পিজি হোস্টেলঃ সিনিয়ররা প্রকৃত অর্থেই জুনিয়রদের পাশে দাঁড়াতেন (পাঠকের মতামত)

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নবাগত ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব়্যাগিংয়ের বিষয়টি এখন আলোচনার শিরোনামে। গণমাধ্যমের বিভিন্ন লেখা, রিপোর্টে অন্যান্য কলেজ, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ব়্যাগিংয়ের ঘটনা উঠে আসছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ শিউরে উঠে ভাবছেন, এই ভয়ঙ্কর জিনিস কি তা হলে চলতেই থাকবে? যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়া উচিত আনন্দের পরিসর, নির্ভরতার জায়গা, সেখানে নবাগত শিক্ষার্থীদের সর্বক্ষণ চলতে হবে অপদস্থ হওয়ার, এমনকি মারাত্মক শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের ভয় নিয়ে? এই প্রসঙ্গে আমার ছাত্রজীবনের কিছু অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া জরুরি মনে হল।

২০০৩-০৪ সালে আইপিজিএমইআর ও এসএসকেএম হাসপাতালে এমবিবিএস কোর্স শুরু হয়। শুরুর পথ মসৃণ ছিল না। তৎকালীন সিপিএম সরকার এনআরআই ক্যাপিটেশন ফি-র নাম করে সরকারি কলেজের সিট অনাবাসী ভারতীয়দের কাছে বিপুল দামে বিক্রি করছিল। তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে ছাত্র আন্দোলন। এআইডিএসও-র নেতৃত্বে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সেই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন জয়লাভ করে।

জয়ী ছাত্রছাত্রীরা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ঠিক করে, ক্যাম্পাসে সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে হবে, ব়্যাগিং সম্পূর্ণ নির্মূল করতে হবে। তৎকালীন শাসক দলের ছাত্র সংগঠন এসএফআই প্রায়শই ‘ইন্টরা’ নাম দিয়ে ব়্যাগিং করার সুযোগ খুঁজত। কিন্তু এআইডিএসও ছাত্র সংগঠন শুধু এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে তাই নয়, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মাধ্যমে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা চালিয়ে গেছে।

কলেজ-হোস্টেলে সুস্থ পরিবেশ ধরে রাখার ধারাবাহিক লড়াইয়ের সাথেই দাবি ওঠে, কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাই এবং প্রায় পাঁচ বছর লাগাতার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ২০০৯ সালে আইপিজিএমইআর ও এসএসকেএম হাসপাতালে প্রথম ছাত্র সংসদ আইপিজিএমইআরএসইউ গড়ে ওঠে। এআইডিএসও-র নেতৃত্বে ছাত্রছাত্রীরা জয়যুক্ত হয়। এই ধারাবাহিকতাতেই ২০০৯-২০১০-২০১১ সালে আইপিজিএমআর-এ পুরো ক্যাম্পাস প্রায় ব়্যাগিংমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল এআইডিএসও পরিচালিত ছাত্র সংসদ। ১০০ শতাংশ না হলেও প্রায় ৯৫ শতাংশ ব়্যাগিংমুক্ত ক্যাম্পাস হিসেবে বিবেচিত হত পিজি হাসপাতাল। যাদবপুরের ঘটনার পর পিজি হাসপাতালের বিভিন্ন প্রাক্তনীর লেখা, ফেসবুক পোস্টেও এই সময়ের সুস্থ, পরিণত ক্যাম্পাসের কথা উঠে এসেছে, যেখানে সিনিয়ররা শুধুমাত্র ব়্যাগিংই আটকাতেন না, প্রকৃত অর্থেই জুনিয়রদের পাশে দাঁড়াতেন। ২০১২ সাল থেকে রাজ্য সরকার নির্বাচন করতে না দেওয়ায় পিজি কলেজ হোস্টেলে পরিবেশ রক্ষার লড়াই কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়, কিন্তু ব়্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে লড়াই জারি থাকে।

আজ ২০২৩ সালে যাদবপুরের ভয়াবহ ঘটনা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব়্যাগিংয়ের অবস্থা দেখে খুব ভারাক্রান্ত হৃদয়ে লিখতে বাধ্য হচ্ছি যে, সেই সময় পিজি হাসপাতাল এবং কলেজ-হোস্টেলকে ব়্যাগিংমুক্ত করার লড়াই আমরা লড়তে পেরেছিলাম একমাত্র নীতি-আদর্শভিত্তিক রাজনীতির চর্চার দ্বারাই।

সেই ভাবেই আজও ক্ষমতার রাজনীতির বৃত্তের বাইরে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক লড়াই গড়ে তোলা জরুরি, যা মনুষ্যত্বের চর্চা করবে, মনকে সংবেদনশীল করবে। একমাত্র এই পথেই ব়্যাগিং নামক ভয়াবহ ব্যাধি দূর করা সম্ভব।

ডাঃ কবিউল হক

কলকাতা -৭০০১০৬