ঘটনাটা বহু আলোচিত। বীরভূমের লাভপুরে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ঋক বাগদি বড় হয়ে বোকা হতে চেয়েছে। আসলে সে চেয়েছে তার বাবার মতো সৎ হতে।
এ সমাজ ঋককে আর কিছু না শেখাক, একটা কথা ছোট থেকে শেখাতে চেয়েছে– ‘সৎ মানে বোকা’। যেমন ধরুন, আজকের ভোট রাজনীতিতে যদি কোনও রাজনৈতিক দল কিংবা প্রার্থী বলেন– আমি মিথ্যা চমক দিয়ে ভোট চাইব না। সত্যকে তুলে ধরব। অনেকেই বলবেন– কি বোকা! অথচ চালাক বলে যাদের তাঁরা ভোট দেন– সেই চালাকরা যে তাঁদেরই ঠকাবে এ কথা কি ভোটারদের অজানা? তবু এটাই দস্তুর। ঋক যেন তাই ব্যতিক্রম।
বর্তমানে লোকসভা ভোটের আবহে সমস্ত ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রীরা যখন মানুষকে বোকা বানিয়েই ভোটযুদ্ধে জেতার মরিয়া চেষ্টা করছেন, তখন ঋকের ‘বোকা’ হতে চাওয়াটা আরও বেশি করে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নীতিগত কোনও ফারাক না থাকলেও এক দলের বিরুদ্ধে আর এক দলের নেতা-নেত্রীদের ছদ্ম-হুঙ্কারে কান পাতা দায়। সারল্য, সততা, বিশ্বাস নামক গুণগুলি যখন এই সব নেতা-নেত্রীদের অভিধান থেকে বিদায় নিয়েছে, তখন এই গ্রাম্য ছেলেটি যে ভাবে সরল বিশ্বাসে সৎ থাকার অভিপ্রায় জানাল, তা একটা উদাহরণ।
চলমান সমাজব্যবস্থায় বহু মানুষই সরল সহজ মানুষকে বোকা ঠাওরায়, বলে ওর দ্বারা কিছু হবে না। যে কোনও উপায়ে, অপরকে ঠকিয়ে কিছু অর্জন করা ব্যক্তিকে যোগ্য মনে করে। লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে তাদের ভাল-মন্দ নির্ধারিত হয়। সেখানে বোকা হতে চাওয়া ঋকের কথা অনেকের মনে দাগ কাটতে না পারলেও আশার আলো দেখছেন অসংখ্য মানুষ– যাঁরা সমাজের রুচি-সংস্কৃতির নিম্নগামিতা দেখে আতঙ্কিত, যাঁরা সততা, মূল্যবোধ এগুলির অভাবকেই সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য দায়ী মনে করেন। যে বাবা-মা নিজ সন্তানকে ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’, ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’-র শিক্ষায় শিক্ষিত করছেন তাঁরাও একটু ভেবে দেখলে বুঝতেন, যে যুবক-যুবতীরা আত্মকেন্দ্রিক জীবন যাপন করতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন, জীবনের কোনও বাঁকে এসে তাদের মনও হয়ত বলে উঠবে– ঋকরাই ছিল ভাল, যারা জীবনে কখনও কাউকে ঠকানোর চেষ্টা করেনি, যারা পারস্পরিক বিশ্বাস ও সততার সেতুতে গড়ে ওঠা সুন্দর একটা সমাজ-জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল।
কিন্তু ঋকের বোকা হতে চাওয়া অর্থাৎ সৎ থাকতে চাওয়া কি একেবারেই দুর্লভ? চারদিকে তাকিয়ে কি আমরা এমন কাউকে দেখতে পাই না, যাঁরা সৎভাবে জীবন যাপন করেন, নিজেদের আচার-আচরণের দ্বারা সততার নজির স্থাপন করেন জনমানসে? একটু চোখ মেলে তাকালেই আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষকেই দেখতে পাওয়া যাবে।
বর্তমান রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রধান ধারাটি অসততা, মিথ্যাচার, দুর্নীতিপরায়ণতা, আস্ফালন প্রদর্শনের হলেও এর পাশাপাশি বিপরীত আর একটি ধারার অস্তিত্ব প্রবল ভাবেই রয়েছে সমাজে। সেটা হল সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর নিপীড়িতের জন্য সংগ্রামের ধারা। যারা মানুষকে ঠকায় না, শোষণ করে না, লুণ্ঠন করে না, মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করে, প্রতারণার বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে, নির্বাচনেও তারা যে কোনও উপায়ে ভোট পাওয়ার কথা ভাবে না।
আসলে সমাজে বেশিরভাগ অসৎ, দুর্নীতিপরায়ণ, ঠগ লোকেদের মধ্যে মুষ্টিমেয় সৎ মানুষকে দেখলে মানুষ অবাক হন, ভাবেন এরা ব্যতিক্রম। তাঁরা ভুলে যান, ব্যতিক্রমটাই সমাজের প্রধান ধারা হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হওয়ার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেন না। শুধু ঋকের মতো কেউ কেউ যখন সততার কথা বলে, তখন তাঁরা খুশি হন। ঋকের এই সরল উক্তি যাদের মনে কিছুটা হলেও আশা জাগিয়েছে, নাড়া দিয়ে গেছে, তাদের বুঝতে হবে– সমাজ অভ্যন্তরে সততা, বিশ্বাসের ভিত্তিতে সুন্দর, সহজ-সরল, অনাবিল আনন্দের মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য যে নতুন সমাজ গড়ে তোলার কাজটি ইতিমধ্যেই এগিয়ে চলেছে, তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়াতেই একমাত্র তাঁদের স্বপ্ন সফল হতে পারে। তাই তাঁদের আজ সিদ্ধান্ত নিতে হবে– সেই শক্তিরই আরও বৃদ্ধিতে সাহায্য করবেন, নাকি বর্তমান সমাজের ঘুণ ধরা চেহারা দেখে হা-হুতাশ করে দিন কাটাবেন!
সংহতি বসু
কলকাতা-১৩