পিটিয়ে হত্যাকেও বৈধতা দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে

‘লিঞ্চিং’ অর্থাৎ গণপ্রহারে হত্যা এবং এর মাধ্যমে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি, তাদের সম্বন্ধে ঘৃণার বাতাবরণ সৃষ্টি– এসব নাকি ভারতে হয় না৷ বলে দিয়েছেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত৷ বিজয়া দশমী উপলক্ষে নাগপুরে সংঘের অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তৃতায় এমনই চমকপ্রদ তথ্য জেনেছে ভারত৷ তাঁর মতে লিঞ্চিং হল বাইবেলের বিষয়, এ সব বিদেশে হয়, ভারতের সাথে তার কোনও সম্পর্ক নেই৷

অথচ ২০১২ থেকে ২০১৯–এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গো–রক্ষার অজুহাতে ৮১টি গণপ্রহারের ঘটনাতে ৪৩ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ১৪৪ জন (‘কাউ ভিজিল্যান্টস ভায়োলেন্স ইন ইন্ডিয়া’, উইকিপিডিয়া)৷ এর মধ্যে ৯০ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় বসার পর থেকে (টাইম ডট কম, ২৮ জুন ২০১৯)৷ ২০১৬ থেকে ২০১৯–এর ১৫ জুন পর্যন্ত ভারতে দলিত এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর আক্রমণ এবং হেনস্থার ঘটনা পুলিশে নথিভুক্ত হয়েছে ২০০৮টি৷ এর মধ্যে ৮৬৯টিই বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের ঘটনা (ইন্ডিয়া টুডে, ১৯ জুলাই ২০১৯)৷ বাকি ঘটনাগুলির বেশিরভাগই হরিয়ানা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, ঝাড়খণ্ড, বিহার, মহারাষ্ট্রের মধ্যেই ঘটেছে৷ অর্থাৎ যে রাজ্যগুলিতে বিজেপি এখন রাজত্ব করছে অথবা মাত্র কিছুদিন আগেও করছিল সেই রাজ্যগুলিতেই এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে বেশি৷ এর সাথে যোগ হয়েছে ছেলেধরা, সন্দেহজনক ব্যক্তি, বহিরাগতরা ক্ষতি করতে এসেছে, ধর্ম নষ্ট করছে এমন সব নানা গুজব এবং তার পরিণতিতে গণপ্রহার এমনকি হত্যা৷ এ বিষয়ে কর্নাটক, আসাম, তামিলনাডু এমনকি ইদানিং পশ্চিমবঙ্গের নামও যুক্ত হয়ে গেছে৷

এগুলোর মধ্যে কোন জায়গাটা বিদেশে অবস্থিত মোহন ভাগবতজি দয়া করে জানাবেন কি? তিনি বলেছেন, এই রকম ঘটনা কিছু ঘটলেও তাতে দু’পক্ষেরই দোষ আছে৷ অর্থাৎ তিনি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন হিন্দুত্ববাদীদের সেই পুরনো অজুহাতকে– ক্রিশ্চান, মুসলিম এবং দলিতরা তাদের অভ্যাস, ধর্মাচরণ, সাস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বিশ্বাসগুলি পরিত্যাগ করে হিন্দুত্ববাদীদের কথামতো নিজেদের এক ছাঁচে গড়ে নিক৷ না হলেই মাঝে মাঝে তাদের ‘শিক্ষা’ দেওয়া হবে৷ এতে কিছু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে সরকারি কর্তারা কিছু দুঃখপ্রকাশও করবেন৷ কিন্তু আবার মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে মারায় অভিযুক্ত মারা গেলে তাকে জাতীয় পতাকায় মুড়ে প্রায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করবেন একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী৷ দুধ ব্যবসায়ী পেহলু খানের হত্যায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ এমন করে মামলা সাজাবে যাতে কিছুই প্রমাণ না হয়৷ খুনে অভিযুক্তরা ছাড় পাওয়ার পর সংঘ পরিবার ঘনিষ্ঠ সংগঠনের সদস্যরা প্রকাশ্যে রীতিমতো উৎসব করবে৷ বিহারে স্বঘোষিত গো–রক্ষক বাহিনীর সদস্যরা পিটিয়ে খুন করার পরেও অচিরেই মুক্তি পেয়ে যাবে৷ তাদের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেবেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী৷ গ্রাহাম স্টেনস এবং তাঁর শিশুপুত্রকে পুড়িয়ে মারার প্রধান অভিযুক্ত বিজেপির টিকিটে এমপি হবেন৷ উত্তরপ্রদেশের পুলিশ অফিসার সুবোধ সিংহকে যে স্বঘোষিত গো–রক্ষকরা প্রকাশ্য রাস্তায় হত্যা করল তাদের পাশে দাঁড়াবে রাজ্য সরকার৷ জম্মুর যাযাবর উপজাতির শিশুকন্যাকে ধর্ষণ এবং হত্যার সমর্থনে মিছিল করবে সে রাজ্যের বিজেপি মন্ত্রী থেকে এমএলএ৷

