বহুজাতিক লুটেরাদের হাতে খাদ্যপণ্যকে তুলে দেওয়ার সরকারি নীতির পরিণামেই লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি

মূল্যবৃদ্ধির আগুনে রীতিমতো জ্বলছে মানুষ। বিশেষ করে কাঁচালঙ্কা, টম্যাটো, আদা সহ শাকসবজির দাম আকাশ ছুঁয়েছে। কেন এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি? সরকার বলছে, প্রতিকূল আবহাওয়াই এর জন্য দায়ী।

কিন্তু এ কথা বলে সরকার রেহাই পেতে পারে কি? শুধু তো শাকসবজি নয়, চাল-গম-ডাল-মাছ-ডিম সহ সমস্ত খাদ্যপণ্যেরই দাম অনেকখানি বেড়েছে। অন্যদিকে ভয়ঙ্কর হারে বেড়েছে গ্যাসের দাম। এর পিছনে তো প্রকৃতির খামখেয়ালকে দায়ী করা চলে না!

আসলে যা হোক কিছু কারণ খাড়া করে মূল্যবৃদ্ধির দায় এড়াতে চাইছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়েই। তাহলে কি যত দিন যাবে, ততই সাধারণ মানুষ আরও বেশি করে মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার হতে থাকবে? সংসার চালাতে কি আরও বেশি করে ওষুধের খরচ কমিয়ে, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা খরচ কাটছাঁট করে মূল্যবৃদ্ধির আগুনে বিসর্জন দিতে থাকবে বহু কষ্টে উপার্জন করা টাকাটুকু?

আগে একটা কথা অনেকেই ঠাট্টাচ্ছলে বলত, একদিন আসবে যখন টাকার থলেটা বড়, আর বাজারের থলেটা ছোট হবে। সেদিন এসে গেছে। এখন গোটা বাজার ঘুরে পকেট পুরো ফাঁকা হয়ে গেলেও বাজারের থলের অর্ধেকও ভরে না।

দেশে কেন্দ্রে-রাজ্যে নির্বাচিত সরকার রয়েছে, শত শত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন, মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধে তাদের ভূমিকা কী? মানুষ যখন মূল্যবৃদ্ধিতে পুড়ছে, তখন তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখে একটি কথাও শোনা যাচ্ছে না। যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে চলেছে চড়চড় করে, খাদ্যের অভাবে এবং অপুষ্টিতে যখন বছরে শুধু তিন লাখের বেশি শিশুই মারা যাচ্ছে, সেই সময় প্রধানমন্ত্রী আমেরিকায় গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে কোলাকুলিতে ব্যস্ত। এই সময়েই ভারত বিশ্বের ১২১টি দেশের মধ্যে ১০৭তম স্থান পেয়ে ক্ষুধা তালিকাকে ‘অলঙ্কৃত’ করছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তার সরকার মূল্যবৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, বেলাগাম হতে দেয়নি। কেমন নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন তারা? দেশে গত পাঁচ বছরে চালের দাম বৃদ্ধির হার ৩২.২ শতাংশ, গমের দামবৃদ্ধির হার ৩৬.২ শতাংশ, ডালের ক্ষেত্রে বেড়েছে ৮৪.৮ শতাংশ (দ্য হিন্দু-২৯ জুন,২০২৩)। অন্যান্য সব খাদ্যদ্রব্য, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দামও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।

স্বভাবতই সরকারের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ মানুষ। সমালোচনার সামনে পড়ে কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছেন, মোদিজি গোটা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাকে খাদ্যের জোগান দিতে পারবেন। খুব ভাল কথা জয়শঙ্করজি, কিন্তু তার আগে প্রধানমন্ত্রীকে বলুন, যাতে তিনি খাদ্যদ্রব্যের দাম কমানোর জন্য ব্যবস্থা নিয়ে দেশের মানুষের জন্য দু’বেলা পেটভরা খাবার জোটানোর ব্যবস্থা করেন।

কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রক ২৩ জুন ঘোষণা করেছে, দাম কমাতে সরকার খোলাবাজারে ৫ লক্ষ টন চাল ও ৪ লক্ষ টন গম ছাড়বে। কিন্তু সেগুলি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে তো? তার জন্য সরকার কি উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে? না হলে তো তা কালোবাজারিদের পেটই আরও মোটা করবে। সরকার সাধারণ মানুষের দুরবস্থার কথা ভাবলে তো তাদের হাতেই এই চাল-গম তুলে দিতে পারত। কেন্দ্রীয় ভাবে সারা দেশে যে রেশন ব্যবস্থা রয়েছে, তার মাধ্যমে বিনামূল্যে পৌঁছে দিতে পারত গ্রাহকদের কাছে। সেই ব্যবস্থাকে ক্রমাগত দুর্বল করে দিয়ে খোলাবাজারে এগুলি ছাড়া মানে তো গরিবের অন্নকে খাদ্যদ্রব্যের একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের হাতে মুনাফার পণ্য করে দেওয়া। কারণ, ব্যবসায়ীরা সরকারি গুদামের চাল-গম নিজেদের হেফাজতে মজুত করে যে কোনও দামে বাজারে বিক্রি করার ছাড়পত্র পাবে। চড়া দাম দিয়ে তা কিনতে হবে সাধারণ মানুষকে।

খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ে কখন? প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বা কোনও কারণে উৎপাদন কম হলে কিংবা উৎপাদিত দ্রব্য সাধারণ মানুষের হাত পর্যন্ত না এসে বড় ব্যবসায়ীদের হাতে মজুত হলে। সরকার যতই খারাপ আবহাওয়ার দোহাই দিক, এবারে বড়সড় কোনও বিপর্যয় ঘটেনি। চাল-গমের উৎপাদনও বেশ ভালো। চাল উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় ভারতে ২০২২-২৩-এ চাল উৎপন্ন হয়েছে ১,৩০৮.৩৭ লক্ষ টন, গত বছরের থেকে ১৩.৬৫ লক্ষ টন বেশি। আবার ভারতের মধ্যে ধান উৎপাদনে সর্বোচ্চ স্থান পশ্চিমবঙ্গের। দেশে গম উৎপাদন হয়েছে ১,১২৭.৪ লক্ষ টন, গত বছরের থেকে ৫০ লক্ষ টন বেশি। এখন এফসিআই গুদামে চাল রয়েছে ন্যূনতম প্রয়োজনের অতিরিক্ত ২৯২ লক্ষ টন, গম ৮৭ লক্ষ টন। অথচ দেশে নাকি খাদ্যসম্পদের অভাব! দেশের মানুষের প্রয়োজন মেটানোর মতো যথেষ্ট শাক-সবজিও উৎপাদিত হচ্ছে।

উৎপাদনে এত প্রাচুর্য সত্ত্বেও ব্যাপক হারে মূল্যবৃদ্ধি হয়ে চলেছে কেন? বাস্তবে খাদ্যদ্রব্যের বাজারে সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। বহুজাতিক পুঁজিপতিরাই এখন মজুতদারি-কালোবাজারি করে। এরাই খাদ্যদ্রব্যের গোটা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কোন ফসল ফললে বেশি লাভ হবে, তাতে কোন কোম্পানির বীজ-সার-কীটনাশক ব্যবহৃত হবে, সেচ থেকে ফসল তোলা এবং তা মজুত, বিক্রির বন্দোবস্ত–সব কিছু এদের নিয়ন্ত্রণে। দীর্ঘদিন থেকেই খাদ্য উৎপাদন, মজুত এবং পরিবহনের মতো ক্ষেত্রগুলির দখল নিয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি। তাদের পিছনে সব রকমের মদত নিয়ে দাঁড়িয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। এ ক্ষেত্রে আদানিরাই সবার থেকে এগিয়ে। ২০০৫-এর ‘আদানি এগ্রি লজিস্টিক লিমিটেড’ থেকে সাম্রাজ্য বিস্তার করে ২০১৮-১৯-এ আদানিরা তৈরি করেছে ‘আদানি পোর্ট অ্যান্ড স্পেশাল ইকনমিক জোন’। অর্থাৎ শুধু শস্য মজুতদারি করেই লুটেরাদের পেট ভরছে না, তারা খাদ্যপরিবহন এবং চালানের ব্যবসারও দখল নেওয়ার সুবন্দোবস্ত করে ফেলেছে। এমনকি হিমাচলপ্রদেশে আপেল উৎপাদনের একচেটিয়া ব্যবসাতেও ঢুকে পড়েছে আদানিরা। অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলিও পিছিয়ে নেই। সরকার-পুঁজিপতি সম্পর্ক আজ এতটাই নগ্ন যে, এই লুটেরাদের স্বার্থে কেন্দে্রর বিজেপি সরকার কোনও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এমনকি আইন বদলে দিয়ে দেশের অন্যান্য সম্পদের মতো তাদের হাতে খাদ্যসম্পদও তুলে দিতে দ্বিধা করছে না। এই কারণেই তারা নিয়ে এসেছিল কৃষক স্বার্থবিরোধী কৃষিআইন, দেশব্যাপী কৃষকদের প্রতিরোধে যা ভেস্তে গিয়েছে।

