বাংলার যে আন্দোলন ভারতীয় জাতিসত্তার বিকাশে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি দিনই হোক ‘বঙ্গ দিবস’, সর্বদলীয় বৈঠকে এস ইউ সি আই (সি)

কোন দিনটিকে ‘বঙ্গ দিবস’ হিসাবে পালন করা হবে তা নির্ধারণের জন্য রাজ্য সরকার ২৯ আগস্ট সর্বদলীয় সভা ডাকে। সভায় দলের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অমিতাভ চট্টোপাধ্যায় ও রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ডাঃ তরুণ মণ্ডল। বৈঠকে তাঁরা দলের লিখিত বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যটি এখানে প্রকাশ করা হল।

বঙ্গ দিবস পালন করার দিন নির্ধারণের বিষয়ে এই সর্বদলীয় সভার আহ্বান করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। দিনটি যদি আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তা হলে এই সভা হবে অর্থহীন। আশা করতে পারি, তা নিশ্চয়ই নয়। এটা ধরে নিয়ে আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কথা বলতে চাই।

আমাদের দলের বক্তব্য, আমরা ভারতবর্ষের ভারতীয় জাতিসত্তার মধ্যেই এক অঙ্গরাজ্যে বসবাসকারী নাগরিক। তাই বঙ্গ দিবস নির্ধারণ বা পালন যেন কোনও ভাবেই ভারতীয় জাতিসত্তার বিকল্প সত্তা হিসাবে না দেখা দেয়। তা হলে তা দেশের জনগণের ঐক্য বিঘ্নিত করবে। এ কথা আমাদের কাছে গৌরবের যে, বাংলার গৌরব ভারতবর্ষের গৌরবগাথার পৃষ্ঠভূমি তথা ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল। রাজা রামমোহন রায়ের উন্মেষের মধ্য দিয়ে আধুনিক কালের নবজাগরণের সেই গৌরবের সূচনা। তাই বঙ্গ দিবস নির্ধারণ তারই সাথে সম্পৃক্ত হওয়া অবশ্যই বাঞ্ছনীয়।

কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশ অনুসারে ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের উৎসব পালন হয় নাচ গান ইত্যাদির মাধ্যমে। অথচ, ওই দিনটির সাথে যুক্ত ছিল দেশভাগের বীভৎস স্মৃতি, তার রক্তাক্ত অধ্যায়, অগণিত মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার ব্যথা-বেদনা। এটি ছিল প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভেদমূলক রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষাক্ত মানসিকতাকে উস্কানির উদ্দেশ্যেই এই কর্মসূচি। দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সঙ্গে আমরাও তার নিন্দা না করে পারিনি। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় সরকারে অধিষ্ঠিত দলের পূর্বসূরীরা দ্বিজাতি তত্ত্বের নাম করে দেশভাগের পরিকল্পনাকে রূপ দিতে সাহায্য করেছে। এটাই ইতিহাস। হিন্দু মহাসভা মুসলিম লিগ সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত দল এই দ্বিজাতি তত্তে্বর সমর্থক হিসাবে ভূমিকা পালন করেছে। ব্রিটিশের উদ্দেশ্যকে সফল করতে সাহায্য করেছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন তার ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির অঙ্গ হিসেবে বাংলাকে ভাগ করতে চেয়েছিল। বলেছিল এটা সেটলড ফ্যাক্ট, বাতিল হবে না। বিপরীতে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মঞ্চ থেকে ডঃ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী বলেছিলেন, আমরা এটাকে আনসেটল করব। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯০৮ সালে পাবনায় বেদনাহত চিত্তে তিনি বলেছিলেন, বঙ্গবিভাগের জন্য সমস্ত বাংলাদেশ যেমন বেদনা অনুভব করিয়াছে এবং যেমন দারুণ দুঃখভোগের দ্বারা প্রকাশ করিয়াছে ভারতবর্ষে এমন বোধহয় আর কখনও হয় নাই। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার বাংলার গৌরবকে পদদলিত করতে চেয়েছিল। আর তার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ রাখিবন্ধনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হন। তাঁর সেই গান ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গোটা বাংলাকে আন্দোলিত করেছিল। এজরা পাউন্ড বলেছিলেন, এই একটি গানই আন্দোলন গড়ে তুলেছে। বঙ্গ দিবস নির্ধারণ যদি করতেই হয় তা হলে তাই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসের দ্বারা সম্পৃক্ত একটি দিনকে নির্ধারণ করা উচিত। এই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বাংলার সীমানা অতিক্রম করেছিল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছিল। মহাত্মা গান্ধী, লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক, মহামতি গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের তরঙ্গ সৃষ্টিকারী হিসাবে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। অর্থাৎ, বাংলার আন্দোলন ভারতীয় জাতিসত্তার বিকাশের ভিত্তি রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।

ফলে, রবীন্দ্রনাথ সহ বাংলা এবং দেশের মনীষীদের সঙ্গে যুক্ত বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন সেদিন সফল হয়েছিল, ডঃ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর কথায় কার্জনের বাংলা ভাগের সেটলড ফ্যাক্ট আনসেটলড হয়েছিল অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকারকে মাথা নত করে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছিল। বাংলার যে আন্দোলন সফলতার দ্বারা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছিল, ভারতীয় জাতিসত্তার বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল সেই ১২ ডিসেম্বরকেই (১৩১৮-র ২৫ অগ্রহায়ণ) একমাত্র বঙ্গদিবস হিসাবে পালন করা যেতে পারে।