নেতাজির পাশে দাঁড়িয়েছিল ঐক্যবদ্ধ মণিপুর

মণিপুরের মৈরাং শহরে অবস্থিত আইএনএ মেমোরিয়াল কমপ্লেক্সে নেতাজির মূর্তি

 সারা দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ অত্যন্ত বেদনার সাথে লক্ষ করছেন, গত মে মাস থেকে দুই জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক দাঙ্গায় মণিপুর অগ্নিগর্ভ। গোষ্ঠী সংঘর্ষে হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু শিবিরে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে শত শত বাড়িঘর। আশ্রয় শিবিরে সীমাহীন কষ্টের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ প্রহর গুনছেন কবে শান্তি আসবে, আগুন নিভবে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের চিন্তাশীল মানুষ ভাবছেন কোন পথে শান্তি সম্ভব। কারও কারও মনে প্রশ্ন উঠছে এমন বিবদমান গোষ্ঠীগুলির মধ্যে আদৌ কি সম্প্রীতি সম্ভব? যদি সম্ভবই হবে তাহলে প্রধানমন্ত্রী কেন তিন মাস ধরে নীরব থেকে সংসদে তাঁর আড়াই ঘন্টার বত্তৃতায় মণিপুর নিয়ে মাত্র ৫ মিনিট সময় দিলেন? তাও বললেন কিছু ভাসা ভাসা কথা! কেন তিনি সম্প্রীতি আনতে এতটুকু সক্রিয় হচ্ছেন না? তাঁর আচরণ থেকে এই অভিযোগ উঠছে ভোট লালসায় বিজেপির ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি মণিপুরের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ করে তুলেছে। অভিযোগ উঠছে নানা কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর ভূমিকা নিয়েও। সব মিলিয়ে সাধারণভাবে যে কোনও মানুষের মনে হওয়া স্বাভাবিক অত্যন্ত জটিল এই আবর্ত থেকে মুক্তির পথ হয়ত অধরা।

কিন্তু সত্যিই কি মুক্তির পথ নেই? সত্যিই কি ঐক্য সংহতি সম্প্রীতি অসম্ভব? অথচ ইতিহাস বলছে, এই বৈরিতা চিরকালের নয়। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে, বিশেষ করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ বাহিনীতে কীভাবে মণিপুরের কুকি, মেইতেই বা নাগা জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন, রাজনীতি ও সংগ্রাম’ শীর্ষক গ্র্রন্থে কৃষ্ণা বসু এ বিষয়ে খানিকটা আলোকপাত করেছেন। মণিপুরের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ আইএনএ বাহিনীকে সমর্থন শুধু দিয়েছিল তা নয়, সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। ইতিহাস হল, ১৯৪৪ সালের ১৪ এপ্রিল আইএনএ বাহাদুর গ্রুপের সৈন্যরা এবং শত শত স্থানীয় মানুষ মণিপুরের লোকতক হ্রদের পাশে মইরাং শহরে সমবেত হন। সেদিন ছিল মেইতেইদের নববর্ষ। শওকত মালিক সেখানে ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলন করে ভাষণ দেন। হিন্দুস্তানি সেই ভাষণ স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন এম কৈরেং সিং, যিনি ১৯৬০ সালে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। স্থানীয় জনগণ এই বাহাদুর গ্রুপের সেনাদের চাল, সবজি, লোকতক হ্রদের মাছ ইত্যাদি দিয়ে তাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছেন। মৈরাং-এর আরেকজন স্থানীয় মানুষ এইচ নীলামণি সিং, যিনি মণিপুরের শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন, ১৯৪৪ সালে তাঁর পরিবার শওকত মালিককে নিজের বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল। শওকত মালিক এই বাড়িতেই তার সামরিক কমান্ড সেন্টার স্থাপন করেন ।

১৯৪৫ সালে যখন আইএনএ বাহিনীকে পিছু হঠতে হয়, তখন ১৭ জন মণিপুরী যুবক তাদের সাথে যান। এর মধ্যে কৈরং সিং, নীলামণি সিং সহ চারজন ছিলেন মৈরাং-এর। বাকিরা ছিলেন ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী সংগঠন মণিপুরী মহাসভার সদস্য। এই ১৭ জনের মধ্যে দু-জন ছিলেন মহিলা– কিন্য দেবী এবং রণধনি দেবী। দীর্ঘ দু’মাস পাহাড় নদী বন জঙ্গল পেরিয়ে বার্মার রেঙ্গুনে এই ১৭ জনের গ্রুপ নেতাজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নীলামণির বাবা তার পারিবারিক সঞ্চয় ৩০০০ টাকা তাকে দিয়ে বলেছিলেন, যদি নেতাজির সঙ্গে দেখা করতে পারো এই টাকাটা দিও। নীলামণি নেতাজির হাতে তা তুলে দেন। ১৯৪৪ সালের মে মাসে ব্রিটিশরা রেঙ্গুন পুনর্দখল করলে এই দেশপ্রেমিক সতেরো জন যুবক ব্রিটিশের হাতে বন্দি হন। ব্রিটিশ সরকার তাদের আটক করে রেঙ্গুন সেন্ট্রাল জেলে। ৭ মাস পর তাঁদের কলকাতায় আনা হয়। ১৯৪৬ সালের মে মাসে তাঁরা মুক্ত হন। মণিপুরে ফিরে গেলে সেখানকার মানুষ তাদের প্রবল উচ্ছ্বাসে স্বাগত জানান বীরের মর্যাদা দিয়ে।

সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রামের আদর্শ ভারতের অন্যান্য অংশে যেমন নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন এনে দিয়েছিল, এমনটাই ঘটেছিল মণিপুরেও। মণিপুরে মেইতেই জনগোষ্ঠীর মধ্যে মোটামুটি দশ শতাংশ মুসলিম। ইম্ফল উপত্যকায় বসবাসকারী এই মুসলিমরা পঙ্গল নামে পরিচিত। আইএনএ বাহিনীর মুক্তি সেনা মোহম্মদ নাকি ছিলেন পঙ্গল গোষ্ঠীর মানুষ। তিনি ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান আর্মির সিপাই ছিলেন। স্বাধীনতার জন্য সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগ দেন।

 আজকের বিক্ষোভের অন্যতম কেন্দ্র চূড়াচাঁদপুরের সৈকত গ্রামে পাহাড়ের উপর একটা বিশাল আই এন এ ক্যাম্প ছিল। ক্যাম্পে নেতাজি এসেছিলেন। যে গাছতলায় নেতাজি বসেছিলেন, গ্রামবাসীরা পরম শ্রদ্ধায় তার যত্ন নেন। এই গ্রাম ছাড়ার আগে নেতাজি সৈকত গ্রামের রাজা কলবেলকে বলেন, আমি জানি এই এলাকার মানুষ আইএনএ বাহিনীকে খাদ্য সরবরাহ করে চলেছেন। ভারতকে স্বাধীন করার জন্য তাদের এই অবদান আমি ভুলব না। মেইতেই, পঙ্গল, কুকি সকলেই আইএনএ বাহিনীকে সাহায্য করেছেন। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের জাঁতাকল থেকে মুক্তি আকাঙক্ষাই তাদের মধ্যে ঐক্য সংহতি সহমর্মিতা গড়ে দিয়েছিল। মেইতেইরা ভুলতে পারেনি ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে অ্যাংলো-মণিপুর যুদ্ধে রাজপুত্র টিকেন্দ্রজিৎ সিং ও তাঁর জেনারেলদের ইম্ফলের মাটিতে ফাঁসি দেওয়ার কথা। কুকিরা ভুলতে পারেনি ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ অ্যাংলো-কুকি যুদ্ধে কুকিদের উপর ব্রিটিশদের নির্মম অত্যাচারের কথা। নাগারাও এই সংগ্রাম থেকে পিছিয়ে ছিল না। উখরুল মণিপুরের নাগা অধ্যুষিত এলাকা। সেখানে নাগা ন্যাশনালিজমের প্রবর্তক অনগামি ঝাপু ফিজো ১৯৪৪ সালে আইএনএ-তে যোগ দেন ।

এই ঐক্য সংহতি নষ্ট হতে শুরু করে স্বাধীন ভারতে। এর কারণ খুঁজতে গেলে চোখে পড়ে, গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত জুড়েই সামরিক বাহিনীর অত্যাচার। ভারত সরকার– কংগ্রেস আমল থেকে শুরু করে বিজেপি শাসন পর্যন্ত, দানবীয় কালাকানুন তৈরি করেছে। জনগণের ক্ষোভের কারণগুলি ধৈর্য সহকারে শোনা এবং গণতান্ত্রিক পথে তার সমাধানের চেষ্টা না করে সরকার দমনপীড়নের পথ নিয়েছে। এর ফলে সরকারের সাথে জনগণের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভোটের স্বার্থে গোষ্ঠীগত সেন্টিমেন্টে উস্কানি যা পরিস্থিতিকে অগ্নিগর্ভ করে তুলেছে। পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্তির সংগ্রামে কুকি, মেইতেই, নাগা সহ সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। সেই কারণে তারা পরস্পরের বন্ধু। শোষণমুক্তির এই দীর্ঘ ও জটিল সংগ্রামে সব জনগোষ্ঠীর শোষিত মানুষকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে হবে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি সংগ্রামের আদর্শকে হাতিয়ার করে। তবেই গড়ে উঠবে ঐক্য সংহতি সম্প্রীতির বাতাবরণ।