্রচার করেছেন৷ দেশের যে সমস্ত শ্রেষ্ঠ সন্তানরা ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়েছেন, দেশের মুক্তির লক্ষ্যে নিজেদের জীবনকে পরিচালিত করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই রায় দিয়েছেন দীনদয়ালজি৷ এঁকে ‘মহান’ বলা যায়?

হিন্দু–মুসলিম ঐক্য প্রসঙ্গে

ব্রিটিশ শাসকদের বন্ধুর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন– এটা পরিষ্কার, কিন্তু তা বলে কি তাঁরা সেই সময় চুপচাপ বসেছিলেন? না, এই অপবাদ দীনদয়ালজিদের দেওয়া যাবে না৷ তাঁরা মুসলমানদের কল্পিত অধীনতা থেকে হিন্দুদের মুক্ত করার জন্য প্রাণপণ প্রচার চালিয়েছিলেন৷ মুসলমানদের হুঁশিয়ারি দিয়ে গোলওয়ালকর সেই সময় বলেছিলেন, ‘হিন্দুস্তানের অ–হিন্দু জনগণকে হয় হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষা গ্রহণ করতে হবে, হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতে শিখতে হবে, হিন্দু জাতি এবং সংস্কৃতির প্রচার ব্যতীত অন্য কোনও ধারণা বর্জন করতে হবে… এক কথায়, তাদের হয় বিদেশি হয়ে থাকা বন্ধ করতে হবে অথবা তারা এ দেশে থাকতে পারে, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে হিন্দু জাতির অধীনস্থ হয়ে, কোনও কিছু দাবি না করে, কোনও বিশেষ সুবিধার দাবিদার না হয়ে তো বটেই– এমনকী নাগরিক অধিকারের দাবিদার না হয়ে৷’ (উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড, পৃঃ৫৫–৫৬)৷ দীনদয়ালজির অভিমতও ছিল একই রকম৷ গোলওয়ালকরের মতো তাঁর মনোভাবও ছিল মুসলিম বিদ্বেষী চিন্তায় ভর্তি৷ এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘‘মুসলিম সম্প্রদায়ের দেশবিরোধী  বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব অখণ্ড ভারত গড়ে তোলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা৷… অখণ্ড ভারত সম্পর্কে যাদের সন্দেহ আছে তারা মনে করে মুসলমানরা এই মনোভাব পরিবর্তন  করবে না৷ তাই যদি হয়, তবে ভারতে ছয় কোটি মুসলমানের অবস্থান  ভারতের স্বার্থের পক্ষে খুবই  ক্ষতিকারক হবে৷’’ (সুধাকর রাজে সম্পাদিত পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় গ্রন্থ থেকে)৷ দীনদয়ালজি আরও বলেছেন, ‘‘ভারতের স্বাধীনতার পর, জনগণ, রাজনৈতিক দলগুলো এবং সরকার অনেক  গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার  মুখোমুখি হয়েছে … কিন্তু মুসলিম সমস্যা হল সবচেয়ে পুরনো, সবচেয়ে জটিল৷ এই সমস্যা প্রতিদিন নতুন নতুন রূপ ধারণ করছে৷ বিগত বারোশো বছর ধরে আমরা এই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি৷’’ (বি এন জোগ, পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় : ইডিওলজি অ্যান্ড পারসেপশন–পলিটিকস ফর নেশনস সেক)৷

