Breaking News

বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ওপর নতুন আক্রমণ আন্দোলনে অ্যাবেকা

বিপুল চার্জবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের বিক্ষোভ। মেদিনীপুর। ২৫ আগস্ট

রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানি ব্যাপক হারে ফিক্সড চার্জ ও মিনিমাম চার্জ বাড়িয়েছে। ফলে গৃহস্থ ও বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ গ্রাহকদের কেভিএ প্রতি প্রায় তিনগুণ মিনিমাম চার্জের বিল এসেছে। ক্ষুদ্র শিল্প গ্রাহকদের এতদিন মিনিমাম চার্জ দিতে হত না। এখন তাদের প্রতি কেভিএ প্রতি মাসে ২০০ টাকা করে দিতে হবে। কৃষি গ্রাহকদের এতদিন মিনিমাম চার্জ দিতে হত না। তাদের এখন প্রতি কেভিএ প্রতি মাসে ৭৫ টাকা করে দিতে হবে। যে সকল গ্রাহক মিনিমাম চার্জের বাইরে তাদের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হারে প্রতি কেভিএ প্রতি মাসের হিসাবে বিশাল অঙ্কের ফিক্সড চার্জের বিল আসছে। কানেক্টেড লোড ৫০ কেভিএ পর্যন্ত ডিসকানেকশন-রিকানেকশন চার্জ ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হয়েছে।

‘বিদ্যুৎ আইন ২০০৩’ ও তার ‘সংশোধনী বিল ২০২২’ এর বাস্তবায়নে স্মার্ট প্রিপেড মিটার লাগানো এবং টিওডি (টাইম অব ডে) সিস্টেমে বিল করার হুলিয়া জারি করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। এই বিল এখনও সংসদে পাশ করে আইনে পরিণত হয়নি। কিন্তু লক্ষ করা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সাথে পশ্চিমবঙ্গেও এই মিটার বসানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। প্রায় সমস্ত ব্লকে ক্ষুদ্রশিল্পে, দোকানে, বাড়িতে সার্ভে করা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্যুৎ রুল ২০২২ ও ২০২৩ জারি করে জানিয়েছে, দেশের সমস্ত বিদ্যুৎ গ্রাহকদের স্মার্ট প্রিপেড মিটার ও টিওডি সিস্টেমে বিল করতে হবে। বিদ্যুৎগ্রাহক সংগঠন অ্যাবেকার সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বিশ্বাস বলেন, স্মার্টলি টাকা লুঠ করার যন্ত্র হল স্মার্ট প্রিপেড মিটার। তিনি বলেন, বর্তমানে যে ডিজিটাল মিটার গ্রাহকদের আছে তাতে খুবই সুক্ষ্মভাবে বিদ্যুৎ খরচ পরিমাপ করা সম্ভব। এই মিটারের রিডিং দেখতে মিটার রিডার প্রয়োজন, লাইন ডিসকানেকশন-রিকানেকশনের জন্য মানুষের প্রয়োজন হয়। বিদ্যুৎ ব্যবহারের পর তার বিল হাতে পান গ্রাহকরা। বিলের টাকা জমা দেওয়ার নির্দিষ্ট দিনের পরও বিদ্যুৎ সংযোগ বজায় রেখে টাকা জমা দিতে পারেন গ্রাহকরা। মিটার খারাপ হলে, সেটা পরিবর্তনের জন্য গ্রাহকরা আবেদন করতে পারেন। সরকার এখন এই ডিজিটাল মিটার পাল্টে স্মার্ট মিটার বসাতে চাইছে। কার স্বার্থে?

স্মার্ট মিটারের ক্ষেত্রে মিটার রিডিং নিতে কোনও মানুষের প্রয়োজন নেই। লাইন কাটতে ও জুড়তেও লোক লাগবে না। গ্রাহকদের হাতে বিলের কাগজ দিতে কেউ আসবে না। সবটা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এ আই) নিয়ন্ত্রিত। অফিসে কম্পিউটারে একজন কর্মচারী বসে রিমোট কন্ট্রোলে একটা গ্রুপ সাপ্লাইয়ের সমস্ত গ্রাহকের মিটার ব্যবস্থা পরিচালনা করতে পারবে। এই স্মার্ট মিটারে পোস্ট পেড বিল, প্রিপেড বিল, টিওডি সিস্টেমের বিলের ব্যবস্থা আছে। গ্রাহকের টাকা শেষ হলে অটোমেটিক্যালি লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আবার টাকা জমা দিলে লাইন জুড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। পোস্ট পেড গ্রাহকরা এক মাসের পর মোবাইলে এসএমএস পাবেন, কত টাকার বিল এবং কত তারিখের মধ্যে টাকা জমা দিতে হবে। সেই দিনের মধ্যে টাকা না দিতে পারলে অটোমেটিক্যালি বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবে। প্রিপেড হলে আগে টাকা দিতে হবে, তারপর বিদ্যুৎ সংযোগ হবে, টাকা শেষ হলেই লাইন ডিসকানেক্ট হবে।

এই নয়া ব্যবস্থায় গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী ৮০ শতাংশ গরিব মানুষ, বিশেষ করে কৃষকরা পড়বেন গভীর সংকটে। কারণ অগ্রিম টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ কিনে ফসল ফলিয়ে সেই ফসলের দাম পেতে তাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে। শহরের মানুষেরও ভোগান্তির শেষ থাকবে না। আর এই ব্যবস্থার সবটা যন্ত্রনির্ভর বলে ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই হবে। ভবিষ্যতে নতুন করে কর্মসংস্থানের কোনও সম্ভাবনাই থাকবে না। মুনাফা সর্বোচ্চ করার জন্য এভাবে গ্রাহকদের স্মার্ট মিটার ব্যবহারে বাধ্য করা হচ্ছে। মিটার খারাপ হলে বা খারাপ মিটারের বিল গ্রাহকরা সংশোধন করাতে পারবেন কিনা সেটা ভবিষ্যতই বলবে। বাস্তবে গ্রাহকদের হাতে তো কোনও রেডি ডকুমেন্ট থাকছে না। এই পদ্ধতিতে গ্রাহকদের যথেচ্ছ লুঠ করার আশঙ্কা রয়েছে। বিদ্যুৎ আইন ২০০৩ এর ৫৬ নং ধারা মতে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হলে কোম্পানিকে কমপক্ষে ১৫ দিন আগে নোটিশ দিতে হয়। এই স্মার্ট মিটারের টাকা শেষ হলে অটোমেটিক বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবে, যা বিদ্যুৎ আইন ২০০৩-এরও বিরোধী। গ্রাহকদের প্রশ্ন, এখন যে সিকিউরিটি ডিপোজিটের টাকা কোম্পানির ঘরে জমা আছে সেই টাকার কী হবে?

বিদ্যুৎ গ্রাহকদের অবরোধ। বালুরঘাট

সরকার বিদ্যুৎ পরিষেবা দেওয়ার দায়িত্ব অস্বীকার করছে

রাজ্য সরকার কেন এত দ্রুততার সাথে কেন্দ্রের জনবিরোধী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নেমে পড়েছে? কার স্বার্থে কোটি কোটি টাকার ডিজিটাল মিটারগুলোকে ডাস্টবিনে ফেলে নষ্ট কর়ে আবার কোটি কোটি টাকা খরচ করে স্মার্ট মিটার বসাতে চাইছে? বর্তমান মিটারগুলির খরচ গ্রাহকদের মাশুলের মাধ্যমে আদায় করা হয়েছে এবং এবারের স্মার্ট মিটারের সমস্ত খরচও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের পকেট কেটে আদায় করা হবে। এই প্রিপেড স্মার্ট মিটার ব্যবস্থা রাজ্য সরকারের অধীনস্থ বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানিগুলোকে ব্যক্তি পুঁজিপতিদের হাতে সমর্পণ করাতে গতি আনবে এবং এর মাধ্যমে সহজেই বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণ করা যাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী বিদ্যুৎ বিল ২০২২ অনুসারে বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানির অধীনে সাব ডিস্ট্রিবিউটর (যাদের কোনও লাইসেন্স লাগবে না) যারা গ্রাহকদের নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে মেরামতি সমস্ত দায়িত্বে থাকবে। সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির কোনও কাজই থাকবে না। সরকার হাত গুটিয়ে নেবে জনগণকে বিদ্যুতের মতো পরিষেবা দেওয়ার দায়িত্ব থেকে।