মুনাফার স্বার্থে খাদ্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এই বহুজাতিক পুঁজিপতিরা। একদিকে হিমঘরে শস্য মজুত রেখে সংকটের সময়ে তা বিপুল দামে দেশীয় বাজারে বিক্রি করে, অন্য দিকে বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল মুনাফা লোটে। কে নেই এই লুঠে? আদানি, আম্বানি, বালাজি, পতঞ্জলি এমন বহু কোম্পানিই রয়েছে। এমনকি সরকারি সংস্থা এফসিআই-এর মজুত ভাণ্ডার হিসাবে লক্ষ লক্ষ টন শস্য রেখে সেখান থেকে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করে এই কোম্পানিগুলি। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বিহারে এরকম বহু মজুত ভাণ্ডার রয়েছে আদানি সহ পুঁজিপতি গোষ্ঠীগুলির। সরকার তাদের মুনাফা লোটার গ্যারান্টার হিসেবে কাজ করে। তার বিনিময়ে এই ব্যবসায়ীরা ভোটের সময় কিংবা অন্যান্য সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে মোটা টাকা ভেট দেয়। তাদের সরকারে বসার, টিকে থাকার ব্যবস্থা করে। সরকার বদলালে ক্ষমতাসীন দলের সাথে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের এই নতুন আঁতাত গড়ে ওঠে। এই নীতিহীন লেনদেনে বলি হয় সাধারণ মানুষের স্বার্থ। তাই সরকারি গুদামে লক্ষ লক্ষ টন চাল-গম পচে গেলেও সাধারণ মানুষের মুখে তা পৌঁছয় না। শুধু ভোটের আগে মানুষের সমর্থন পেতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি কখনও ‘প্রধানমন্ত্রী অন্ন যোজনা’, কখনও ‘খাদ্য সুরক্ষা যোজনা’, কখনও ‘খাদ্যসাথী’র মতো প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু চাল-গম মানুষের হাতে গুঁজে দিয়ে তাদের ভোট প্রার্থনা করে।

রাজ্যের তৃণমূল সরকারও মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের এই জেরবার অবস্থায় হাত গুটিয়ে রয়েছে। বাজারে যখন আগুন জ্বলছে, হঠাৎ তখন তড়িঘড়ি বৈঠক ডাকলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি কি মানুষের এই দুরবস্থা জানতেন না? সরকারের টাস্ক ফোর্স, এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ সারা বছর ধরে কী করে? তারা মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী মজুতদার-কালোবাজারিদের ধরতে পারে না? এখন মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের ক্ষোভের আঁচ টের পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে স্বরাষ্ট্রসচিব, কলকাতার পুলিশ কমিশনার, এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ, কৃষি বিপণন-সহ বিভিন্ন দফতরের সচিব এবং ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে টাস্ক ফোর্সের বৈঠক করছেন মুখ্যসচিব। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে বেশ একটা ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ ভাব! তাঁরা ‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে’ নাকি ‘সুফল বাংলা’র স্টল থেকে কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকায় বাজারের থেকে গড়ে প্রতি কেজি ৫-১০ টাকা কম দরে সবজি বিক্রি করবে। প্রশ্ন হল, সুফল বাংলার স্টল থেকে কত জন কিনতে পারবেন? আর সবজির দাম যেখানে ৭০-৮০-১০০ টাকা, সেখানে ৫ বা ১০ টাকা কমে কতটা উপকৃত হবেন সাধারণ মানুষ? শুধু ‘প্রকৃতির মার’-এর দোহাই দিয়ে তারা আর কতদিন সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝাবেন?

সাধারণ মানুষের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ববোধ থাকলে ক্ষমতাসীন দলগুলি এটা করতে পারত না। আসলে কেন্দ্রে-রাজ্যে আসীন ক্ষমতাসীন দলগুলি যতই গরিব দরদের কথা বলুক, তারা আসলে পুঁজিপতি শ্রেণিরই স্বার্থ দেখার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। পুঁজিবাদী এই সমাজের অন্তিমদশায় তা আরও নগ্ন হয়ে উঠেছে। তাই মূল্যবৃদ্ধির আগুনে খাক হয়ে সাধারণ মানুষ এর থেকে নিস্তার চাইলেও পাচ্ছে না। তা পেতে হলে আজ দরকার মূল্যবৃদ্ধির আগুনে জ্বলতে থাকা মানুষের সচেতন ঐক্য। সেই ঐক্য যেমন খাদ্যদ্রব্যের কালোবাজারির বিরুদ্ধে সরব হবে, তেমনই যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের এই অবাধ লুঠের ব্যবস্থা করে দেয় তার বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলবে।