পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি চরম নির্মমতায় স্পষ্ট হল সরকার আসলে কাদের

শেষপর্যন্ত মৃত্যু এসে আঁচল দিয়ে মুছে দিয়েছে কপালের ঘাম। হাত বুলিয়ে দিয়ে গেছে ফোস্কা পড়া পা, খিদে ভরা শুকনো পেট আর ঘরে ফেরার আকুলি বিকুলি মাখা বুকটায়। ফেরা শেষ পর্যন্ত তাঁদের হয়নি– তার বদলে ঘরে পৌঁছেছে মালগাড়ির ধাক্কায় ছিন্ন ভিন্ন শরীরের অংশ। আর রেললাইন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে থেকেছে পোড়া রুটি, তাপ্পি দেওয়া চপ্পল, গামছা, দৈনন্দিনের টুকিটাকি, এমনকি করোনা থেকে বাঁচার সস্তা মাস্কও।

মহারাষ্ট্রের জলনার ইস্পাত কারখানার সেই ১৬ জন দুর্ভাগা শ্রমিকের কথা বলা হচ্ছে যাঁরা মধ্যপ্রদেশের উমারিয়া আর শাহদলে নিজেদের ঘরে ফিরতে চেয়ে হাঁটতে শুরু করেছিলেন রেললাইন ধরে। ঘন্টার পর ঘন্টা হাঁটার ক্লান্তিতে দু’চোখ বুজে এসেছিল। লকডাউনে ট্রেন চলবে না ভেবে শরীরগুলো এলিয়ে দিয়েছিলেন লাইনের ওপর। ভোরের দিকে মালগাড়ি এসে পিষে দিয়ে যায় তাঁদের।

বাকিরা যাঁরা বেঁচে রয়েছেন, দিনের পর দিন অবিরাম হেঁটে চলেছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। মাথায় যথাসর্বস্বের বোঝা নিয়ে, ক্লান্তিতে খিদেয় শুকিয়ে যাওয়া সন্তানের হাত ধরে, স্ত্রী কিংবা অন্য পরিজন-সাথীদের পায়ে পা মিলিয়ে সূর্যের ঝলসানো তাপের নিচে নুয়ে পড়তে চাওয়া শরীরগুলো কোনও রকমে খাড়া রেখে শত শত মাইল হেঁটে চলেছেন লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক।

না হেঁটে উপায় নেই তাঁদের। ২৩ মার্চ চার ঘন্টার নোটিশে লকডাউন জারি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। করোনা বিপর্যয় রোখার নামে ক্রমাগত তার মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এদিকে পেটের দায়ে যে ১০ কোটির কাছাকাছি পরিযায়ী শ্রমিক ঘরবাড়ি ফেলে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে, এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গিয়ে কাজ করেন, তাঁদের কাজকর্ম বন্ধ। মজুরি নেই। হাতে থাকা সামান্য টাকাও শেষ। মালিক বিনা কাজে খাওয়াতে রাজি নয়। বাড়িওয়ালাও ঘরভাড়া না পেলে থাকতে দেবে না। এই অবস্থায় কোনও রকমে নিজের গ্রামে ঘরে না ফিরে করবেন কী তাঁরা? তাই প্রাণ বাঁচানোর আকুল আশায় বুক বেঁধে চলেছে পথ চলা। সঙ্গে পরিমাণ মতো খাবার নেই, জল নেই– কারও বা সম্বল ১৩টা টাকা। একজন পথ হাঁটছেন ১৭ দিনের শিশু বুকে আঁকড়ে। একজন পথের ধুলোতেই জন্ম দিলেন সন্তানের। ঘন্টা দুয়েক বিশ্রাম– তারপর আবার অন্তহীন পথ চলা ধুঁকতে থাকা শরীরটাকে টেনে টেনে। মরছেনও অনেকে– কেউ পথ-দুর্ঘটনায়, কেউ বা দীর্ঘক্ষণ খাবার ও জলের অভাবে ডিহাইড্রেশনের শিকার হয়ে। এই লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১২৪-এরও বেশি।

না, এঁদের কারওরই নাম জানি না আমরা। সরকারের কাছে, প্রশাসনের কাছে এঁরা শুধুই সংখ্যা– নামহীন, মুখহীন শ্রমিকের স্রোত। অথচ এঁদের কাঁধেই ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গোটা উৎপাদন ব্যবস্থা, মন্ত্রী-সান্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের সমস্ত নাগরিকের জীবনচর্যা। একটা দেশের সরকার কতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন ও নিষ্ঠুর হলে লকডাউন জারি করার সময় এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের আসন্ন দুরবস্থার কথা স্রেফ ভুলে যেতে পারে!

নিরুপায় পরিযায়ী শ্রমিকের এই স্রোত আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, শ্রেণিবিভক্ত সমাজের আসল কদাকার চেহারাটা। মেহনতি জনতার প্রতি যে দেশের সরকারের বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধতা নেই, সে কথার স্পষ্ট প্রমাণ দিয়ে গেল। দায়বদ্ধতা নেই বলেই পরিযায়ী শ্রমিকদের দুঃসহ পরিস্থিতি ও একের পর এক মৃত্যুর ঘটনায়় দেশ জুড়ে প্রবল ধিক্কারের মুখে পড়ে এদের ফেরাতে রাজি না থাকা সরকারগুলি শেষপর্যন্ত রাজি হল ট্রেনের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু টিকিটের দাম দেবে কে, তা নিয়ে চলল চাপানউতোর। শেষপর্যন্ত লকডাউনের ৪০ দিন বাদে যখন শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর জন্য ট্রেনের ব্যবস্থা হল, তখন চরম নির্লজ্জের মতো টিকিট ভাড়ার পাই-পয়সা পর্যন্ত দাবি করা হল দুর্গত মানুষগুলিরই কাছে। দাম আদায় করা হল তাঁদের দেওয়া জল ও মাস্কেরও। কিন্তু শ্রমিকরা ফিরে গেলে কারখানা চালু হলে কাজ করবে কে? মালিকরা তাই আবদার ধরল এদের ফেরানো চলবে না। সেই আবদার মেনে নিয়ে কর্ণাটকের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী এক কথায় বাতিল করে দিলেন কোনও রকমে টাকা জোগাড় করে কেনা শ্রমিকদের ফেরার টিকিট। আসলে ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’-এর স্লোগানের হাঁকডাকই সার। এইসব সরকারের আসল দায়বদ্ধতা মালিকদের প্রতি। তাই অবলীলায় এই লকডাউনের সময়েও মকুব হয়ে যায় ঋণখেলাপি দুর্নীতিগ্রস্ত পুঁজিপতিদের ৬৮ হাজার কোটি টাকা, অথচ আটকে পড়া অসহায় পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেনভাড়াটুকু মেটাতে সরকারের ভাঁড়ারে নাকি টান পড়ে! আসলে এ তো শুধু টাকার বিষয় নয়, বাস্তবে এর মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হচ্ছে সরকারের মালিকি দৃষ্টিভঙ্গি। এবং সে দৃষ্টিভঙ্গিতে যে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির কোনও ফারাক নেই, তা প্রথম থেকেই তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে ফুটে বেরিয়েছে। তাই বিদেশে আটকে পড়া ধনী ভারতীয়দের দেশে ফিরিয়ে আনার সময় কেন্দ্রীয় সরকারকে খরচের কথা বলতে শোনা যায়নি। অন্য রাজ্যে আটকে পড়া ধনী পরিবারের সন্তানদের ফিরিয়ে আনার জন্য অবলীলায় বাসের ব্যবস্থা করেছে রাজ্য সরকার। অথচ কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিক ঘরে ফিরবে কী করে, তা নিয়ে মাথা ঘামাতে তারা রাজি নয়। শুধু তাই নয়, আটকে পড়া শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার যে বন্দোবস্ত অল্প ক’দিনের জন্য করেছিল সরকারি প্রশাসন তা-ও ছিল জঘন্য রকমের নিম্নমানের।

শুধু কি এই? করোনা বিপর্যস্ত দেশে লকডাউনে শ্রমিকদের ঘরবন্দি থাকার সুযোগ নিয়ে মালিকদের দেদার মুনাফার বন্দোবস্ত করে দিতে ঠিক এই সময়টিতেই শ্রম-আইন পাল্টে দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। ৮ ঘন্টা থেকে বাড়িয়ে তাঁদের কাজের সময় ১২ ঘন্টা করে দেওয়ার মতলব আঁটছে তারা। ইতিমধ্যেই উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকার আগামী তিন বছরের জন্য সমস্ত শ্রম আইন বাতিল করে দিয়েছে। অর্থাৎ লড়াই করে আদায় করা শ্রমিকদের সমস্ত অধিকার মালিকদের মুনাফার পায়ে জলাঞ্জলি দিয়ে দিল বিজেপি রাজ্য সরকারগুলি।

আর দেশের ৯৩ শতাংশ অসংগঠিত শ্রমিকের জীবনে তো ‘অধিকার’ শব্দটির অস্তিত্বই নেই। পরিযায়ী শ্রমিকরা রয়েছেন এই দলেই। এঁরাই আধুনিক যুগের দাস-শ্রমিক। নিজের ও পরিজনদের প্রাণটুকু টিকিয়ে রাখার জন্য মালিকের বেঁধে দেওয়া শর্তে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘাম ঝরান এঁরা। বাড়ি থেকে দূরে অমানুষিক পরিবেশে পশুর মতো জীবনধারণ এঁদের। সরকারি কর্তাদের চোখে এঁরা মানুষ পদবাচ্য নন। তাই লকডাউন ঘোষণার সময়, এঁদের পরিণতি কী হবে, সে কথা মনেও পড়ে না পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস, তাদের ‘পলিটিকাল ম্যানেজার’ এইসব সরকারের প্রতিনিধিদের।

দেশের এই কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে এ হেন চরম নিষ্ঠুরতা দেখানোর স্পর্ধা সরকারগুলি পায় কোথা থেকে? এর পিছনে আসলে শক্তি জোগায় একদিকে এই নিষ্ঠুর শোষণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার পুলিশ-মিলিটারি, বিচার ব্যবস্থা। আর একদিকে নিরন্ন নাচার এই শ্রমিকদের নিরুপায় মজুরি-দাসত্বের শৃঙ্খল। শত শত বছরের এই দাসত্বকেই আইন বলে, নিয়তি বলে এদের মানতে শিখিয়েছে সমাজের মালিক শ্রেণি। মাথা নিচু করে ছুঁড়ে দেওয়া দুটো রুটি আর যন্ত্রণা ভোলার জন্য মদ, এই জীবন ছাড়া বাকি দুনিয়াকে দেখার যে চোখ তাতে ঠুলি পরানোর জন্য মালিক শ্রেণি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করেছে বিপুল শক্তির আধার এই শ্রমিকদের। এভাবেই শ্রমিকদের অসচেতনতা এবং অসংগঠিত বিচ্ছিন্ন অবস্থানের সুযোগ নিয়েছে মালিকরা। এই বিপুল জনশক্তি সঠিক নেতৃত্বে সংগঠিত হলে মালিকের সেবাদাস সরকারগুলির ক্ষমতা হত না এঁদের এমন অমানুষিক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতে।

লকডাউন একদিন উঠে যাবে। করোনা বিপর্যয় কেটে যাবে। সরকার খয়রাতির হিসাব দিয়ে আবারও ভোট বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা চালাবে। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ এই মেহনতি মানুষ, যাদের শ্রমের উপর ভর দিয়ে এই সভ্যতা সচল রয়েছে, তাদের পরিণতি? সহজেই অনুমান করা যায়– সভ্যতার পিলসুজের মতো এরা মাথায় প্রদীপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর প্রদীপের তেল এদের গা বেয়ে চুঁইয়ে পড়বে। বর্তমান শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ভাঙতে না পারলে, নতুন নতুন বিপর্যয়ের আঘাতে, আগামী দিনে আরও কত শত সহস্র শ্রমিককে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে কারও জানা নেই। মনে পড়ে যায় মহান মানবতাবাদী সাহিত্যিক শরৎচন্দে্রর ‘পথের দাবী’র সেই কথাগুলি– ‘‘শুধু একবার যদি তোমাদের ঘুম ভাঙে, কেবল একটিবার মাত্র যদি সত্য কথাটা বুঝতে পারো যে তোমরাও মানুষ, তোমরা যত দুঃখী, যত দরিদ্র, যত অশিক্ষিতই হও তবুও মানুষ, তোমাদের মানুষের দাবী কোনো অজুহাতে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না, … এ যে কেবল ধনীর বিরুদ্ধে দরিদ্রের আত্মরক্ষার লড়াই! এতে দেশ নেই, জাত নেই, ধর্ম নেই, … হিন্দু নেই, মুসলমান নেই,– জৈন, শিখ কোন কিছুই নেই, – আছে শুধু ধনোন্মত্ত মালিক আর তার অশেষ প্রবঞ্চিত অভুক্ত শ্রমিক! … বিনা শ্রমে সংসারে কিছুই উৎপন্ন হয় না –তাই, শ্রমিকও … সকল বস্তু, সকল কারখানার অধিকারী।” তাই সরকারি অনুকম্পা নয়, সেই অধিকারকে বুঝে নিতে, এই শোষণ-যন্ত্রণা থেকে স্থায়ী ভাবে মুক্তি পেতে বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ভাঙার লড়াইটাই গড়ে তুলতে হবে।