তৃণমূল–বিজেপি দ্বৈরথে বলি দেওয়া হচ্ছে জনস্বার্থকে

লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ১৮টি আসনে জেতার পর বিজেপির অত্যুৎসাহী নেতা–কর্মীদের (যাদের অধিকাংশই দু’দিন আগেও ছিলেন সিপিএম ও তৃণমূল কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্মী) প্রবল দাপাদাপির সাথে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি এবং তার বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর তেড়ে যাওয়া, কিছু কুকথার বর্ষণ– এই নিয়েই এখন সংবাদমাধ্যম সরগরম৷

মাত্র কিছুদিন আগেই তৃণমূলের আশ্রয়ে থাকা মস্তানবাহিনীর এক নেতা দলীয় বৈঠকে লোকসভা নির্বাচনের টিকিট না পেয়ে সোজা গিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন এবং টাকা আর পেশির জোরে তৃণমূলকে টেক্কা দিয়ে সাংসদও হয়ে গেছেন৷ তার আগে সারদা মামলায় সিবিআইয়ের ডাক পেয়েই পিঠ বাঁচাতে কেন্দ্রীয় শাসক দলে আশ্রয় নিয়েছিলেন আর এক নেতা, তাঁর বিধায়ক পুত্রও সদ্য বিজেপির ছাতার তলায় গেছেন৷ মাফিয়া, অস্ত্র পাচারকারী এবং স্মাগলার বলে কোচবিহারে তৃণমূলের যে নেতার বিরুদ্ধে একদা সবচেয়ে বেশি অভিযোগ তুলত বিজেপি, তিনিও এখন বিজেপির টিকিটেহ সাংসদ৷ এইসব নেতাদের জামার খুঁট ধরে করে খাওয়ার রাজনীতি থেকে ফয়দা লোটে যে তোলাবাজ, স্থানীয় মস্তানরা, তারাই এখন নেতাদের নেকনজরে রামভক্তির জিগির তোলার কাজে সবচেয়ে বেশি অগ্রণী৷ এদের ভক্তিরস রামে যতটা নয়, তার থেকে অনেক বেশি নেতাদের প্রসাদেই৷

রাম নামকে ভিত্তি করে এদেশের বিরাট অংশের ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগ আছে৷ পশ্চিমবঙ্গে যদিও কোনও দিনই রামভক্তির এই প্রাবল্য দেখা যায়নি৷ বিজেপি যেভাবে এই ‘শ্রীরাম’ ধ্বনিকে ব্যবহার করছে তাতে ধর্মের বা ভক্তির ছিটেফোঁটা নেই৷ তাদের এই জিগির কোনও ভক্তি জাগাচ্ছে না, বরং সমাজে একটা চাপা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করছে৷ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তো বটেই, ধর্মে হিন্দু এমন বেশিরভাগ মানুষও নতুন করে সাম্প্রদায়িক বিভাজন, হানাহানির পরিবেশ তৈরির আশঙ্কায় সিঁটিয়ে আছেন৷ নরেন্দ্র মোদি তাঁর দ্বিতীয় দফা শুরু করতে না করতেই উত্তর এবং মধ্য ভারতে সংখ্যালঘু মানুষের উপর নির্যাতনের একের পর এক ঘটনা শুরু হয়ে গেছে৷ ওড়িশার মিশনারি এবং সমাজসেবী গ্রাহাম স্টেইনস হত্যায় মূল অভিযুক্ত, মালেগাঁও বিস্ফোরণে অভিযুক্তরা আজ বিজেপির সাংসদ৷ ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যায় অভিযুক্ত হয়েও যিনি সব অভিযোগকে ধামাচাপা দিয়ে দিতে সিবিআইকে পুরোপুরি ব্যবহার করেছেন সেই অমিত শাহ আজ দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী৷

