প্রশ্ন করলেই দেশের শত্রু

প্রশ্ন করেছিলেন কোচবিহারের এক এমবিবিএস ছাত্র৷ অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রশ্ন, যা এই সময় হাজারো দেশবাসীর মনে উদয় হয়েছে৷ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন অতিমারিতে মরছে, তখন রামমন্দির প্রতিষ্ঠার কী প্রয়োজন ছিল? সমাজমাধ্যমে এই প্রশ্ন তোলায় তাঁর কপালে জুটেছে প্রহার৷ অভিযুক্ত বিজেপি৷ একই প্রশ্ন তুলে বিজেপি নেতা–কর্মীদের রোষের শিকার হয়েছেন বর্ধমানের গুসকরার একজন৷

প্রশ্নটা কি অযৌক্তিক বলে মনে করেন বিজেপির নেতা–নেত্রীরা? তার উত্তর না দিয়ে কোচবিহার জেলা বিজেপি নেত্রী মারের সমর্থনে সাফাই গেয়েছেন, ‘রামমন্দির সম্পর্কে দেশের মানুষের আবেগ কাজ করছে, তাই ছাত্রটির মন্তব্য অনভিপ্রেত৷’ তা হলে, অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু কি দেশের মানুষের মধ্যে বিন্দুমাত্র আবেগও সৃষ্টি করতে পারবে না? তারা কি এর জন্য বিচলিত হতে পারবেন না? তারা কি সরকারের কাছে এরকম একটা বিপর্যয়ের প্রতিকারের আশা করতে পারেন না? এই প্রশ্নগুলির উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন বিজেপি নেতারা?

দেশের শাসক দল এবং রাজ্যের বিরোধী দল বিজেপির এই স্পর্ধার উৎসটা কী? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ তিনি বলেছেন, রামমন্দির নির্মাণ একটি রাষ্ট্রীয় ভাবনা– যেন জনগণের জন্য স্বাস্থ্য–শিক্ষা–খাদ্য– ব্যবস্থা নয়– রাষ্ট্রের কাজ হল মন্দির নির্মাণ কোন রাষ্ট্র? একটা যুক্তরাষ্ট্র, যা এখনও ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হিসেবে ঘোষিত এবং পরিচিত৷ দেশের প্রধানমন্ত্রীর একের পর এক কর্মকাণ্ড– মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে দু’পায়ে মাড়িয়ে যাওয়া, যে কোনও বিষয়ে যুক্তিযুক্ত দাবি সরকারের পছন্দ না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বা ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া, সংবাদমাধ্যম, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে একমাত্র শাসক বিজেপির মত শুনতে বাধ্য করা– এ সমস্ত করে তিনি ও তাঁর দলের নেতারা এমন এক পরিবেশ তৈরি করছেন– যাতে কেউ সরকারের বিন্দুমাত্র সমালোচনা করতে না পারে৷ বহুগুণে বিকশিত হয়ে তারই ফল ফলছে সর্বত্র৷ স্তরে স্তরে বিজেপি নেতা–কর্মীদের মধ্য দিয়ে তার প্রতিফলন ঘটছে৷

জনসাধারণের সমর্থন সহজেই আদায় করতে মানুষকে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তিহীন, শিক্ষাহীন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে রেখেছে শাসকরা৷ তারা জানে, যুক্তি–বুদ্ধির চর্চা না থাকলে কোনও জনবিরোধী পদক্ষেপ নিয়েই কেউ প্রশ্ন তুলবে না, প্রতিবাদ করবে না৷ তাই প্রশ্ন করলেই তাকে দাবিয়ে দাও, শাসানি–ধমকানি দিয়ে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করো, যাতে প্রতিরোধের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা কোথাও তৈরি না হয়৷ শাসক বিজেপির মতো দেশের অন্যান্য ক্ষমতালোভী দলগুলিও একই কারণে সাধারণ মানুষের প্রশ্নহীন আনুগত্য চায়৷ সেই আনুগত্য না প্রকাশ পেলে বা কোনও বিষয়ে প্রশ্ন করলেই তাই দাগিয়ে দেওয়া হয়– তুমি ‘আমাদের’ নয়, অতএব তুমি দেশের শত্রু৷ জাতীয়তাবাদের জিগির তোলা ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির এই কণ্ঠস্বর দেশে দেশে শোনা গেছে বারবার৷ ইতালি, জার্মানি সহ নানা দেশে ফ্যাসিবাদী শক্তি বারবার মানুষের কণ্ঠ চেপে ধরেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে এর মূল্য চোকাতে হয়েছে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয় অর্জন করতে পারেনি এই ভয়ঙ্কর শক্তিগুলির কেউই৷ যখনই অত্যাচারিত মানুষ সংঘবদ্ধ হয়েছে, তখন এই স্পর্ধিত শক্তিকেও নতজানু হতে হয়েছে ঐক্যবদ্ধ মানুষের প্রতিরোধের সামনে৷ তাদের স্থান হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে৷ ইতিহাস সে কথাই বারে বারে প্রমাণ করেছে৷