২০১৫ সালের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে আরএসএস–এর মুখপত্র ‘রাষ্ট্র ও ধর্ম’–তে একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল৷ প্রবন্ধের শিরোনাম ‘মুসলিম সমস্যা : দীনদয়ালজির দৃষ্টিতে’, লেখক ডঃ মহেশ চন্দ্র শর্মা৷ এই মহেশ চন্দ্র শর্মাই দীনদয়াল উপাধ্যায়ের রচনা সমগ্রের  (১৫ খণ্ড)  সম্পাদক৷ এই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কলরাজ মিশ্র৷  প্রকাশ করতে গিয়ে কলরাজ মিশ্র বলেছেন, ‘প্রবন্ধে যে সব ঘটনার কথা বলা হয়েছে আমি তার সাথে একমত৷’ প্রবন্ধে কী বলা হয়েছে? বলা হয়েছে , ‘উপাধ্যায় এও বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিগতভাবে একজন মুসলমান ভাল হতে পারে, কিন্তু দলগতভাবে সে খারাপ এবং আবার একজন হিন্দু ব্যক্তিগতভাবে খারাপ হতে পারে, কিন্তু দলগতভাবে সে ভাল৷’ ‘উপাধ্যায় বলেছেন, মুসলমান হওয়ার পর একজন ব্যক্তি জাতীয় শত্রুতে পরিণত হন৷’ ‘দেশের শাসন ক্ষমতা যদি এমন লোকের হাতে যায়, যারা কুতুবুদ্দিন, আলাউদ্দিন, মুহম্মদ তুঘলক, ফিরোজ শাহ–তুঘলক, শের শাহ, আকবর ও আওরঙ্গজেবের থেকে আলাদা না হয়, তবে বলতেই হবে তাদের ভালবাসার কেন্দ্রবিন্দু ভারতীয় জীবনধারা নয়৷’ এই হলেন পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়৷ মুসলমানরা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘মুসলমানরা জাতীয় শত্রু’, ‘ছয় কোটি মুসলমানের এ দেশে অবস্থান দেশের পক্ষে বিপজ্জনক’– এই ছিল দীনদয়ালজির চিন্তা৷ অথচ এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা হিন্দু–মুসলিম সম্পর্ককে  কী চোখে দেখেছেন? তাঁদের চোখে জাতীয় জীবনে ইসলামের গুরুত্ব কী?

জাতীয় জীবনে ইসলামের গুরুত্ব আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘‘ভারতবর্ষে কেবল হিন্দু চিত্তকে স্বীকার করলে চলবে না৷ ভরতবর্ষে সাহিত্য–শিল্পকলা –স্থাপত্য বিজ্ঞান প্রভৃতিও হিন্দু–মুসলমানের সংমিশ্রণে বিচিত্র সৃষ্টি জেগে উঠেছে৷ তারই পরিচয়ে ভারতবর্ষীয়দের পূর্ণ পরিচয়৷’’ (রচনাবলি, ১৪ খণ্ড, পৃ : ২৫১) দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বলেছেন– ‘‘মুসলমানেরা ভারতে তাদের  নিজেদের  বাসভূমি  স্থাপন করেছে৷ তারা ভারতীয় জীবনে এক নতুন ও অদ্ভুত জীবনীশক্তি নিয়ে এসেছে৷ এই জীবনীশক্তির প্রয়োজন ছিল৷’’ এ দেশের জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশে হিন্দু–মুসলমানের যুক্ত সাধনার গুরুত্ব যে কতখানি তা আমরা বুঝতে পারি আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের আলোচনায়৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘হিন্দু–মুসলমানের সাধনা এ দেশে এমন যুক্ত হইয়া গিয়াছে যে রচনা দেখিয়া লেখক হিন্দু কি মুসলিম তাহা বলা অসম্ভব৷ দরাব খাঁর রচিত সংসৃক্ত গঙ্গা স্তব তো অতি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণেরও নিত্যপাঠ্য৷’’

‘‘সেতার যন্ত্রটি হিন্দু–মুসলমান দুই যন্ত্রের সমন্বয়ে৷ এসরাজ, সুরবাহার, সারেঙ্গী প্রভৃতি হিন্দু–মুসলমানের যুক্ত সাধনার ফল৷ তবলাও তাই৷ রামপুরের নবাব কলব আলী খাঁ সুরশৃঙ্গার প্রবর্তন করেন৷’’

‘‘হিন্দু মুসলমান উভয় সাধনাতেই রসিক ও প্রেমিকেরা পরস্পর পরস্পরকে সহায়তা করিয়াছেন৷ কিন্তু যত বিপদ বাধাইয়াছেন ধর্ম–ব্যবসায়ীর দল৷ কবীর বলিয়াছেন, স্বয়ং ভগবানও ধর্ম–ব্যবসায়ীদের ভয় পান৷’’ এই হল ভারতীয় সভ্যতার সত্যকার পরিচয়৷ এখানে, আর্য–অনার্য, শক–হূন–পাঠান–মোগল এসে এক দেহে লীন হয়েছে– সৃষ্টি হয়েছে ভারতীয় সভ্যতা–সংস্কৃতির৷ একইভাবে মধ্যযুগেও ভারতে হিন্দু–মুসলমানের যুক্ত সাধনা এ দেশের সভ্যতা সংস্কৃতিকে পুষ্ট করেছে৷ গৌরবময় এই অধ্যায়কেই আধুনিক ধর্ম–ব্যবসায়ীরা অস্বীকার করেন, ইতিহাসকে বিকৃত করেন৷ পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় নিজেকে এই আধুনিক ধর্ম–ব্যবসায়ীদের অন্যতম প্রধান প্রবক্তায় পরিণত করেছিলেন এবং এইভাবে নবজাগরণের মূল প্রবাহের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন– ঐতিহাসিক এই সত্যকে কোনওমতেই অস্বীকার করা যাবে না৷ সুকৌশলে কেন্দ্রীয় সরকার স্বামী বিবেকানন্দের নামের সাথে পণ্ডিত দীনদয়ালের নাম জুড়ে দিয়েছে৷ পণ্ডিত দীনদয়ালের জন্মশতবার্ষিকীতেই ছিল স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার ১২৫ বছর৷ এই দুটো উপলক্ষকে এক সাথে জুড়ে দিয়ে ‘স্টুডেন্টস লিডার্স কনভেনশনে’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভাষণ দিয়েছেন এবং ইউ জি সি–কে বলা হয়েছে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় যেন এই বক্তৃতা শোনানোর ব্যবস্থা করে তা দেখতে৷ ইউ জি সি–ও তার ত্রুটি করেনি৷ তারা উপাচার্যদের নির্দেশ পাঠিয়েছে যেন উপযুক্ত জায়গায় টিভি বা প্রজেক্টর বসিয়ে অনুষ্ঠান শোনানোর ব্যবস্থা করা হয়৷ এইভাবে দেশের লক্ষ লক্ষ ছাত্র ও শিক্ষকের মনের মধ্যে বিবেকানন্দের পাশে দীনদয়ালকে বসিয়ে দেওয়ার সরকারি আয়োজন করা হয়েছে৷

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দীনদয়ালের ভূমিকা, হিন্দু–মুসলিম সম্পর্ক ও ঐক্য প্রসঙ্গে তাঁর চিন্তার কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি৷ আমরা দেখিয়েছি ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে তিনি অংশগ্রহণ করেননি, এমনকী ব্রিটিশ বিরোধিতাকে তিনি দেশপ্রেম বলেও মনে করতেন না৷ আবার মুসলমানদের সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সাম্প্রদায়িক বিশ্বাসে ভরা৷ এই ধরনের একজন মানুষকে স্বামী বিবেকানন্দের সমকক্ষ তো দূরের কথা একজন সামান্য অনুগামীও বলা যায় না৷ চিন্তায়–কর্মে–আচার– আচরণে-লক্ষ্যে–- সবদিক দিয়েই তিনি ছিলেন বিবেকানন্দ চিন্তার ঘোরতর বিরোধী৷ এ দেশে বহু বিপ্লবী কর্মী ছিলেন যাঁরা বিবেকানন্দ চিন্তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন৷ বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ বলেছেন, ‘‘ভারতমাতা, বন্দেমাতরম এবং স্বামী বিবেকানন্দ, এই তিনটি আমাদের মন্ত্র ছিল৷ এই তিনটি সত্যের পতাকা নিয়েই আমরা চলেছি– চলেছে বিনয়–বাদল–দীনেশ ’’ (বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, খণ্ড–৬, পৃ : ১৬২)৷ চট্টগ্রামের বীর বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস বিবেকানন্দ সম্পর্কে আবেগ ভরে লিখেছেন– ‘‘হি ইজ দ্য মরাল ফোর্স অফ ইন্ডিয়া’’৷ দীনবন্ধু এন্ড্রুজ লিখছেন, ‘‘বিবেকানন্দ ইন্টারপিড প্যাট্রিয়টিজম গেভ এ নিউ কালার টু দ্য ন্যাশনাল মুভমেন্ট থ্রু আউট ইন্ডিয়া৷ দ্য মঙ্ক অ্যান্ড দ্য প্যাট্রিয়ট ওয়্যার কিউরিয়াসলি ব্লেন্ডেড ইন হিম৷’’ (ওই, পৃ : ৯৩)৷  হাসতে হাসতে যাঁরা ফাঁসির মঞ্চে আরোহণ করেছেন তাঁদের প্রায় সবাই বিবেকানন্দের চিন্তা ও অমিত তেজের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন৷ ‘ভুলিও না জন্ম হইতেই তুমি মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত’– বিবেকানন্দের এই আহ্বান তাঁদের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্ব ত্যাগের শক্তি জুগিয়েছে৷

পণ্ডিত দীনদয়াল যদি বিবেকানন্দ চিন্তার অনুগামী হতেন তা হলে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী চেতনার চর্চা তিনি করতেন এবং এক জাতি–এক প্রাণ–একতার চিন্তা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করত৷ কিন্তু কষ্টকঠিন সমস্যাসংকুল সেই পথে তিনি হাঁটেননি৷ পরাধীন যুগে ব্রিটিশের সাথে সংগ্রাম না করে তিনি ব্রিটিশকে বন্ধু হিসাবেই গ্রহণ করেছিলেন৷ এই কারণে মুসলিম লিগ যেমন মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করে ব্যাপক মুসলিম জনতাকে জাতীয়তবাদী সংগ্রামের প্রবাহের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, পণ্ডিত দীনদয়াল ও তাঁর সংগঠন আরএসএস–ও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার তত্ত্ব প্রচার করে ব্যাপক হিন্দু জনতাকে জাতীয়তাবাদের মূল প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছিল৷ বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে হয়েছিল, অন্ধ–যুক্তিহীন হিন্দু সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সৃষ্টি করতে হয়েছিল৷