মোহন ভাগবতজি এই প্রসঙ্গে বাইবেলকে টেনে এনে দেশকে স্মরণ করিয়ে দিলেন হিন্দুত্ববাদীদের আইকন বিনায়ক দামোদর সাভারকরের সেই তত্ত্ব– ভারতীয় ভূখণ্ডের বাইরে জন্ম যে সব ধর্মের, তাতে বিশ্বাসীরা ভারতীয় জাতির অংশ নন৷ দেশের মানুষ জানেন, কেমন করে এই দ্বিজাতিতত্ত্ব দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করেছে, দেশের খেটে–খাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ হিন্দু এবং মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদীর সেদিন একে কেন্দ্র করে দুই জাতির কথা তুলেছে, রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা করেছে৷ আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সেই সুযোগে ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করার মারাত্মক খেলা খেলেছে৷ দেশে গেড়ে বসেছে সাম্প্রদায়িক অনৈক্যের বিষবৃক্ষটির শিকড়৷ সেই দ্বিজাতি তত্ত্বকেই হাতিয়ার করে ক্রিশ্চান, মুসলিম শুধু নয় দলিত সম্প্রদায়কেও পায়ের তলায় রাখতে উঠে পড়ে লেগেছে সংঘপরিবারের আদর্শ নিয়ে চলা হিন্দুত্ববাদীরা৷ তাকেই কি তুলে ধরলেন মোহন ভাগবতজি!

লিঞ্চিং শব্দটি প্রথম এসেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর আমেরিকায় চার্লস লিঞ্চের চালু করা ক্রীতদাসদের শাস্তি দেওয়ার জন্য বিচারালয় বহির্ভূত অত্যাচারের ব্যবস্থা থেকে৷ ঊনবিংশ শতাব্দীতে তা দাঁড়িয়ে যায় আমেরিকার আফ্রো–আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে পিটিয়ে শায়েস্তা করার মানসিকতায়৷ শ্বেতাঙ্গ দম্ভের প্রতীক হয়ে ওঠে লিঞ্চিং৷ আজ ভারতেও সংখ্যাগরিষ্ঠের দম্ভকে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে না কি? দেখা যাচ্ছে সংখ্যালঘু এবং দলিতদের উপর অত্যাচার কিংবা হত্যার ঘটনায় প্রশাসন পুরোপুরি হত্যাকারীদের পাশেই দাঁড়াচ্ছে৷ এমনকি বিচার বিভাগকে পর্যন্ত প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে৷ সবচেয়ে উদ্বেগের হল, এই উন্মত্ততা এবং ঘৃণাকেই স্বাভাবিক বলে ভাবতে শুরু করেছেন বেশ কিছু মানুষ৷ কোথাও এমন ঘটনা ঘটলে তার প্রতি ঘৃণা দূরে থাক এটাই যেন হয়ে উঠছে বীরত্বের নিদর্শন৷ এর ফল হচ্ছে বিদ্বেষ এবং ঘৃণা ছড়ানোর অবাস্তব গুজবকেও কিছু লোক সত্য বলে ধরে নিচ্ছে৷ প্রবল উৎসাহে পিটিয়ে মারতে নেমে যাচ্ছে তারা৷ মোহন ভাগবতজি বোঝাতে চেয়েছেন, এই ধরনের হত্যায় সংঘ পরিবারের হাত নেই৷ অতীতেও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি বলেছে এগুলি ‘অনভিপ্রেত’ হলেও সংখ্যালঘুদের অবাধ্যতার কারণে সংখ্যাগুরুর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া৷ বিশিষ্ট সমাজকর্মী এবং শিক্ষক হর্ষ মান্দার প্রশ্ন তুলেছেন, গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসে আরএসএস সদস্য ছিল কি না এ কথা সরাসরি প্রমাণ করা নাও যেতে পারে, কিন্তু যে ঘৃণার মানসিকতায় গডসে এবং এই গো–রক্ষক বাহিনী প্রভাবিত, তা যে সংঘ পরিবার এবং হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির চিন্তাধারারই ফসল, তা কি অস্বীকার করা যায়? (দ্য হিন্দু, ১৬ অক্টোবর ২০১৯)

এই ঘৃণা ও অবিশ্বাসের পরিবেশে এক ধরনের গণ–হিস্টিরিয়া তৈরি করা হচ্ছে৷ আইন ও বিচারের তোয়াক্কা না করে গায়ের জোরেই হিন্দুত্ববাদীদের অ্যাজেন্ডাকে গেলানোর এবং চিন্তা ভাবনা ধ্বংসের অপচেষ্টা চলছে৷দেশপ্রেমিক মানুষের আজ কর্তব্য একদিকে এর বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলা এবং তার মধ্যে ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদায় নির্বিশেষে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, গরিব–মধ্যবিত্তকে টেনে আনা৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১১ সংখ্যা)