জনগণকে আরও বেশি করে শোষণের নয়া ব্যবস্থা টিওডি সিস্টেম। টিওডি অর্থাৎ টাইম অব ডে সিস্টেমে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য বেশি বিল হবে। যেমন, দিনের বেলা ১০-২০ শতাংশ দাম কম থাকবে, যখন গৃহস্থ গ্রাহকরা বাড়ির বাইরে কর্মক্ষেত্রে থাকে। আর বিকেলে বাড়ি ফিরে বিশ্রামের সময়, ছেলে-মেয়েদের পড়ার সময় বা রাতে যখন একটানা বিদ্যুৎ ব্যবহার করতেই হয় তখন তাকে ১০-২০ শতাংশ বেশি দামে বিদ্যুৎ নিতে হবে। একইভাবে বাণিজ্যিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে যখন সন্ধ্যায় তার প্রতিষ্ঠানে আলোকিত করার জন্য বেশি বিদ্যুৎ প্রয়োজন, তখন তাকে বেশি দামে বিদ্যুৎ নিতে হবে। ক্ষুদ্রশিল্প সকাল-বিকেল সাধারণত দুটো শিফটে চলে। তারা বেশি দামে বিদ্যুতের কারণে বিকেলের শিফট বন্ধ করতে বাধ্য হবে, যার ফলে উৎপাদন কমবে, সাথে সাথে বেকার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে সর্বস্তরের সাধারণ গ্রাহক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের ২০২৩-২৪ বর্ষের ঘোষিত ট্যারিফ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানি পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সাথে সাথেই রাজ্যের সর্বত্র বিদ্যুৎ গ্রাহক সংগঠন অ্যাবেকার নেতৃত্বে এক সপ্তাহব্যাপী গ্রাহক বিক্ষোভের চাপে রাজ্য সরকারের মৌখিক নির্দেশে বাড়তি টাকা নেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছিল। অ্যাবেকা তখনই বলেছিল এই অপচেষ্টা যে কোনও সময় পুনরায় চালু হতে পারে। পঞ্চায়েত নির্বাচন শেষ হতেই আবার ওই জনবিরোধী ট্যারিফ অর্ডার কার্যকর করা শুরু হয়েছে।

রাজ্য সরকারের অধিকার আছে কেন্দ্রের এই ভয়ানক জনবিরোধী পদক্ষেপ কার্যকর না করার, কারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ তালিকাভুক্ত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রকেই অনুসরণ করে ইতিমধ্যেই ৩৭ লক্ষ স্মার্ট মিটার কিনে লাগানোর তোড়জোড় করছে। অন্যদিকে ফিক্সড চার্জ, মিনিমাম চার্জ, ডিসকানেকশন-রিকানেকশন চার্জ ভয়ানকভাবে বৃদ্ধির ট্যারিফ অর্ডার, (যা রাজ্য সরকার চাইলে বিদ্যুৎ আইন ২০০৩ এর ১০৮ নং ধারা প্রয়োগ করে বাতিল করতে পারে) এর আক্রমণ। ঘটনাক্রম থেকে স্পষ্ট, জনগণের ঘাড়ে আরও বোঝা চাপিয়ে তাদের শোষণ করার ক্ষেত্রে কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের কোনও ফারাক নেই। পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষায় জনস্বার্থকে বলি দিতে শাসক দলগুলির সকলেই সমান দক্ষ।

বিদ্যুৎ গ্রাহক সংগঠন অ্যাবেকার আহ্বানে শুরু হয়েছে স্মার্ট মিটারের বিরুদ্ধে, টিওডি সিস্টেম বিলের বিরুদ্ধে, ফিক্সড চার্জ দ্বিগুণ করা, মিনিমাম চার্জ তিনগুণ করা, ডিসি আরসি চার্জ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার আন্দোলন। পাড়ায় পাড়ায় গ্রাহক প্রতিরোধ কমিটি তৈরি করে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে রাজ্যের সর্বত্র। রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানির বিভিন্ন অফিসে চলছে গ্রাহকদের অবস্থান, বিক্ষোভ, ডেপুটেশন, পথসভা, স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান।

গোয়েঙ্কার মালিকানাধীন বেসরকারি কোম্পানি সিইএসসি-র বিদ্যুৎ গ্রাহকরা গত কয়েক মাস ধরে এক অদ্ভূত ধরনের বিদ্যুৎ বিল পাচ্ছেন। সেই বিলে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের ইলেকট্রিসিটি রুল ২০২২ অনুসারে সিইএসসি কর্তৃপক্ষ এফপিপিএএস নামে একটি বিশাল অঙ্কের টাকার হিসাব দেখিয়ে বলছে, এখন সে টাকা দিতে হবে না। অর্থাৎ রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের নির্দেশ পেলে বকেয়া সহ গ্রাহকদের কাছ থেকে তা আদায় করবে। এই এফপিপিএএস-এর হিসাবেও রয়েছে বিচিত্র ব্যাপার। এক এক মাসে শতকরা হারের অঙ্ক এক এক রকম। কোনও মাসে ৭.৫ শতাংশ, কোনও মাসে ১৫.৫ শতাংশ। আতঙ্কিত সিইএসসি-র গ্রাহকরা এর বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ সহ আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করেছেন।

বিদ্যুৎ গ্রাহকরা এই মারাত্মক আক্রমণ নীরবে মেনে নিতে রাজি নন। সর্বত্রই তাই প্রবল বিক্ষোভে ফুঁসছেন তাঁরা। আক্রমণ প্রতিরোধ করতে গড়ে তুলছেন আন্দোলনের হাতিয়ার বিদ্যুৎ গ্রাহক সংগঠন অ্যাবেকার নেতৃত্বে গ্রাহক প্রতিরোধ কমিটি।