নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি কেন সর্বনাশা, বুঝতে হবে সবাইকে

দিল্লি, ২০২২

মাইক ব্যানার টাঙাতেই দুই তরুণ পুলিশ অফিসার এসে হাজির। কী নিয়ে সভা? বললাম, জাতীয় শিক্ষানীতি। বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞাসা করলেন, জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে পথসভা? কেন? স্বল্প কথায় বিষয়টা বোঝাতেই বিস্ময়ের সঙ্গে তাঁদেরই একজন বললেন, সর্বনাশ! কই, খবরের কাগজে, টিভিতে তো এ-সব খবর নেই!

ঠিকই তো, কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় শিক্ষানীতির নামে দেশের মানুষের ঘাড়ে কেমন শিক্ষানীতি চাপিয়ে দিচ্ছে, খবরের কাগজগুলি, টিভি চ্যানেলগুলি যদি তা তুলে ধরত, এ নিয়ে শিক্ষাবিদদের বক্তব্য প্রচার করত, চ্যানেলের সান্ধ্য আসরগুলিতে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন আজগুবি বিষয় নিয়ে বিতর্কের ধোঁয়া না তুলে এই সব নিয়ে বিতর্ক হত, তা হলে সাধারণ মানুষও বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারত এবং তার ভাল-মন্দ বিচার করতে পারত। বাস্তবে বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যমগুলিতে তেমন কিছুই হয় না। পরিবর্তে তৃণমূলের কোন বড় নেতাকে ইডি তলব করতে পারে কিংবা অমুক নেতার কবে গ্রেফতার হওয়ার সম্ভাবনা, সিপিএম নেতারা তাদের আমলে দুর্নীতিকে কেমন করে চেপে রেখেছিল, সিপিএমের দুর্নীতির থেকে তৃণমূলের দুর্নীতি কত বেশি– এমন সব বিষয় নিয়েই চলে ‘বিশেষজ্ঞদের’ মত-বর্ষণ। যদি খবরের কাগজগুলি, চ্যানেলগুলি জনস্বার্থে এই গুরুদায়িত্ব পালন করত তবে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-কে মানুষের কাছে হাত পেতে চাঁদা তুলে এমন পথসভার আয়োজন করতে হত না। তথাকথিত বড় রাজনৈতিক দলগুলি এই সর্বনাশা শিক্ষানীতি নিয়ে কার্যত নীরব।

বাস্তবে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)ই একমাত্র রাজনৈতিক দল যারা নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির ক্ষতিকর দিকগুলি এক দিকে শিক্ষামহল অন্য দিকে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরছে। মানুষকে বোঝাচ্ছে যে, এই ধ্বংসাত্মক জাতীয় শিক্ষানীতি যদি কার্যকর হয় তবে দেশের নিরানব্বই শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার নামে এমন জিনিসই পাবে, যা আসলে দুধের নামে পিটুলি গোলা জল।

হয়তো আপনি একজন ব্যস্ত মানুষ। হয়তো আপনি সরকারি কিংবা বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন, অথবা আপনার ছোটখাটো কোনও ব্যবসা রয়েছে, বা আপনি একজন দোকান কর্মচারী। সারা দিন আপনার ব্যস্ততায় কাটে। তাই আপনি মনে করেন, ওরে বাবা, জাতীয় শিক্ষানীতি? ওর আমি কী বুঝব? ও বোঝা আমার কাজ নয়। যারা বোঝার তারা বুঝুক। তা হলে আপনি বিরাট ভুল করে বসবেন। আপনি এই যে উদয়াস্ত কঠোর পরিশ্রম করছেন, যে জন্য অন্য কোনও কিছু সম্পর্কে খোঁজ রাখার আপনার সময় নেই বলে আপনি মনে করেন, সেই পরিশ্রম কেন করছেন? করছেন তো এই জন্য যে, ছেলেমেয়েরা যাতে ভাল শিক্ষা পায় তার পিছনে আপনার পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ ব্যয় করবেন। অথচ আপনার উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে সেই শিক্ষাটাকেই কেন্দে্রর বিজেপি সরকার এবং রাজ্যের তৃণমূল সরকার মিলে প্রহসনে পরিণত করে ফেলার ফন্দি এঁটেছে এই জাতীয় শিক্ষানীতির মধ্যে দিয়ে। যেমন, স্নাতক স্তরকে তিন বছরের পরিবর্তে চার বছরের করে দেওয়া হচ্ছে এই নীতিতে। এর ফলে ছাত্রদের স্নাতক ডিগ্রির জন্য অতিরিক্ত এক বছর পড়তে হবে। ফলে এই কোর্সের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় যেমন করতে হবে তেমনই কলেজে শিক্ষকের সংখ্যা, ক্লাস রুমের সংখ্যা, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়াতে হবে। কিন্তু এ সবের বাড়তি খরচ কোথা থেকে আসবে জাতীয় শিক্ষানীতিতে তা একেবারেই বলা নেই। রাজ্য সরকার জানিয়ে দিয়েছে এর অতিরিক্ত ব্যয় কলেজগুলিকেই সংগ্রহ করতে হবে। এমনিতেই কলেজগুলি শিক্ষক এবং পরিকাঠামোর সঙ্কটে ভুগছে। এর ফলে সঙ্কট আরও বাড়বে এবং পড়াশোনার মান নীচে নামবে। যথারীতি অভিভাবকরা বাধ্য হবেন অনেক বেশি খরচ করে বেসরকারি কলেজে যেতে। এই নীতির দ্বারা বাস্তবে শিক্ষার বেসরকারিকরণকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে।

এই নীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিটি হয়ে যাবে এক বছরের। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এই যে অজস্র বিশ্ববিদ্যালয়, তার বিপুল আয়োজন তা কি কেবল এক বছরের স্নাতকোত্তর কোর্স পড়ানোর জন্য টিকে থাকবে? ইতিমধ্যে বহু কলেজকেও তো স্নাতকোত্তর পড়ানোর অধিকার দেওয়া হয়েছে। আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য স্নাতক বিভাগ খোলে তবে কলেজগুলির কী হবে? এ সব প্রশ্নের কোনও উত্তর জাতীয় শিক্ষানীতিতে নেই।

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, তৃণমূল সরকার তো জাতীয় শিক্ষানীতির বিরোধিতা করছিল, হঠাৎ কী এমন ঘটল যে তারা সমর্থন শুধু নয়, একেবারে কার্যকর করা শুরু করে দিল? এ প্রশ্নের উত্তর কোনও তৃণমূল নেতা বা মন্ত্রীর কাছ থেকে না পাওয়া গেলেও সাধারণ মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে জানেন যে, তাদের সেই বিরোধিতা ছিল একেবারেই লোক দেখানো। নীতিগত ভাবে কেন্দ্রের জাতীয় শিক্ষানীতির বিরোধিতা তারা কখনওই করেনি। এই শিক্ষানীতি কী ভাবে শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, কী ভাবে শিক্ষাকে অন্তঃসারশূন্য করে তুলছে, কেন এই নীতি সমাজের বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে, কেন এর ফলে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে, কেন এই নীতির বিরোধিতা করা উচিত– এ সব কোনও কিছুকেই তারা জনগণের সামনে, কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকদের সামনে স্পষ্ট করে বলেনি।

ঠিক যেমন লোকদেখানো বিরোধিতা করেছে সিপিএম। এ রাজ্যে তাদের নেতারা এই নীতির ভয়ানক বিরোধিতার ভাব দেখালেও তাদের হাতে যে একটি রাজ্যের পরিচালনার ভার রয়েছে, সেই কেরালায় তারা জাতীয় শিক্ষানীতিকে কার্যকর করার কথা ঘোষণা করে দিয়েছে। অদ্ভূত ভাবে তৃণমূল এবং সিপিএমের যুক্তি এ ক্ষেত্রে হুবহু এক। তা হল, জাতীয় শিক্ষানীতিকে রাজ্যে কার্যকর না করলে রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা পিছিয়ে পড়বে। অথচ শিক্ষা যৌথ তালিকাভুক্ত হওয়ায় প্রয়োজনে কেন্দ্রের সুপারিশ করা নীতির সোচ্চার বিরোধিতা করা এবং রাজ্যে তা প্রয়োগ না করে কেন্দ্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ ও ক্ষমতা রাজ্য সরকারের আছে। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল বা কেরালার সিপিএম সরকার কিন্তু সে পথে হাঁটল না। পরিবর্তে দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের শিক্ষার দায় কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে এই সর্বনাশা শিক্ষানীতিকেই কার্যকর হতে দিল। শুধু তাই নয়, তৃণমূল, সিপিএম বা বিজেপি সরকার কেউই কিন্তু পুরনো শিক্ষাব্যবস্থাটির কোথায় ত্রুটি, কেন তার পরিবর্তন করা দরকার, নতুন শিক্ষানীতি পুরনোটির থেকে কোথায় উৎকৃষ্ট তা দেশের মানুষকে, এমনকি শিক্ষাবিদ-শিক্ষকদেরও জানাল না বা কারও মতামত নিল না। একতরফা অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নতুন একটি শিক্ষানীতি ঘোষণা করে দিল।

এই অবস্থায় এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) একমাত্র দল যারা এই শিক্ষানীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরছে এর মারাত্মক ক্ষতিকারক দিকগুলি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারকে এই নীতি প্রত্যাহারে বাধ্য করতে হলে শিক্ষক-শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী সহ সাধারণ মানুষকেও এই প্রতিবাদে সামিল হতে হবে। তার জন্য দরকার শত ব্যস্ততার মধ্যেও এই শিক্ষানীতির ক্ষতিকারক দিকগুলি জানা, বোঝা এবং তার বিরোধিতা করা। শিক্ষাকে বাঁচানোর এই গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে সামিল হওয়াই অশিক্ষার হাত থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করার একমাত্র উপায়।