বিবেকানন্দ নিজেকে ‘হিন্দু’ বলতে গর্ব অনুভব করতেন এ কথা ঠিক৷ কিন্তু তাঁর এই চিন্তার মর্মবস্তুতে ছিল জাতীয়তাবাদ৷ সাম্প্রদায়িকতাকে তিনি ঘৃণা করতেন৷ রামকৃষ্ণের শিক্ষানুযায়ী তিনিও মনে করতেন– ‘অসংখ্য নদী যেমন বিভিন্ন পর্বত থেকে বেরিয়ে এসে একই সমুদ্রে তাদের জলধারা মিশিয়ে দেয়, তেমনি বিভিন্ন ধর্ম বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্ভূত হয়ে’ মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে৷ এই জন্য তিনি সকল ধর্মকেই সত্য বলে মনে করতেন, ধর্মীয় অনুদারতাকে ঘৃণা করতেন৷ বলতেন, ‘‘আগে ধার্মিক হও, দিবার মতো কিছু অর্জন কর, তারপর জগতের সম্মুখে দাঁড়াইয়া তাহা বিতরণ কর৷ ধর্ম বাক্যাড়ম্বর নহে, মতবাদ বিশেষ নহে, অথবা সাম্প্রদায়িকতা নহে৷’’ এই জন্য স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে ইসলাম বিদ্বেষ তো দূরের কথা, ইসলাম ধর্মের মহত্ব ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন৷ হজরত মহম্মদের প্রতি  তিনি বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন৷ তাই তাঁর মুখে আমরা শুনি, ‘‘বেদান্তের মতবাদ যতই সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর হউক না কেন, কর্মপরিণত ইসলাম ধর্মের সহায়তা ব্যতীত তাহা মানব–সাধারণের অধিকাংশের নিকট সম্পূর্ণরূপে  নিরর্থক৷ আমরা মানব জাতিকে  সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই– যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরানও নাই, অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে৷ …আমাদের নিজের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মরূপ এই দুই মহান  মতের সমন্বয়ই– বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ একমাত্র আশা৷… আমি মানস চক্ষে দেখিতেছি, এই বিবাদ–বিশৃঙ্খলা ভেদপূর্বক ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক  মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ লইয়া মহামহিমায় ও অপরাজেয় শক্তিতে জাগিয়া উঠিতেছে৷’’ ( বাণী ও রচনা, খণ্ড ৪, পৃ : ২৬) ‘‘মহম্মদের ধর্ম আবির্ভূত হয় জনসাধারণের জন্য বার্তা রূপে৷ …তাঁহার বাণী ছিল সাম্য৷ …একমাত্র ধর্ম আছে– তাহা প্রেম৷ জাতি ধর্ম বা অন্য কিছুর প্রশ্ন নাই৷ এই সাম্যভাবে যোগ দাও৷ সেই কার্যে পরিণত সাম্যই জয়যুক্ত হইল৷ …সেই মহতী বাণী ছিল খুব সহজ সরল… (ওই, পৃঃ ২২৮)৷ ‘মুসলমানের ভারত–ধিকার দরিদ্র পদদলিতের উদ্ধারের কারণ হইয়াছিল৷ এই জন্যই আমাদের এক–পঞ্চমাংশ ভারতবাসী মুসলমান হইয়া গিয়াছিল৷ কেবল তরবারির বলে ইহা সাধিত হয় নাই৷ নিছক তরবারি ও বন্দুকের বলে ইহা হইয়াছিল মনে করা নিতান্ত পাগলামি৷‘‘ (ওই, পৃঃ ৩৯৫)৷

স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন,  ‘‘মুসলমান অভিযানকারীরা  এশিয়াকে প্লাবিত করে ইউরোপকে অধিকার করতে উদ্যত হয়েছিল৷ স্পেনকে জয় করে তারা সেখানে বিরাট বিদ্যাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিল৷ সেখানে তখনকার পরিচিত পৃথিবীর সকল স্থান থেকে পণ্ডিতেরা আকৃষ্ট হয়ে এসেছিলেন৷ ভারতের প্রজ্ঞা, প্রাচ্যের জ্ঞানসম্পদের সঙ্গে এখানে পরিচয় সাধন করানো হত৷ দৈনন্দিন জীবনে শালীনতা, পরিমার্জনা ও সহবৎ তারা এনেছিল৷ পিছনে রেখে গিয়েছিল অতুলনীয় সৌন্দর্যময়  সারসৈনিক স্থাপত্য, তৎসহ বিদ্যার ঐতিহ্য এবং প্রাচ্যের ওপ্রতীচ্যের জ্ঞান ও সংস্কৃতির যথেষ্ট উপাদান৷’’ (স্বামীজীকে যেমন দেখিয়াছি–নিবেদিতা, পৃঃ ২৪৯)

বিবেকানন্দ আরও বলেছেন, ‘‘অতীতে যত ধর্ম সম্প্রদায় ছিল, আমি সবগুলিই সত্য বলিয়া মানি এবং তাহাদের সকলের সহিতই উপাসনায় যোগদান করি৷…আমি মুসলমানদিগের মসজিদে যাইব, খ্রিস্টানদের গির্জায় প্রবেশ করিয়া ক্রুশবিদ্ধ ঈশার সম্মুখে নতজানু হইব, বৌদ্ধদিগের বিহারে প্রবেশ করিয়া বুদ্ধের ও তাহার ধর্মের শরণ লইব …’’৷ (স্বামীজীর বাণী ও রচনা, খণ্ড–৩, পৃঃ ১৪০) বিবেকানন্দের এই চিন্তার সাথে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ের চিন্তার মিল কোথায়? তিনি তো দাঁড়িয়ে আছেন একেবারে বিপরীত মেরুতে বিবেকানন্দ যখন উদারতা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কথা প্রচার করছেন তখন দীনদয়াল উপাধ্যায় প্রচার করছেন ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির– যার পরিণতি দাঙ্গা, অগ্ণিসংযোগ, ধর্ষণ, লুঠতরাজ, হত্যা– মানবেতর সবকিছু৷ দীনদয়ালজিরা যে বিষবৃক্ষ রোপণ করে গেছেন তা এখন মহীরুহের আকার ধারণ করেছে৷

২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যার যে বীভৎসতা ভারত দেখেছে তা কি কোনও মানুষের কাজ হতে পারে? দীনদয়ালজির সংগঠন আরএসএস এবং তাঁর সৃষ্ট হিন্দু মহাসভার বর্তমান রূপ বিজেপি এই গণহত্যার হোতা৷ বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মের নামে এই পৈশাচিক গণহত্যা কখনও সমর্থন করতে পারতেন?

ভারতের নবজাগরণের শিক্ষা ও চিন্তার বিরোধিতা করেছেন দীনদয়ালজিরা

ভারতের নবজাগরণের যাঁরা প্রাণপুরুষ তাঁরা যথার্থ বলেছিলেন, নতুন সমাজ গড়ে তোলার  জন্য নতুন মানুষ দরকার৷ এই মানুষকে পুরনো সংস্কার ও কূপমণ্ডুকতা থেকে মুক্ত হতে হবে৷ নতুন ও উন্নত চিন্তার ভিত্তিতে নিজের মননকে গড়ে তুলতে হবে৷ এই জন্য দরকার ‘ইউরোপীয় আকর থেকে জ্ঞানবিদ্যা সংগ্রহ করা’৷ এবং তা সম্ভব যদি ইংরেজি ভাষায় নিজেদের সুশিক্ষিত করা যায়৷ নিজে সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন রাজা রামমোহন রায়৷ কিন্তু তিনি ইংরেজি ভাষা শিক্ষার উপর সবিশেষ গুরুত্বআরোপ করেছিলেন৷ বিদ্যাসাগর বলেছেন, ‘‘সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের যদি ইংরেজি সাহিত্যের সাথে পরিচিত করানো হয়, তা হলেই তারা বাংলা সাহিত্যের সর্বোত্তম ও যোগ্যতম স্রষ্টা বলে প্রমাণিত হবেন ’’ (নোটস অন সংস্কৃত কলেজ, এপ্রিল–১২, ১৮৫২)৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘‘বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি এবং বাংলা ভাষার ধারা যদি গঙ্গা–যমুনার মতো মিলিয়া যায় তবে বাঙালি শিক্ষার্থীর পক্ষে এটা একটা তীর্থস্থান হইবে৷ দুই স্রোতের সাদা এবং কালো রেখার বিভাগ থাকিবে বটে, কিন্তু তারা একসঙ্গে বহিয়া চলিবে৷ ইহাতেই দেশের শিক্ষা যথার্থ বিস্তীর্ণ হইবে, গভীর হইবে, সত্য হইয়া উঠিবে ’’ (রচনাবলি, ১১ খণ্ড, পৃ : ৬৪৩)৷

