পঞ্চায়েত নির্বাচনঃ রাজ্য সরকারের ভূমিকার তীব্র নিন্দা এস ইউ সি আই (সি)-র

পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রসঙ্গে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য এক প্রশ্নের উত্তরে গণদাবীকে বলেন, পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ম অনুযায়ী অন্তত দুই থেকে তিন মাস আগেই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে রাজ্যপালের টালবাহানা, অন্য দিকে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত তৃণমূল যতটা সম্ভব ঘর গুছিয়ে ভোটে যাওয়ার পরিকল্পনায় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা ঝুলিয়ে রাখে। সরকারের গড়িমসি ভাব দেখে যখন প্রায় সকলেই ধরে নিয়েছিলেন নির্বাচন এখনই হবে না, ঠিক তখনই হঠাৎ পর্যাপ্ত সময় না দিয়ে নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে দেওয়া হল। উদ্দেশ্য, বিরোধী দলগুলি যাতে প্রার্থী দিতে এবং প্রচার করতে না পারে। আমরা এই চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক আচরণের তীব্র নিন্দা করছি। নির্বাচন ঘোষণার পর থেকেই চলছে হামলাবাজি, এমনকি ইতিমধ্যেই প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা দেশে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ, ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ বাস্তবে অবলুপ্ত। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে শাসক দলগুলি সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে ভোটাধিকার প্রয়োগকে বাস্তবিক অর্থে প্রহসনে পর্যবসিত করেছে। নীতিনৈতিকতার কোনও পরোয়া না করে ছাপ্পা ভোট দেওয়া, সর্বব্যাপী রিগিং, হুমকি, হামলা, খুনোখুনি, বিরোধী পক্ষকে দাঁড়াতেই না দেওয়া প্রভৃতির সাথে বিপুল পরিমাণ টাকা ছড়িয়ে তারা নির্বাচনে জেতে। সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচন আজ আর জনমতের প্রতিফলন নয় বরং তা যে কোনও উপায়ে গদি দখলের খেলা ছাড়া আর কিছু নয়। কিছুদিন আগেই পশ্চিমবঙ্গবাসী দেখেছে আবাস যোজনা নিয়ে পঞ্চায়েতে দুর্নীতির পাহাড়। এই পঞ্চায়েতের মেয়াদ কালেই ক’বছর আগে আমফান ঘূর্ণিঝড়ে সর্বস্ব হারানো মানুষের ত্রাণ নিয়ে ঘটেছিল চরম দুর্নীতি। সাধারণ মানুষ তাদের অভিজ্ঞতায় দেখতে পাচ্ছে, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রসঙ্গে গ্রামস্তর পর্যন্ত ক্ষমতার তথাকথিত বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে যত বড় বড় কথাই বলা হোক না কেন, এর মধ্য দিয়ে বাস্তবে দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছে। মানুষ দেখতে পাচ্ছে, কে দুর্নীতি করার ক্ষমতা অর্জন করবে তার জন্যই চলে পঞ্চায়েত দখলের প্রতিযোগিতা। তাই ক্ষমতাসীন এবং তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার মধুলোভী ভোটবাজ দলগুলির মধ্যে পঞ্চায়েতের নানা স্তরে প্রার্থী হওয়ার জন্য এত কাড়াকাডি, মারামারি এমনকি খুনোখুনি পর্যন্ত হচ্ছে।

এস ইউ সি আই (সি) বহুদিন আগেই এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, গ্রামীণ মানুষের অভাব অভিযোগকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বিক্ষোভ থেকে যাতে আন্দোলনের মানসিকতা গড়ে না ওঠে, তার জন্য শাসক শ্রেণি চায় এই বিক্ষোভকে চাওয়া-পাওয়ার স্তরে নামিয়ে আনতে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এই কাজে শাসক শ্রেণির একটি বড় হাতিয়ার। এর দ্বারা আসলে আমাদের দেশের পুঁজিবাদী প্রশাসনকে গ্রাম স্তর পর্যন্ত প্রসারিত করা হয়েছে। এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালুর আগে যে কাজগুলি সরকারি প্রশাসন করত, সেই ধরনের সমস্ত কাজগুলি এখন আমলাদের তত্ত্বাবধানে তথাকথিত স্থানীয় সরকারের দ্বারা করানো হচ্ছে। পঞ্চায়েতে কী কী কাজ হবে তা পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্যরা কতটুকু ঠিক করতে পারে? বাস্তবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নীতি নির্ধারণের বদলে শুধু কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নির্দেশগুলি রূপায়িত করার সংস্থায় পরিণত হয়েছে। একটি মাত্র কাজই তারা নিজ উদ্যোগে করতে পারে– তা হল সীমাহীন দুর্নীতি।

গ্রামের মানুষের অভিজ্ঞতা, কেন্দ্রের বা রাজ্যের সরকারগুলি দারিদ্র দূর করার জন্য কোনও স্থায়ী ব্যবস্থা করে না। কিন্তু অভাবগ্রস্ত জনগণের জন্য তারা কত কাজ করছে তা দেখাতে নানা প্রকল্পের মাধ্যমে অতি সামান্য সাহায্য সাধারণ মানুষকে দেওয়া হয়– যা দিয়ে তাদের অভাব মেটে না, কিন্তু পঞ্চায়েত বাবুদের কাছে অনুগত থাকতে হয়। তা নিয়েও হয় চরম দুর্নীতি। যাদের তা পাওয়ার কথা নয় তারা পায় এবং যাদের সত্যিই পাওয়া উচিত তারা বঞ্চিত হয়। আর রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য পঞ্চায়েতের ক্ষমতাসীন নেতারা দলবাজি তো করেই, সেই সঙ্গে প্রতিটি সাহায্যের জন্য আদায় করে কাটমানি।

সরকার যখন নানা রকম সাহায্যের নাম করে একদিকে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করে তথাকথিত জনসমর্থন আদায় করছে, ঠিক তখনই চরম জনবিরোধী নীতিগুলিও তারা চালু করছে। সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ, বিজ্ঞান ও ইতিহাসের বিকৃতিকরণ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে শিক্ষার যে সর্বনাশ করতে চাইছে, রাজ্য সরকারগুলি সেই নীতিকেই রাজ্যে রূপায়ণ করছে এবং শিক্ষা নিয়ে যারা ব্যবসা করতে চায় তাদের আস্থা অর্জন করছে। একইভাবে তারা স্বাস্থে্যর সামগ্রিক বেসরকারিকরণের পদক্ষেপ নিচ্ছে।

গ্রামের মানুষের সবচেয়ে নির্ভরতা যে কাজে সেই কৃষিকাজ সরকারি নীতির ফলে সম্পূর্ণ অলাভজনক। ফসলের ন্যায্য দাম চাষিরা পায় না। অথচ চাষ করার সমস্ত উপকরণ– বীজ, সার, কীটনাশক, সেচের জল, ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে। ফলে চাষিরা হাড়ভাঙা খাটুনির পরও ক্রমাগত আরও বেশি করে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।

গ্রামাঞ্চলে কর্মক্ষম মানুষের কাজ নেই। গ্রামীণ মানুষ তাদের ঘরবাডি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে এবং এমনকি বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছে। তারা জানে না সেখানে গিয়ে কী কাজ এবং কত বা মজুরি পাবে। পদে পদে পরিযায়ী শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছে। তবুও পেটের টানে গ্রাম ছেড়ে ভিন্ন প্রদেশে যাওয়ার জনস্রোত চলছেই।

পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তো গ্রামীণ জনসাধারণকে এই দুরবস্থা থেকে রক্ষা করতে পারছে না। তাই আদ্যোপান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত এই ব্যবস্থার প্রতি মোহের কিছু নেই। কিন্তু যেহেতু আপাত রাজনৈতিক পরিসরে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা থাকছেই, তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই আন্দোলন গড়ে তোলাকে আমরা কর্তব্য বলে মনে করি। পঞ্চায়েতে যেখানেই আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি সেখানেই এই লড়াইও আমরা করে থাকি। নির্বাচিত হলে বা বোর্ড গঠন করলে আমাদের দলের উন্নত নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের আধারে আমরা কাজ করে থাকি। আমাদের দল সাধারণ মানুষকে এটাই বোঝায় যে, আমাদের জীবনের প্রতিটি সমস্যা সৃষ্টি হয়ে চলেছে ভারতবর্ষের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ফলে। সত্যিই যদি এই সমস্যাগুলির সমাধান করতে হয়, তা হলে সরকারের প্রতিটি জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে তীব্রতর করে পুঁজিবাদ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের অনুকূলে নিয়ে যেতে হবে।