এই পরিস্থিতিতে দেশের সমস্ত সমস্যা ছেড়ে বিজেপি যখন রামের নামে জিগিরকেই একমাত্র হাতিয়ার করেছে তাতে তাদের বাকি দিনগুলির পরিকল্পনা কী হতে পারে তা মোটামুটি পরিষ্কার৷ এমন নয় যে, নরেন্দ্র মোদি সরকার যখন দ্বিতীয়বার ক্ষমতা নিল, সে সময় দেশের আর কোনও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের অপেক্ষায় নেই বেকারির হার যেন সর্বোচ্চ নয়, মূল্যবৃদ্ধি যেন আর মানুষকে ভাবাচ্ছে না! শিল্প–কৃষিতে উৎপাদন যেন সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে তলানিতে নামেনি! যেন কোটি কোটি আদিবাসী–মূলবাসী বনাঞ্চল এলাকার মানুষ উচ্ছেদের খাঁড়ার তলায় মাথা রেখে বসে নেই!বিজেপি নেতারা এগুলি খুব ভাল করে জানেন বলেই এসব সমস্যাকে ভোলাতে দেশের মধ্যে অন্ধ ভক্তির জোয়ার সৃষ্টিতে মনপ্রাণ সঁপেছেন৷ দেখা যাচ্ছে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের উপস্থিতিতেই তাঁর রোড শো–র অংশগ্রহণকারীরা কলকাতায় বিদ্যাসাগর মূর্তি ভাঙলেও তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার নিন্দা করেননি৷ বিজেপির ঘনিষ্ঠ এবং তাদের ভক্ত বলে নিজেকে জাহির করা এক অভিনেত্রী এখন ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়কে ব্রিটিশের দালাল বলে অভিহিত করে সতীদাহকে নতুন করে মহিমান্বিত করতে চেয়েছেন৷ বস্তুত এবারের ভোটের সময় সংবাদমাধ্যমেই বারবার এসেছে যে, রাজস্থান, গুজরাটের মতো কিছু রাজ্যে প্রচারে সতী মাহাত্ম্য, নারীকে ঘরবন্দি করার মতো বস্তাপচা চিন্তাকেই বিজেপি তুলে ধরেছে৷ তাদের নেতাদের কথায় সংখ্যালঘু বিদ্বেষের সাথে কুসংস্কারের বন্দনাই ভারতীয়ত্বের মর্যাদা পেয়েছে৷ যে যুক্তিবাদী মন গড়ে তোলার জন্য রামমোহন, বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল প্রমুখ ভারতীয় নবজাগরণের মনীষী লড়াই করেছেন বিজেপি তার অবলুপ্তি চায়৷ তাই তাদের ভোট প্রচারে যেমন কোনও রাজনৈতিক স্লোগান ছিল না, পরেও নেই৷ এমনকী যে তৃণমূলের অপশাসনের উপর রাগ থেকে বহু তৃণমূল সমর্থকও তাঁদের ভোট দিলেন, সেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষের মূল দাবিগুলির কোনও উল্লেখও বিজেপির স্লোগানে নেই৷ তাই রাজনীতির কথা ছেড়ে তাদের স্লোগান এখন রামেই বন্দি৷

কিন্তু বিজেপির এই আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যে পাল্টা আচরণ করছেন, যে ধরনের ভাষা প্রয়োগ করছেন, তা বিজেপিরই আরও সুবিধা করে দিচ্ছে৷ তিনি এবং তাঁকে অনুসরণ করে চলা কিছু নেতা বিজেপির লুম্পেনদের এই ফাঁদে পা দিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে মানুষের হাসির খোরাক হচ্ছেন৷ রাজনীতির ময়দানে রাজনৈতিক বক্তব্য ছেড়ে বিজেপির এই রামভক্ত সাজার অপচেষ্টাকেই জনমানসে আরও প্রতিষ্ঠা দিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা৷ ভোটের আগে তৃণমূল নেত্রী বিজেপির থেকেও বড় রামভক্ত সেজে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক কবজা করার আশা করেছিলেন৷ আবার একই সাথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের প্রকৃত উন্নতি করার বদলে সস্তা চমক দিয়ে তাদের মনতুষ্টির ব্যর্থ চেষ্টায় ইমাম–মোয়াজ্জেম ভাতা ইত্যাদির পাল্টা প্রতিক্রিয়াও বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক তৈরিতেই কাজে লেগেছে৷ তা করতে গিয়ে বিজেপির বিভেদকামী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা বাংলার গ্রামে–গঞ্জে বাড়িয়েছেন তাঁরাই৷ একদিকে তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, পঞ্চায়েত ভোটে কাউকে নমিনেশন পর্যন্ত করতে না দেওয়ার ক্ষোভ যেমন মিলে গিয়েছিল৷ তার সাথে তৃণমূলের নিচুতলার বেশ কিছু কর্মী এবং প্রশাসনের একাংশও গোপনে বিজেপিকে ভোট করিয়েছেন৷ নির্বাচন কমিশনের বদান্যতায় বিজেপি যে সমস্ত সুবিধা এবং কারচুপির সুযোগ পেয়েছে সেগুলি এর বাড়তি৷ কিন্তু এর মোকাবিলা করতে গিয়ে রাজনৈতিক বিরোধিতা, আদর্শগত বিরোধিতার বদলে সস্তা কিছু ধমক–চমক, হুমকি, তেড়ে যাওয়া, গালাগালি এগুলি কোনও সভ্য–ভদ্র মানুষ মানতে পারেন না৷ তৃণমূল নেত্রী সহ তাদের একদল নেতা–কর্মীর আচরণ তাই পরোক্ষে বিজেপিরই সুবিধা করে দিচ্ছে৷