কিন্তু পণ্ডিত দীনদয়াল হেঁটেছেন একেবারে উল্টোপথে৷ তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেননি, লড়াই করেছেন ইংরেজি ভাষার বিরুদ্ধে৷ বুক ফুলিয়ে বলেছেন, ‘‘ইংরেজি ভাষা তাড়াতে পারলে আমাদের জাতীয় মর্যাদা রক্ষিত হবে৷’’ বলেছেন, ‘‘যদি ইংরেজি ভাষা থেকে যায়, তা হলে কোনও ভারতীয় ভাষাই বিকশিত হবে না৷’’  ব্যাপারটা বুঝুন, ভাষা বিকাশের বিজ্ঞানের তিনি কোনও তোয়াক্কাই করলেন না, ইংরেজি বিদায়ের সাথে সাথে তো বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন হয়ে যাবে, আর তার ফলে তো ভারতীয় ভাষাগুলোর বিকাশ এবং সেই অর্থে হিন্দি ভাষা বিকাশের  প্রক্রিয়াও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে তা হলে? দীনদয়ালজির কথা হল, বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয় হোক,  কিন্তু ইংরেজি ভাষাকে তাড়াতে হবে৷ চমকে উঠবেন না, দীনদয়ালজি সত্যিই এমন কথা বলেছেন তাঁর ভাষায়, ‘‘ইভেন অ্যাট দ্য রিস্ক্ অফ লুজিং অ্যাক্সেস টু মডার্ন সায়েন্টিফিক নলেজ, উই শুড ফ্রি আওয়ারসেলভস ফ্রম দ্য ক্লাচেস অফ দিজ ফরেন টাং৷’’ অর্থাৎ, আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাথে সংযোগ হারানোর বিপদ থাকলেও এই বিদেশি ভাষার খপ্পর থেকে আমাদের নিজেদের মুক্ত করা উচিত৷ (উপরের উদ্ধৃতিগুলো সুধাকর রাজে সম্পাদিত ‘পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়, এ প্রোফাইল’ গ্রন্থ থেকে গৃহীত)৷ কোথাও অস্পষ্টতা নেই৷ নাই বা রইল বিজ্ঞান, নাই বা রইল আধুনিক জ্ঞান– সনাতন ধর্ম থাকবে তো’ রাম নাম সত্য হ্যায়’ বলতে বলতে কিশোরী বধূকে স্বামীর সাথে চিতায় তুলে পুড়িয়ে মারা যাবে তো এ হলেই তো চলে যাবে৷ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ঝামেলার দরকার কী?

দীনদয়ালজীরা এইভাবে অন্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিন্তু উগ্র ও যুক্তিহীন এক প্রজাতি সৃষ্টির নিদান দিয়ে গেছেন৷ ভারতবর্ষের পুঁজিবাদ এখন এই নিদান আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে৷ এই পুঁজিবাদ সংকটগ্রস্ত–সংকট তার ভিতরে, বাইরে, সর্বত্র৷ সংকট তার অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে, শিল্প–সাহিত্য–সংস্কৃতিতে, সংকট তার জীবনবোধে৷ সভ্যতাকে সে আর কিছু দিতে পারে না, দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই৷ মানুষের চরিত্র হনন করেই তার টিঁকে থাকার চেষ্টা৷ তাই মহান মনীষীদের সে ভুলিয়ে দিতে চায়, আবার এমন মানুষদের সে সামনে আনতে চায় যারা সভ্যতা হননের কাজে তার সহযোগী হতে পারবে৷ দীনদয়ালজির ‘মহামানব’ ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টার মধ্য দিয়ে বিজেপি ভারতীয় পুঁজিবাদের সেই আকাঙক্ষাকেই বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু এই চেষ্টা ভারতের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণ সফল হতে দিতে পারে না৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ২৯ সংখ্যা)