মুখ্যমন্ত্রী রাগ করে বলেছেন, তিনি বেশি কাজ করে ফেলেছেন, অতঃপর কাজ একটু কম করবেন৷ অর্থাৎ তাঁর সরকারের প্রধান বিজ্ঞাপিত কর্মসূচি কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সাইকেল বিতরণ, ক্লাব অনুদান ইত্যাদির মাধ্যমে ঢালাও দান খয়রাতির পরেও তাঁর দলের এই শোচনীয় ফল তিনি মানতে পারছেন না৷ মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়াই বলে দেয় একটা নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব, কাজ এবং সর্বোপরি রাজ্যের প্রধান শাসক হিসাবে মানুষের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাকে তিনি কোন চোখে দেখেন৷

নির্বাচিত কোনও সরকার দেশের মানুষের জন্য যে টাকা খরচ করে তা কোনও মন্ত্রী–আমলা কিংবা শাসক দলের বদান্যতার দান নয়৷ মানুষের রক্ত জল করে দেওয়া ট্যাক্সের টাকাই সরকার জনকল্যাণে খরচ করে৷ মুখ্যমন্ত্রী সেই সরল সত্যটিই ভুলে গেছেন বোধহয় জনকল্যাণে খরচ মানে শিক্ষা–স্বাস্থ্য–পানীয় জল–রাস্তাঘাট ইত্যাদি খাতে খরচের পাশাপাশি শহর এবং গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থানের অভিমুখে খরচ করাটাই সরকারের প্রধান কর্তব্য৷ সেজন্য সরকারি দফতরে শূন্য পদ পূরণ করা, নিয়মিত সরকারি চাকরি বা শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা নেওয়া এবং সময়মতো নিয়োগ করা, মূল্যবৃদ্ধি রোধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো৷

কৃষকের ফসলের লাভজনক দামের ব্যবস্থা, শহর এবং গ্রামীণ বেকারদের জন্য সারা বছর সন্তোষজনক মজুরির কাজের ব্যবস্থা ইত্যাদি কাজগুলি করা দরকার ছিল৷ স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টির পিছনে খরচ এবং যথার্থ কর্মসংস্থানের প্রক্রিয়াকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র কিছু অনুদান এবং দান খয়রাতির দ্বারা মানুষের প্রকৃত কল্যাণ করা যায় না৷ যাঁরা এই অনুদানগুলি পেলেন তাঁদের হুমকি দিয়েই হোক আর নিছক কৃতজ্ঞতা পূরণের দাবি রেখেই হোক কিছুদিন কিছু মানুষকে এই দিয়ে গোলাম করে রাখা যায়৷ কিন্তু তা দিয়ে মানুষের জীবনের সর্বগ্রাসী সংকট নিরসন হয় না৷

ভোট সর্বস্ব বুর্জোয়া রাজনীতির এটাই বৈশিষ্ট্য৷ এখানে নীতি–নৈতিকতা, আদর্শের কোনও বালাই নেই৷ বিজেপির রাম নামের স্লোগানে যেমন রামভক্তির বদলে আছে শুধু মতলববাজি, তৃণমূলের রাজনীতিতেও এই ভোট সর্বস্বতাই প্রধান৷ 

এই দুই রাজনীতিকেই পরাস্ত করতে তীব্র বাম–গণতান্ত্রিক আন্দোলনই পথ৷ কোনও ভোট রাজনীতির ছকে একে পরাস্ত করা যাবে না৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা)